লেপের তলায় কুণ্ডলী পাকিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে অমল বসার ঘরের দৃশ্যটি কল্পনা করতে-করতে গান শুনছিল। ভ্রমরের চেয়ে কৃষ্ণার গলা চমৎকার। মানাচ্ছিল এই গানে। হিমানীমাসি এবং মেসোমশাই যখন গানে গলা দিচ্ছেন তখন সমস্ত সুরটাই মোটা ও বাঁকাচোরা হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু খারাপ লাগছে না। খারাপ লাগা উচিতও নয়। অমল শুনল ভ্রমররা গাইছে; ‘প্রভাত-বন্দনা লয়ে, যীশু-পদে নত হয়ে, পূজ মন এ-সময়ে যীশু-পদ অনুপম।’
ভ্রমরদের যীশু, জন্মের উৎসব আজ এই হিম-কনকনে ভোর থেকে শুরু হয়। না, আজ ভোর থেকে কেন, কাল রাত থেকেই শুরু হয়েছে। কাল রাত থেকে এ-বাড়ির অন্যরকম চেহারা। খুব যে একটা হইচই চলছে তা নয়, তবে সবাই খুব হাসিখুশী, উৎফুল্ল। বাড়িটা যে-রকম উৎসবের চেহারা নিয়েছে তাতে অমলের স্কুল-কলেজের সরস্বতী পুজোর কথা মনে পড়ছিল। সেই দেবদারুপাতা আর গাঁদাফুল দিয়ে বাড়ির বারান্দা সাজানো, সেই লাল-নীল কাগজের লতা ফুল, সোনালী এবং রুপোলী ঘুরনপাত দিয়ে কারুকর্ম। কাল সন্ধে থেকে মোমবাতি জ্বলছে রাশীকৃত, ঠিক যেন দেওয়ালি। সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে বসার ঘর। ঝাউপাতার কচি-কচি ডাল ভেঙে ফুল গুঁজে তোড়া করেছে ভ্রমররা; দেওয়ালে সেই তোড়া ঝলছে। খৃস্ট-র মেহগনি কাঠের মূর্তিটির দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে আসে; বড়-বড় লাল গোলাপের তোড়া, পেতলের ঝকঝকে মোমদানে মোমবাতি, ধূপ পুড়ছে একপাশে। হিমানীমাসি অতি যত্ন করে দেরাজের মাথার ওপর রাখা মেরীর ছবিটি সাজিয়েছেন। অবিকল প্রতিমা সাজানোর মতন। লতানো গাছের ফুলপাতা দিয়ে যেন চালচিত্রের কাজ করেছেন ছবির পেছনটায়, ছবির তলায় এক থোকা টাটকা ফুল, ছোট-ছোট মোমবাতি, চন্দন ধূপ, ভাঁজ-ভাঙা বাইবেল। বসার ঘরে অন্য পাশে জানলার গা ঘেঁষে ভ্রমর আর কৃষ্ণা কাল সারা-দিন ক্রীশমাস ট্রি সাজিয়েছে। অমলও ছিল। অমল প্রায় প্রত্যেকটি সাজানো-গোছানোতেই ভ্রমরদের সাহায্য করেছে, দালালিও করেছে।
বিছানায় শুয়ে-শুয়ে অমল দু-মুহূর্তে চোখ বন্ধ করে ক্রীশমাস ট্রি এখন কেমন দেখাচ্ছে ভাববার চেষ্টা করল। কাল রাত্তিরে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছিল। একটা টুলের ওপর সাদা চাদর ঢাকা দিয়ে তার ওপর টবে বসানো গাছ। টবের গা সবুজ কাগজে মোড়া। একটি মাত্র সরু, ফার-কাঠি যোগাড় করেছেন হিমানী-মাসি কোথা থেকে যেন, ঝাউ চারায় বেঁধে দিয়েছেন। ঝাউ গাছের সরু, ডালগুলো জরির ফিতে দিয়ে আগাগোড়া মুড়তে হয়েছে, রুপোলী লেসের চুমকি ঝোলাতে হয়েছে পাতার ফাঁকে-ফাঁকে, রাঙতা কেটে ঝিকিমিকি তৈরী করতে হয়েছে, এক কৌটো গায়ে-মাখা পাউডার ছড়িয়ে দিয়েছে কৃষ্ণা গাছের মাথায়, পাতায় কোথাও কোথাও পাউডারের গুঁড়ো ধরে সাদা দেখাচ্ছে। আরও কত কি, সোনালী ফাঁপা বল, চারপাশ গোল করে ঘিরে মোমবাতি সাজানো। সত্যি অপরূপ দেখাচ্ছিল।
