ভ্রমর অমলকে দেখল। নরম ঘন অথচ সকৌতুক চোখে দেখল কয়েক পলক। তারপর বলল, “ওইটুকু ছেলের আবার বিয়ে!”
‘ওইটুকু’ শব্দটা ভ্রমর যেন ইচ্ছে করেই বলল। একটু আগে অমল সেই মেয়েটার বিয়ের কথা শুনে ‘ওইটুকু মেয়ের’ বিয়ে বলে অবাক হচ্ছিল। ভ্রমর যেন এখন তার শোধ নিল। কেন নিল ভ্রমর বুঝল না।
অমল সামান্য ইতস্তত করল, একটু, বুঝি মুশকিলে পড়ে গেছে। তারপর বলল, “ওইটুকু ছেলে মানে কি? আমার এখন বয়স কত তুমি জানো?”
“উনিশ-টুনিশ হবে।” ভ্রমর গাল ঠোঁট টিপে হাসছিল।
“না স্যার, উনিশ আবার আসছে জন্মে হবে। আমি একুশে চলছি। তোমার মতন নয়।”
“একুশ বছর বয়সে বিয়ে হয় না ছেলেদের।” ভ্রমর চোখ ভর্তি করে হাসছিল। হাসির আভায় তার সারা মুখে টলটল করছিল।
“কে বলছে! এখন বিয়ের কথা আমি বলি নি।” বলতে-বলতে অমল উঠে বসল। তার মুখে দীপ্ত, এবং তার কণ্ঠস্বরে এক ধরনের গাম্ভীর্য রয়েছে। ভ্রমরকে একদৃষ্টে দেখতে-দেখতে অমল বলল, “আমি আরও পরের কথা বলছি। তিন-চার-পাঁচ বছর পরের কথা। আমি যখন অ্যাপ্রেনটিস শেষ করে বেরিয়ে এসেছি, চাকরি করছি। তখন আমি বেশ বড়। তুমিও বড় হয়ে গেছ আরও—তখন…” বলতে-বলতে অমল থেমে গেল; তার মনে হল একেবারে অজানতে তার মুখ দিয়ে কি রকম সব লুকোনো কথা যেন বেরিয়ে গেল। অমল থতমত খেয়ে চুপ; হঠাৎ বোবা; জিব আটকে এল যেন। বোকার মতন এবং অপরাধীর মতন ভ্রমরের মুখের দিকে তাকিয়ে পরমুহূর্তে ভীষণ অস্বস্তিতে মুখ ফিরিয়ে নিল অমল।
ভ্রমর নিঃসাড় হয়ে বসে থাকল। তার চোখের পাতা স্থির, দৃষ্টি স্থির। যেন ঠিক এই মুহূর্তে সে চেতনাকে খুব আবিল অস্পষ্ট করে অনুভব করছিল। বুঝল অথচ বুঝল না কথাটা। নিশ্বাস বন্ধ করে থাকল। তার বুকের কোথাও রক্ত ফুলে উঠল, ভ্রমর ব্যথা অনুভব করল; শীতের ঝাপটা খাওয়ার মতন কাঁপুনি উঠল পিঠের কাছটায়। মুখ নীচু, করল ভ্রমর।
অমল চোখ তুলে ভ্রমরকে দেখল। ভ্রমর কি রাগ করল? অসন্তুষ্ট হল? বুঝতে পারছিল না অমল। নিজের বিশ্রী বোকামির জন্যে তার অনুশোচনা হচ্ছিল। কেন বলতে গেল কথাটা। পরে, আরও পরে, বাড়ি ফিরে গিয়ে যখন ভ্রমরকে চিঠি লিখত, তখন একবার লিখলেই হত।…কিন্তু অমল মিথ্যে বলে নি, সে সত্যিই কাল বিয়ের স্বপ্ন দেখেছে। ভ্রমর বিশ্বাস করবে না, নয়ত তার গা ছুঁয়ে শপথ করে অমল বলতে পারত, সত্যি ভ্রমর, আমি কাল স্বপ্ন দেখেছি বিয়ের। আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। ট্রেনে এসে উঠলাম। রেলগাড়িতে চড়ে যখন বিয়ে করতে যাচ্ছি তখন ত জানা কথা, তোমাদের বাড়ি আসছি।
ভ্রমরের মুখে ক্রমশ যেন রক্ত এসে, লজ্জা এসে, অতিগোপনে ইচ্ছা এবং নিভৃত বাসনাগুলি এসে জমে উঠছিল। নিজের এই আশ্চর্য অনুভূতির সুখ সওয়া গেল না বলেই ভ্রমর তার চোখের পাতা দুটি বন্ধ করে ফেলল। এবং চোখের পাতার তলায় স্বপ্নের ছবির মতন দেখল, সে অমলের স্ত্রী হয়েছে, অমলের স্ত্রী হয়ে সে গির্জা থেকে বেরিয়ে আসছে, সোনার মতন গোধুলি যেন তখন। ভ্রমর স্বপ্নের একটি সুন্দর টুকরোর মতন এই দৃশ্যটি দেখল। অমল তাকে আর কিছু দেখতে দিল না। ভ্রমর অমলের গলা শুনতে পেল। অমল বলছিল, “স্বপ্নটপ্ন স্বপ্নই। কি বল ভ্রমর?”
