রাস্তা এখানে সামান্য নিরিবিলি। ঘোড়ার কদম একই তালে শব্দ করছে, একই ধ্বনিতে তার গলার ঘণ্টা বাজছে। অন্ধকার ঘন করে বোনা, কুয়াশা কী গাঢ়, যেন ওদের আবৃত করে রেখেছে।
অমল বলল, “এমন জিনিস কিন্তু আমি দেখি নি কখনও। আমাদের মধুপুরাতেও বাজি পোড়ানো হয়, নন্বেঙ্গলীরা বেশ পয়সা খরচ করে—কিন্তু এরকম না। এখানের কাণ্ডকারখানাই আলাদা। রাজা-টাজার ব্যাপার…” সামান্য থামল অমল। আবার বলল, “মনে থাকবে। এত সুন্দর সব! তবে ওই জোনাকির বাজিটাই বেস্ট। ওআণ্ডারফুল। কি করে হয় বলো ত?”
সামান্য চুপ করে থেকে ভ্রমর বলল, “কি জানি! যারা বাজি তৈরী করে তারাই জানে।”
“আমি তুবড়ি তৈরী করতে পারি কিন্তু। ছেলেবেলায় দাদার সঙ্গে অনেক করেছি।”
“তুবড়ি করতে পুষ্পারাও পারে।” ভ্রমর যেন গলা চেপে হাসল।
অমল বুঝতে পারল। মুখ ফিরিয়ে ভ্রমরকে দেখল, বলল, “ঠাট্টা করছ?”
“ঠাট্টা না; সত্যি সত্যি বললাম।”
গাড়িটা এবার শহরের এলাকায় এল। মনে হল, হঠাৎ যেন চোখের সামনে আড়াল সরে গেছে। অন্ধকারের মাথার চুল একরাশ আলোর চুমকির মতন দক্ষিণের দিকটা বিন্দু-বিন্দু আলোয় ঝিকমিক করছিল। অমল তাকিয়ে থাকল। একবার মুহূর্তের জন্যে মনে হল, গাড়িটা বোধ হয় ঘুরে ফিরে রাজবাড়ির পিছনের দিকে এসে দাঁড়িয়েছে; পরে বুঝতে পারল, তারা শহরের কাছাকাছি এসে পড়েছে।
ভ্রমর পিছু সরে গদির ওপর ভাল হয়ে বসল অবার। একটু বেশী রকম জড়োসড়ো হল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে সে সামান্য গড়িয়ে গিয়েছিল। অমল তার পাশে। পিছনের গদিতে তারা পা-দানির দিকে মুখ করে বসে আছে। সামনের দিকে বসে টাঙাঅলা গাড়ি চালাচ্ছে। পিছনের দিকটা স্বভাবতই বেশ মাটিমুখো। বসে থাকতে- থাকতে গড়িয়ে যেতে হয় গাড়ি ছুটলে।
“আমার কি রকম লাগছে জান?” অমল আবেগভরে বলল, “ঠিক যেন কোনো মস্ত বড় রেল স্টেশনের কাছাকাছি এসে গিয়েছি। তুমি দেখেছ কখনও? আমি দেখেছি। অন্ধকার—একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার দিয়ে গাড়ি ছুটছে ত ছুটছেই, একরত্তি আলো নেই কোথাও, হঠাৎ এক সময় জানলা দিয়ে চোখে পড়ল দূরে একটা মিটমিটে আলো জলছে, তারপর দেখতে-দেখতে দুটো আলো হল, তিনটে হল, চারটে, ছ’টা, দশটা…বাড়তে-বাড়তে এক সময় দেখি অনেক আলো, মিটমিট করে জ্বলছে দূরে মালার মতন সাজানো…বিউটিফুল লাগে দেখতে।”
ভ্রমর রেলগাড়িতে যাবার কথা ভাবল। তার মনে পড়ল, এবার ছেলেবেলায় মা’র পাশে বসে কোথায় যেন যেতে-যেতে সে কয়েকটা আলো দেখেছিল, আলোগুলো তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছুটছিল।
“আমি একবার আলেয়া দেখেছিলাম।” ভ্রমর বলল।
“আলেয়া! মার্শগ্যাস্…ওকে মার্শগ্যাস্ বলে।”
“কি?”
