কাল রাত্রে অনেকবারই ভ্রমর এ-ঘরে এসেছে। অমল শুয়ে পড়ার আগেও একবার এসেছিল। ভেতর দিকে জানলা সারা রাত খোলা পড়ে আছে। ভ্রমর যা দিতে চেয়েছিল অনায়াসে দিতে পারত। সে কেন দিল না, কি অসুবিধে তার হয় কে জানে!
ভোরবেলায় অমলের মন ভেঙে গেল, অভিমান এবং দুঃখ হল। একপাশ থেকে মাফলারটা উঠিয়ে নিয়ে অমল আরও একবার ঘর দেখল, দেখে দরজার ছিটকিনি খুলে বাথরুমে চলে গেল।
সূৰ্য উঠল যখন তখন বাড়িতে বেশ চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। আজ সকালে গির্জায় ক্রীশমাসের বিশেষ প্রার্থনা। হিমানীরা সবাই চার্চে চলেছেন। সাজ-গোজ এখনও শেষ হয় নি সকলের। কৃষ্ণা যেন সারা বাড়ি ছুটোছুটি করছিল, তার গলা শোনা যাচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে, ভ্রমর ঘর বন্ধ করে পোশাক বদলাচ্ছে, মেসো-মশাই বাদামী রঙের একটি স্যুট পরে বাইরে ফুলবাগানে রোদে দাঁড়িয়ে পাখিদের কেক-বিস্কুটের গুঁড়ো খাওয়াচ্ছেন, ফলের টুকরো ছুঁড়ে-ছুঁড়ে দিচ্ছেন। হিমানী-মাসি এখনও ঘর ছেড়ে বাইরে আসেন নি।
অমল চা খেয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছে। মেসোমশাই মাঝে মাঝে তার সঙ্গে কথা বলছিলেন। সকালটি এখন রোদ আলো ও সর্বরকম উজ্জ্বলতা নিয়ে ফুটে উঠেছে। আকাশে কোথাও একটু, মলিন ভাব নেই, ছিমছাম পরিষ্কার আকাশ, আগুনের নরম আঁচের মতন রঙ ধরেছে রোদের, গাছপালার সবুজ পাতা-গুলি খুব ঝকঝকে দেখাচ্ছে, মরসুমী ফলের বাগানের সব ফুলই প্রায় তুলে নেওয়া, দু-একটি সদ্য-প্রস্ফুটিত পুষ্প পাতার মধ্যে ফাঁকে-ফাঁকে দেখাচ্ছিল। গোলাপ গাছে মাত্র একটি লাল গোলাপ। ঘাসের ওপর সকালের রোদ সোনার জলের মতন ছড়িয়ে যাচ্ছিল। মেসোমশাইয়ের চারপাশে পাখির ঝাঁক, কতক চড়ুই কতক শালিক, কাক এসেছে দল বেঁধে। ওর মধ্যে অমল একটি বেগুনী-লাল পালকের ছোট্ট পাখি দেখল। সে আলাদা একপাশে দাঁড়িয়ে ভীরুর মতন বিক্ষিপ্ত খাদ্যকণা খুঁটে নিচ্ছিল।
বাড়ির ফটকের কাছে টাঙা এসে গেল। মেসোমশাই টাঙা দেখে ব্যস্ত হলেন, হাতের ঘড়ি দেখলেন। পাখিদের খাবার দেওয়া বন্ধ হল; রুমাল বের করে হাত মুছলেন। মুছে অমলকে একবার তাগাদা দিতে পাঠালেন।
কৃষ্ণা সাজগোজ শেষ করে ফেলেছে। খুবই অবাক হয়ে অমল দেখল, কৃষ্ণা আজ শাড়ি পরেছে। নীল রঙের জংলী ছিট-ছিট সিল্কের শাড়িতে কৃষ্ণাকে একেবারে নতুন ও সুন্দর দেখাচ্ছিল। শাড়িটা যেন সে দু-হাত দিয়ে বয়ে-বয়ে হাঁটছে। গায়ে সাদা ফ্লানেলের মেয়েলী কোট, কোটের বকে নানা রকম কারকার্য। মাথায় খোঁপা বেঁধেছে। কানে ইয়ারিং, হাতে বালা। অমল মুগ্ধ হয়ে বলল, “বারে! তোমায় একেবারে…একেবারে বিরাট বড় দেখাচ্ছে!”