কৃষ্ণা বলছিল, এ-রকম সুন্দর করে গাছ সাজানো আগে আর হয় নি কখনও। অমল নিজের কারুকর্মে কৃতিত্ব অনুভব করেছিল, কিন্তু ভ্রমর যখন গাছের মাথায় সুন্দর করে একটি বড় তারা জুড়ে দিল তখন অমল আফসোস করে ভেবেছিল, আহা, এই তারাটুকু সে কেন জুড়ে দিল না। ভ্রমর পরে ঠোঁট টিপে হেসে আড়ালে ফিসফিস করে বলল, তুমি কিচ্ছু, জানো না। বেথেলহেমের তারা এটা।
অমল বিছানার মধ্যে আরও একটু, আলস্য ভাঙল। তার ঘুম ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু শীতের কথা ভেবে গা উঠছিল না। এখনও সূর্য ওঠে নি। বাইরে নিবিড় কুয়াশা হয়ে রয়েছে, ঘন পুঞ্জীভূত সাদা ধোঁয়ার মতন, তুষারকণা জমে আছে শূন্যে, ফরসা সাদা সিক্ত হিম হয়ে আছে জগৎ। শুয়ে-শুয়ে অমল বাইরের অবস্থাটা অনুমান করে নিল, এবং সারা শরীর কুঁকড়ে শুয়ে থাকল।
এ-সময় আবার নতুন করে অমল গান শুনতে পেল। হিমানীমাসি গাইছেন প্রেমের রাজা জনম নিল বেথেল গোশালাতে…।’ অদ্ভুত শোনাল গানটা। হিমানী-মাসির ভাঙা বেখাপ্পা গলায় এই গান একেবারে কীর্তন-কীর্তন লাগছিল। হিমানীমাসির সঙ্গে কে অর্গান বাজাচ্ছে কে জানে! কৃষ্ণা না ভ্রমর!
কয়েক মুহূর্তের জন্যে অমল হঠাৎ যীশুর জন্মের ছবিটি কল্পনা করল। বেথেলহেমের গোশালায় যীশু জন্মেছেন, মেষপালকরা ভিড় করে দেখতে এসেছে। যবপাত্রে কাপড় জড়ানো ছোট যীশু। মেরীর কোলে সন্তান যীশু। মেরীর মাথার পাশে সূর্যের মতন আভা। অমল বস্তুত কল্পনায় যে-ছবিটি দেখল, ভ্রমর কাল সেই ছবি তাকে বই থেকে দেখিয়েছিল। ছবির সঙ্গে তার কল্পনার, কোনো প্রভেদ ঘটল না, কিন্তু সে আশ্চর্য হয়ে অনুভব করল, ভ্রমরও যেন মেষ-পালকদের সঙ্গে মিশে যীশুকে দেখতে গেছে।
হিমানীমাসির গানের সঙ্গে এবার মেসোমশাই এবং ভ্রমররাও যোগ দিয়েছে। কান পেতে আরও একটু শুনল অমল, তারপর উঠে বসল। মনে হল, আর ঘুমোনো উচিত নয়। এ-বাড়িতে সকলেই যখন এই শীতের ভোরে উঠে যীশু, বন্দনা করছে তখন সে জেগে উঠে চুপচাপ শুয়ে কি করবে। বরং উঠে জামা-কাপড় পরে মুখ ধয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসাই ভাল।
কাল রাত্রে বেশী রকম খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল। মেসোমশাই কলেজের চার-পাঁচ বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। যোশী, মূলচাঁদ এঁরাও ছিলেন। বাঙালী প্রফেসার তিনজন; তিনজনেরই নেমন্তন্ন ছিল। একজন এসেছিলেন একেবারে পাকা সাহেব, কম বয়স বলেই মনে হয়; ইংরিজি পড়ান। একটু, মাতাল-মাতাল লাগছিল তাঁকে। হোহো করে হাসছিলেন, কোনো কাজে ভ্রমর কাছে গেলে ডাক-ছিলেন। অমলের খুব খারাপ লাগছিল তাঁকে। ভ্রমর পরে বলেছে, ওঁর নাম মিহিরকুমার সান্যাল। নতুন এসেছেন। একা থাকেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ে।