“এক রকম গ্যাস। জলো স্যাঁতসেঁতে ড্যাম্প জায়গায় এক রকম গ্যাস হয়…” অমল বলল, বলে হঠাৎ চুপ করে গেল, শহরের আলোকমালা কুয়াশার ঝাপসা থেকে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে তার দু-চোখের সবটুকু আগ্রহ কেড়ে নিল।
ভ্রমর আবার রেলগাড়ির কথা ভাবল। মা মারা যাবার পর সে অনেকবার রেলগাড়িতে রাত কাটিয়েছে, কিন্তু কোনো বড় স্টেশনে গাড়ি ঢুকতে দেখে নি। হয়ত সে ঘুমিয়ে থাকত, হয়ত তার জন্যে জানলার দিকের আসন থাকত না। কিংবা খেয়াল করে সে কোনোদিন দেখে নি।
“এরা কিসের বাতি জ্বালায়?” অমল আচমকা শুধলো, “আমাদের মতন তেলের, না মোমবাতির?”
“মোমবাতিই বেশী। কেউ কেউ বাদাম তেল দিয়েও দিয়া জ্বালায়।”
“রাজবাড়িতে ইলেকট্রিক জ্বালিয়েছিল।”
“বড়লোকরা জ্বালায়।”
“তোমরাও বাতি জ্বালাতে পারতে…” অমল হঠাৎ বলল, “সবাই যখন জ্বালায়।”
“আমরা!” ভ্রমর কেমন ইতস্তত করল, চুপ করে থাকল খানিক; শেষে বলল, “মা ভালবাসে না।”
অমল মুখ ফিরিয়ে ভ্রমরকে দেখবার চেষ্টা করল। অন্ধকারে মুখটা ছায়া-ছায়া হয়ে আছে, নাক মুখ চোখ কিছুই দেখা যায় না স্পষ্ট করে, ধূসর ছবির মতনই দেখাচ্ছে ওকে।
টমটমের কোচোআন পায়ে করে এ-সময় ঘন্টি বাজালো। ধাতব মধুর ধ্বনি এই নির্জনে শব্দতরঙ্গ হয়ে ভাসছিল। মনে হল, ছুটন্ত ঘোড়াটা যেন আরও জোর কদম ফেলছে। গাড়িটা থেমে-আসা-দোলনার মতন দুলছিল। সামনের দিকে, চাকার ওপরে গাড়ির গা লাগিয়ে দুপাশে দুটি বাতি জ্বলছে। অতি মৃদু একটু আলোর আভা ভ্রমরের মাথার দিকে মাখানো আছে, কেমন একটা ছায়া ছুটছে রাস্তা ধরে।
অমলের শীত ধরেছিল এবার। সত্য বেশ হিম পড়ছে। গলা নাক চুলকে এখন কেমন জ্বালা-জ্বালা লাগছে। নাক টানল আবার অমল। আকাশভরা অমাবস্যা, তারা ফুটে আছে, কুয়াশার গুঁড়ো গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে যেন।
“বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।” অমল বলল, “সর্দি ধরে গেল।”
ভ্রমর আরও একটু স্কার্ফ দিল অমলের কোল ঘেঁষে, হাত ঢেকে বসতে বলল মৃদু গলায়।
“তোমার শীত করছে না?” অমল শুধলো।
“করছে।”
“আমার হাত দুটো কনকন করছে। তোমার দেখি—” অমল হাত বাড়িয়ে ভ্রমরের একটি হাত ছুঁয়ে দেখতে গেল। দেখে অবাক হল। “তোমার হাত এত গরম কেন?”
“এই রকমই।”
অমল মনে করতে পারল না ভ্রমরকে নিয়ে রাজ-ময়দান থেকে বেরোবার সময় ওর হাত এত গরম লেগেছিল কি না! বোধ হয় লেগেছিল, তেমন খেয়াল করে নি। ভ্রমরের হাতের উল্টো পিঠ এবং মণিবন্ধ স্পর্শ করে অমল সঠিক ভাবে এই উষ্ণতার অর্থ বোঝার চেষ্টা করল।
“তোমার জ্বর হয়েছে, ভ্রমর। হাত বেশ গরম।”