রুমাল দিয়ে কৃষ্ণা কপালের পাউডার মুছছিল। সারা মুখ খুশীতে উথলে উঠল। বলল, “ভাল দেখাচ্ছে?”
“খুব ভাল। বিউটিফুল!”
“হ্যাত্!”
“বলছি। তুমি আর কাউকে গিয়ে দেখাও।”
“টিকলি পরবো একটা?”
“টিকলি! টিকলি কি?”
“টিপ, এক কিসমের টিপ; আমার কাছে আছে।”
“হিন্দুস্থানী টিপ!” অমল হা-হা করে উঠল, “পরো না। মার্ডার হয়ে যাবে সব। এমনিতেই বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।” বলে অমল স্নেহবশে কৃষ্ণার মাথার ওপর থেকে সুতোর একটা আঁশ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল। বলল, “মেসোমশাই ডাকাডাকি করছেন—তাড়াতাড়ি নাও।”
কৃষ্ণার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ভ্রমরকে ডাকতে গেল অমল। ভ্রমরের ঘরের সামনেই দেখা। দরজা খুলে সবে বেরিয়েছে। অমল থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, অপলক চোখে দেখতে লাগল ভ্রমরকে।
ভ্রমর দুধের মত সাদা একটি শাড়ি পরেছে; সিল্ক নয়, অথচ সিল্কের মতন নরম মসৃণ ও ঝকঝকে, শাড়ির পাড় নেই, কমলা রঙের সুতো দিয়ে ধার মোড়া আগাগোড়া; গায়ে সাদা জামা; বাদামী রঙের সামান্য কাজ করা শাল গায়ে, চুল এলো, ঘাড়ের কাছে ফিতের একটা ফাঁস দেওয়া রয়েছে। মুখে কোথাও কোনো প্রসাধন নেই, হয়ত সামান্য পাউডার ছোঁয়ানো। ভ্রমরের হাতে ছোট বাইবেল। অমল অভিভূত হল। তার মনে হচ্ছিল, ভ্রমরের সমস্ত চেহারায় কেমন যেন অতি পবিত্র একটি আভা ফুটে রয়েছে, আশ্চর্য শুভ্রতা এবং শুদ্ধতা। মুহূর্তের জন্যে অমলের মনে হল, ভ্রমরকে এখন ঠিক যেন ছবির মতন দেখাচ্ছে। তার গায়ে সকালের আলো, পায়ের তলায় রোদ।
অভিভূত অমল কেমন শব্দ করল একটু, বিমোহিত মানুষ যেমন করে। পরক্ষণেই তার মনে হল, সকাল থেকে সে ভ্রমরের ওপর বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে আছে। ভ্রমর তাকে অকারণে প্রতীক্ষা করিয়েছে, সারা ঘর খুঁজিয়েছে, অথচ অমল পায় নি।
ভ্রমরই কথা বলল প্রথমে, “তুমি পোশাক বদলাও নি?”
“আমি!…না।”
“তুমি যে কাল বলেছিলে আমাদের সঙ্গে যাবে।”
অমল বলেছিল: তার যাবার ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু আজ সকালে সে ভেবে দেখল, তার যাওয়ার কোনো মানে হয় না। আজ চার্চের অন্য চেহারা। ইংলিশ চার্চে এবং আজকের এই বিশেষ অনুষ্ঠানের মধ্যে গিয়ে সে মুশকিলে পড়ে যাবে। কিছু বুঝবে না, অন্যদের মতন যা-যা করার করতে পারবে না, অত লোকের মধ্যে বোকার মতন, গেঁয়োর মতন মুখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। অমল যত এই সব কথা ভেবেছে, তত অস্বস্তি বোধ করেছে, কুণ্ঠা অনুভব করেছে। তা ছাড়া, অমল আরও ভেবে দেখেছে, সে যখন কৃশ্চান নয় তখন ভ্রমরদের আজকের পবিত্র উপাসনায় যোগ দেওয়া তার উচিত হবে না। উপাসনা জিনিসটা ঠাট্টা তামাশা নয়, ম্যাজিক কিংবা সার্কাস নয় যে অমল কৌতূহলবশে দেখতে যাবে! মন খুঁতখুঁত করছিল অমলের। সে শেষ পর্যন্ত ঠিক করেছিল, সে যাবে না।