“চোর মেয়েটার!” অমল অবাক হয়ে তাকাল, ‘ধরতে পেরেছে?”
“আয়া বসে থেকে থেকে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করেছে।”
“কি বলল মেয়েটা?” চুরি করে নি?”
“চুরি করেছে।” ভ্রমর বলল, বলে কয়েক মুহূর্ত, কেমন নীরব থাকল। “আয়া তার কাছ থেকে সব ফেরত নিয়ে এসেছে।”
অমল লক্ষ করে বুঝল, ভ্রমর তার খোয়া-যাওয়া জিনিস ফেরত পাওয়ায় মোটেই খুশী নয়। তার মুখে তৃপ্তি নেই। চোখ দেখে মনে হচ্ছিল, ভ্রমর যেন কিছু বলতে চাইছে। অমল খানিকটা চা খেল। বলল, “তুমি বেঁচে গেলে! মাসিমা যেদিন জানতে পারত তোমায় কাঁদিয়ে ছাড়ত।”
ভ্রমর চা খাচ্ছিল। কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বলল না। শেষে বলল, “আমি আয়াকে বলেছি, সব জিনিস আবার কাল দিয়ে আসতে।”
অমল রীতিমত অবাক হল। তার শার্ট বা পাজামার জন্যে সে বিন্দুমাত্র দুঃখিত ছিল না, কিন্তু চুরি-যাওয়া জিনিস ফেরত পেয়ে আবার সেটা চোরকে পাঠানোর মর্ম সে বুঝছিল না। তার কাছে ব্যাপারটা হেঁয়ালির মতন লাগছিল। অমল হেসে বলল, “তুমি তো আগেও বলেছিলে, আহা বেচারী গরীব, নিয়েছে নিক, শীতে গায়ে দেবে…।” ঠাট্টা এবং রগড় করেই বলেছিল অমল কথাগুলো। স্কার্ফ খোওয়া যাওয়ার পর থেকে মরকে এই ভাবেই ঠাট্টা করে আসছিল সে।
ভ্রমর অমলের হাসিঠাট্টা গায়ে মাখল না। বলল, “মেয়েটা খুব দুঃখী। আয়া বলছিল, বিয়ে হয়েছে ক’মাস আগে। স্বামী কাঠকারখানায় কাজ করত, হাত কেটে ফেলেছে মেশিন-করাতে। চাকরি নেই। মেয়েটা এখানে-ওখানে কাজ করে যা পায় তাতেই চলে…।” ভ্রমর নিশ্বাস ফেলল।
অমল কৌতুহল অনুভব করল, “মেয়েটা ত ওইটুকু! ওর আবার বিয়ে!”
ভ্রমর জবাব দিল না। মেয়েটা আঠার-উনিশ বছরের হবে। অমল কেন ওইটুকু বলল সে বুঝতে পারল না। রোগাটে বলে নাকি?
“হাত কি একেবারে দু-আধখানা হয়ে গেছে লোকটার?” অমল শুধলো।
ভ্রমর আস্তে মাথা নাড়ল। বলল, “একটা আঙুল একেবারে কেটে গেছে, বড় জখম।”
“তা হলে আবার চাকরি পাবে।”
চায়ের কাপ ভ্রমর গোল টেবিলের ওপর সরিয়ে রাখল। সরিয়ে রেখে বিছানায় মাথার দিকে পা চাপা দিয়ে বসল।
অমল কি বলবে ভেবে না পেয়ে হঠাৎ বলল, “তুমি যাই বলল, মেয়েটা খুব হিসেবী চোর, হিসেব করে করে জিনিস নিয়েছে। নিজের জন্যে গরম স্কার্ফ আর তার বরের জন্যে শার্ট পাজামা—।” কথাটা বলে অমল হাসল, কিন্তু হাসতে গিয়েও তার কানে ‘বর’ শব্দ কেন যেন খচখচ করে বিঁধছিল। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে। কি রকম এক অস্বস্তি বোধ করছিল অমল।
ভ্রমর অমলের চোখমুখ লক্ষ করল দু-মুহূর্ত। মনে-মনে কিছু ভাবছিল। মুখে বলল, “ওদের দরকার, ওরা নিক। আমার গরম জিনিস অনেক আছে।”
“তুমি…তোমার কথা আলাদা।” অমল হেসে বলল, “তোমার খুব দয়ামায়া। যীশুর মতন।”
ভ্রমর অসন্তুষ্ট হল। চোখ দিয়ে তিরস্কার করল অমলকে। বলল “ও-রকম কথা আর বলল না।” বলে দু-মুহূর্ত উদাস থেকে ভ্রমর অন্যমনস্ক গলায় আবার বলল, “যীশুর দয়ার শেষ ছিল না। ক্রুশে যাবার সময়ও দয়া তিনি করেছিলেন।”
অমল শেষ চুমুক চা খেল। কাপটা রেখে দিয়ে বলল, “আমি একটু কথা বলি। আমার শার্ট পাজামার জন্যে আমি কেয়ার করি না। মেয়েটা চাইলেই পারত, আমি দিয়ে দিতাম। তুমিও দিয়ে দিতে। ও চুরি করল কেন?”
