অমল বিছানা থেকে কাঁপতে-কাঁপতে উঠে গিয়ে তার ট্রাউজার, জামা, সোয়েটার, মোজা এক ছুটে নিয়ে এসে বিছানার ওপর ফেলল, এবং সঙ্গে-সঙ্গে লেপ মুড়ি দিয়ে বসে কিছুক্ষণ হিহি করে কাঁপল। আরে শ্বাস, কী ঠাণ্ডা! বরফ পড়ছে যেন বাইরে। এই ঠাণ্ডায় ভ্রমররা কখন উঠেছে, কখন পোশাক বদলেছে, কখনই বা যীশুর গান গাইতে বসেছে কে জানে! ওদের কি শীত করছে না?
অমল ভেবে দেখল, সরস্বতী পুজোর দিন, মাঘ মাসের ভোরে তারা যখন দল মিলে সারা রাত এবং ভোরে ঠাকুর সাজিয়েছে তখন তারা শীত অনুভব করতে পারত না; ওই রকম ভোররাতে একবার অমলকে স্নান করতে হয়েছিল ঠাকুরের ফলফুল গোছানোর জন্যে। আসলে এসব সমর শীত করে না, মন এত খুশী থাকে যে শীত গায়ে লাগে না। ভ্রমরদেরও শীত লাগছে না নিশ্চয়।
দেখতে-দেখতে ভোর ফুটে উঠেছিল। ঘরের অন্ধকার যেন আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে এসে হালকা ধোঁয়ার মতন ভাসছে। দরজা জানলা দেখা যাচ্ছিল চোখে। অমল বিছানার মধ্যে বসে পায়ের মোজাটা আগে পরে নিল। তারপর সোয়েটার গায়ে চড়াল। কাল মাঝরাতের দিকে একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তখন তার হঠাৎ একটা কথা মনে হয়েছিল, কিন্তু অমল কথাটা বিশ্বাস করে নি এবং ঘুম জড়িয়ে থাকায় সে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। কথাটা এখন আবার অমলের মনে পড়ল। ভ্রমর বলেছিল, “সকালে উঠে তোমার ঘরে একটা জিনিস দেখতে পাবে। কাউকে বলবে না, চুপচাপ থাকবে।”
এখন ত সকাল হয়ে আসছে, কই কিছু দেখতে পাচ্ছে না অমল। ট্রাউজার পরতে-পরতে অমল চোখের দৃষ্টি যতদূর সম্ভব তীক্ষ্ম করে চারপাশে তাকাল। আলো ভালো করে না ফুটলে স্পষ্ট কিছু দেখা যাবে না অবশ্য। কিন্তু ভ্রমর কি জিনিসের কথা বলেছে অমল বুঝতে পারল না।…তার অনুমান, ভ্রমর তাকে কোনো উপহার দেবে। উপহারই হওয়া সম্ভব। মেসোমশাই অমলকে বড়দিনে খুব সুন্দর একটা উপহার দিয়েছেন, ফাউন্টেনপেন; মাসিমা দিয়েছেন একবাক্স রুমাল। কৃষ্ণা তাকে খুব চমৎকার একটা চামড়ার বাঁধানো নোট-বই কিনে দিয়েছে। এ সব উপহার আজ আর-একটু বেলায়, কিংবা দুপুরে অমল হাতে হাতে পাবে। ওরা সবাই যে যা কিনেছে অমলের জন্যে, অমল দেখেছে। ভ্রমর কিছু বলে নি, কিছু দেখায় নি। লুকিয়ে-লুকিয়ে একটা চমকে দেবার মতন কাণ্ড করেছে আর কি!