৯
ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছিল: অমল ভাসা-ভাসা গানের সুর শুনতে পেল। গভীর নিদ্রার মধ্যে মাছি এসে মুখে বসলে যেমন অস্বস্তির সঙ্গে মানুষ সামান্য মুখ সরিয়ে মাছিটা উড়িয়ে দেয়, অমল অনেকটা সেইভাবে শেষরাতের নিবিড় সুপ্তি এবং তৃপ্তি নষ্ট হতে দিতে চাইল না, গানের সুর উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। ঘুমিয়ে পড়ল। আবার জাগল সামান্য পরেই। গানের সুর শুনতে পেল। গলা থেকে লেপ টেনে মাথা ঢাকল, পাশ ফিরল। ঘুমিয়ে পড়ল আবার। অকাতর নিদ্রা আর এল না। কখনও ঘুম, কখনও জাগা-জাগা ভাব। অচেতনা এবং অর্ধ-চেতনার মধ্যে অল্প সময় কাটল। তারপর অমল ক্রমশ জেগে উঠল। চোখের পাতা খুলল মাথার লেপ সরিয়ে।
এখন ঠিক শেষরাত নয়, রাত ফুরিয়ে ভোর হচ্ছে, প্রত্যুষ। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বোঝার উপায় ছিল না, ভোর হয়ে এল। ঘর অন্ধকার: বাইরের জানলা আঁট করে বন্ধ, চারপাশ হিম-কনকন। বিছানার খোলা অংশ ঠাণ্ডা, লেপের পিঠ ঠাণ্ডা, নিশ্বাস নেবার সময় বাতাসও খুব শীতল মনে হচ্ছিল। ভেতর দিকের জানলা খোলা বলে অমল করিডোরে ঈষৎ আলো-আলো ভাব দেখতে পেল। এ-আলো ভোরের ফরসা নয়, বাতির আলো। তবু, অমল বুঝতে পারল, এখন ভোর হয়েছে। ভোর, হচ্ছে বলেই সে আজ গনি শুনতে পাচেছ। ভ্রমর বলেছিল, আজ ভোররাতে তাদের গান শুনে অমলের ঘুম ভাঙবে।
অমল এবার কান পাতল: শুনল—বসার ঘর থেকে ভ্রমর এবং কৃষ্ণার গলা ভেসে আসছে, হিমানীমাসি এবং মেসোমশাইও যেন থেমে-থেমে সেই গানে গলা দিচ্ছেন। সমবেতভাবে ওরা গান গাইছে বলে গানটা বেশ শোনা যাচ্ছে, নয়ত যেত না। মনোযোগ দিয়ে অমল শুনতে লাগল: ‘রজনী প্রভাত হল, জাগো, মন-বিহঙ্গম, জাগরিল সর্বপ্রাণী হেরি ভানু, মনোরম।’…গানের সুর শুনে অমলের কেমন অতি সহজে তাদের দেশের বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল, দেশে বাউল বৈরাগীরা এইভাবে গান গায়; মনে পড়ে গেল, দুর্গা পুজোর আগে-আগে এক-আধদিন খুব ভোরে হঠাৎ মেজদির গলায় এই ধরনের গান শোনা যায় এখনও। শরৎকাল, সাদা কাচের মতন ভোর, শিউলি ফুল এইসব সঙ্গে-সঙ্গে পর-পর মনে, এসে যাবার পর অমল বুঝতে পারল, ভ্রমররা অনেকটা আগমনীর গানের মতন সুর করে ওই গানটা গাইছে: ‘রজনী প্রভাত হল…।’