ভ্রমর চোখে-চোখে তাকিয়ে দেখছিল অমলকে, যেন অমলের কথা ভাল করে বোঝার চেষ্টা করছিল। সামান্য ভেবে ভ্রমর বলল, “চাইতে সাহস হয় নি। সে ভেবেছিল আমরা দেব না।”
“আমরা দিতাম।”
“সকলে দেয় না।” ভ্রমর শান্ত গলায় বলল, বলে দু-মুহূর্ত থেমে বলল আবার, “দুঃখী মানুষকে সবাই যদি দিত তবে তারা দুঃখী থাকত না।”
অমল সঙ্গে-সঙ্গে আর কিছু বলল না। গা হাত ছড়িয়ে আরাম করে বসল, আধশোয়া হয়ে গালে হাত রেখে ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে থাকল। অমল অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিল।
ভ্রমর দু-হাত কোলের ওপর রেখে আঙুল আঙুল জড়িয়ে বলল, “আয়া কাল যখন জিনিসগুলো ফেরত দিয়ে আসবে মেয়েটা খুব খুশী হবে, হবে না?”
“হবে।” অমল ভাবুকের মতন মুখ করল; তারপর মজার গলা করে বলল, “সেই মেয়েটার স্বামী আমার জামাটামা পরে দিব্যি ঘুরে বেড়াবে। যাই বলো ভ্রমর, মেয়েটা নিজের জন্যে একটা মাত্র জিনিস নিয়েছে, শুধু একটা স্কার্ফ, দামী জিনিস, কিন্তু তার হাজবেন্ডের জন্যে ফুল ড্রেস। গরম স্কার্ফটা তার স্বামীও গায়ে পরতে পারে। পারে না—?”
ভ্রমর কোনো জবাব দিল না। অমলের কৌতুক সে লক্ষ করছিল, মনে-মনে ভাবছিল।
কথার জবাব না পেয়ে অমল বলল, “মেয়েরা হাজবেন্ডকে খুব ভালবাসে।” বলে অমল বিজ্ঞের মতন হাসল।
ভ্রমর যেন সামান্য লজ্জা পেয়েছিল। চোখ ফিরিয়ে নিল। তার ছোট পাতলা মুখের কোথাও সঙ্কোচজনিত আড়ষ্টতা ফুটল।
অমল গাল থেকে হাত সরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সিলিং দেখছিল। তার কোমর পর্যন্ত বিছানায়, পা মাটিতে ঝলছে। সিলিং দেখতে-দেখতে অমল বলল, “আমি কাল একটা মজার স্বপ্ন দেখেছি। তোমায় বলি নি। বলতাম ঠিক! এখন বলব?”
ভ্রমর নীরব থাকল। তার বেড়ালটা কখন দরজার সামনে এসেছিল। মুখ বাড়িয়ে বার কয় ডাকল, ভেতরে এল; আবার চলে গেল। যেন বেড়ালটা কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে বাড়িতে।
“আমি স্বপ্নটা বলব, কিন্তু ঠাট্টা করতে পারবে না।” অমল সামান্য মাথা ফিরিয়ে ভ্রমরকে আড়চোখে দেখে নিল। অল্পসময় চুপ করে থেকে হাসির গলায় বলল, “কাল আমি মজার একটা স্বপ্ন দেখলম; একেবারে বিয়ে-ফিয়ের।…আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি।” অমল আর বলতে পারল না, লজ্জায় কৌতুকে এবং এক ধরনের অস্বস্তিতে জিনিসটা আরও হালকা করার জন্যে হেসে উঠল।