অমল হাসল মনে-মনে, হেসে ঘরের চারপাশে আবার তাকল। তাড়াতাড়ি কেন এই ঝাপসা অন্ধকার ফরসা হয়ে আসছে না ভেবে সে অধৈর্য হল।
একটা কাজ খুব বোকার মতন হয়ে গেছে অমলের। জুতো জোড়া খুঁজে পায়ে গলিয়ে নিতে নিতে অমল ভাবল, সে বোকার মতন এক কাণ্ড করেছে। ভ্রমর এবং কৃষ্ণার জন্যে তার কিছু কেনা উচিত ছিল। পরশু দিন সন্ধেবেলা বাজারে গিয়ে ওরা সবাই যখন কেনাকাটা করছিল তখন অমলের উচিত ছিল কিছু কেনা। সে কেনে নি। তার কাছে টাকাও ছিল না। বাড়তি তার কাছে যা টাকা আছে তাতে ভাল জিনিস কিছু কেনাও যাবে না। অমল ভেবে দেখেছে, তার টাকা দিয়ে সে যদি একটু, দামী জিনিস কেনে তবে বাড়ি ফেরার সময় বাবাকে চিঠি লিখে কিছু টাকা আনাতে হবে। লিখলে বাবা টাকা পাঠাবেন। গতকাল অমল মনে-মনে বাবাকে চিঠি লেখাই স্থির করে ফেলেছিল, কিন্তু চিঠি লেখার সময় পায় নি, ভ্রমরদের সঙ্গে বাড়ি সাজিয়েছে সমানে। আজ সে আর-একবার তার টাকার হিসাব-পত্র করে নেবে, করে বাবাকে চিঠি লিখবে। অমলের ইচ্ছে, আজ বেলায় কিংবা দুপুরের দিকে চকবাজারে গিয়ে মরদের জন্যে সে উপহার কিনে আনবে।
অমল এগিয়ে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল। বাইরে খুব ঠাণ্ডা, তবু, আজ এই ভোরে অমল জানলাগুলো খুলে দেবে। জানলা খুলতে-খুলতে অমল মেসোমশাই আর মাসিমার কথা ভাবল। ভ্রমর কৃষ্ণা বাবা-মার কাছ থেকে শাড়ি জামা-টামা উপহার পেয়েছে, অমলরা যেমন দূর্গাপুজোর সময় পায়। ব্যাপারটা প্রায় একই রকম। অমল ভেবে পেল না, সে কি ধরনের জিনিস কিনবে ভ্রমরদের জন্যে! ভ্রমরকে সে কি দিতে পারে?
জানলা খুলে দেবার সঙ্গে-সঙ্গে বাইরের ভোর ঘরে পা বাড়িয়ে দিল। সূর্য ওঠে নি। সামনে পুঞ্জীভূত নিবিড় কুয়াশা সাদা ধোঁয়ার মতন; প্রত্যুষের কনকনে বাতাস; গাছপালা ভিজে-ভিজে দেখাচ্ছিল, পাখিদের গলা শোনা যাচ্ছে। ঠাণ্ডার স্পর্শে্ অমল দাঁতে দাঁত চেপে থরথর করে কাঁপল।
বাইরের প্রখর বাতাস এবং আর্দ্র কুয়াশা এসে অমলের নাক মুখে এত ঠাণ্ডা করল যে তার চোখে নাকে জল এসে গেল। জানলার কাছ থেকে সরে এল অমল; অন্য জানলাটাও খুলে দিল। দিয়ে বাইরের চেহারাটা আর একবার দেখল। সকালটা খুব শুদ্র এবং সতেজ দেখাচ্ছিল, কিন্তু রোদ না ওঠায় উজ্জ্বল ও মনোরম লাগছিল না। মাঠ ঘাস গাছপালা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর যেমন দেখায় সেই রকম ভিজে দেখাচ্ছিল।
ঘরে ফরসা ভাব এসে পড়ায় অমল এবার চারপাশে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখল, এ-দেওয়াল থেকে ও-দেওয়াল পর্যন্ত হেঁটে গেল, নীচু, হয়ে-হয়ে লক্ষ করল, কিন্তু ভ্রমরের কথামতন কিছু খুঁজে পেল না। ভ্রমর কি তাহলে ভুলে গেছে রেখে দিতে? অমলের সে-রকম মনে হল না। ভ্রমর এ-ব্যাপারে ঠাট্টা করবে তার সঙ্গে এ-রকম হতে পারে না। অমলের খারাপ লাগছিল। সে দুঃখিত এবং বিমর্ষ বোধ করল। ভ্রমরের রেখে যাওয়া জিনিসটা পাবে এই প্রত্যাশা এবং লোভে সে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে; বরং অমলের এখন মনে হচ্ছিল, এতক্ষণ যেন ইচ্ছে করে সে নিশ্চিত কিছু প্রাপ্তির প্রতীক্ষা করে-করে কোনো সুখ সইছিল।