স্ট্যান্ড ডিঙিয়ে, বেড়া টপকে, মাঠের এ-পাশ ও-পাশ থেকে বাচ্চা-বাচ্চা, মেয়ে ও ছেলেরা, এমন কি কত বুড়োবুড়ীও মহানন্দে হই-হট্টগোল তুলে সেই জোনাকি কুড়োতে মাঠের মধ্যে গেল।
ছুটোছুটি হুড়োহুড়ি চলতে থাকল সমানে। কত লোক হাসছে, গায়ে-গায়ে পড়ছে, ডাকছে নাম ধরে, আর ছেলেমানুষের মতন সেই জোনাকি ধরার খেলায় মত্ত হয়ে সারা মাঠ ছুটেছে।
অমলেরও ইচ্ছা হয়েছিল লাফ মেরে মাঠের মধ্যে নেমে পড়ে। কিন্তু তার সামনে পিছনে যে অট্টরোল হুড়োহুড়ি, তার মধ্য দিয়ে পথ করে নেওয়া অমলের সাধ্যাতীত। ইচ্ছা এবং বাসনা সত্ত্বেও অমল বসে থাকল। বসে-বসে ওই আশ্চর্য ও চমৎকার দৃশ্যটি বিমুগ্ধ চিত্তে দেখতে লাগল।
অবশেষে মাঠ ও গাছভরা জোনাকিরা রাজ-ময়দান অন্ধকার করে আবার চলে গেল।
দেওয়ালির বাজি পোড়ানো শেষ হয়ে গিয়েছিল। ভিড় জমেছিল বেশ। প্রথম দিকে ওরা কেউ উঠল না, বসে থাকল। যোশীদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা চলে যাবার সময় ভ্রমরকে বলল, হিম পড়ছে, বেশীক্ষণ আর বসে থেকো না।
হিম পড়ছিল। ভিড়ের মধ্যে বসে বাজি পোড়ানো দেখতে-দেখতে এখানকার শেষ কার্তিকের গায়ে-লাগা শীত তেমন অনুভব করা যায় নি। ভিড় পাতলা হয়ে এলে অমল বেশ ঠাণ্ডা লাগছে বুঝতে পারল। উঠল; বলল, “চলো।”
পাতলা রকমের ভিড়ের মধ্যে দিয়ে অমল ভ্রমরের উষ্ণ হাত ধরে ধরেই হাঁটছিল। হাতে হাত ধরে থাকার মতন যদিও ভিড় নেই, তবু ভ্রমরকে লোকজন, অন্ধকার এবং কাঠকুটো পড়ে থাকা জায়গা দিয়ে একা-একা হেঁটে যেতে দিতে অমলের ইচ্ছে হল না। ভ্রমরের বাঁ পা একটু, ছোটো, মোটা গোড়ালিঅলা জুতো পরে কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটে। দু-পায়ে যার সমান জোর নেই, তাকে হাতে ধরে নিয়ে যাওয়া উচিত, কোথাও কিছুতে পা বেধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে পারে।
মাঠের বাইরে টাঙার ভিড়। আনন্দমোহনকে দেখা যাচ্ছিল না; কৃষ্ণাকেও নয়। টমটম ভাড়া করে যে যার চলে যাচ্ছিল, অনেকে হেঁটেই বাড়ি ফিরছে। মেলাভাঙা ভিড়ের মতনই দেখাচ্ছিল দৃশ্যটা।
“মেসোমশাই কোথাও নেই।” অমল যতটা সম্ভব চারপাশ দেখতে-দেখতে বলল; তার শীত করছিল এবার। জামার তলায় যদিও সোয়েটার আছে, তবু ঠাণ্ডা লাগছিল।
ভ্রমর দেখছিল একে-একে সবাই চলে যাচ্ছে, টাঙার দিকটা খালি হয়ে আসছে। বলল, “বাবা হয়ত গল্প করছেন, পরে যাবেন।”
“আমরা তা হলে বাড়ি ফিরি। কি বলো?”
মাথা নাড়ল ভ্রমর, বাড়ি ফেরাই ভাল।
টাঙা জুটিয়ে অমল ভ্রমরকে গাড়িতে তুলল, তারপর নিজে উঠে বসল।
“মোতি রোড; কালেজ—।” ভ্রমর টাঙাঅলাকে পথ বলে দিল। টাঙাঅলা ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলতে লাগল।
এই জায়গাটা শহরের প্রায় প্রত্যন্ত। চওড়া রাস্তা, বেশ ছিমছাম; বাতি আছে দূর দূর; গাছগাছালি সার করে দু-পাশে দাঁড়িয়ে—ঘোড়ার গলার ঘন্টি বাজছিল ঝুমঝুম করে, মাঝে মাঝে পা দিয়ে ঘণ্টির মাথা টিপে গাড়ির ঘন্টি বাজিয়ে পথ করে নিচ্ছিল কোচোআন। রাস্তায় জটলা জটলা ভিড়, দু-চারজনের ছোট ছোট দলও আছে। বাজি পোড়ানো দেখে বাড়ি ফিরছে সবাই। হুস-হাস করে সাইকেল চলে যাচ্ছে, দু-একটি মোটর গাড়িও; বাকি যা যাচ্ছে সবই টমটম।
রাস্তায় এসে অমল প্রথমে স্পষ্ট করে কুয়াশা দেখতে পেল। এত কুয়াশা হয়েছে কখন কে জানে! হয়ত বহুক্ষণই এই রকম কুয়াশা জমে আছে, অমলের খেয়াল হয় নি। শীতটাও বেশ গায়ে লাগছে। মাথা হাত ঠাণ্ডা, কনকন করছিল। নাক এবং গলার মধ্যে জ্বালা-জ্বালা লাগল একটু। অমল পকেট থেকে রুমাল বের করে নাক মুছল বার কয়েক।
“ঠাণ্ডা লাগল?” ভ্রমর শুধলো।
“না, লাগে নি। গলার মধ্যে চলকোচ্ছিল কেমন!”
“তখনই বলেছিলাম কোট নিতে মাফলার নিতে…” ভ্রমর বলল, “এখানে দেওয়ালির অনেক আগেই শীত শুরু হয়ে যায়।”
“এবারে কি বেশী শীত?”
“না। এই রকমই।”
“আমার কিন্তু ক’দিনের মধ্যে আজই যেন বেশী মনে হচ্ছে।”
ভ্রমর জলের ঢোক গেলার মতন শব্দ করে হাসল একটু। বলল, “আজ যে ঘরের বাইরে, তাই…।”
কথাটা হয়ত ঠিকই বলেছে ভ্রমর। অমল এখানে এসেছে আজ আট দিন; না, আট দিন নয়, ন’দিন। এসে পর্যন্ত সন্ধের পর বাড়ির বাইরে থাকে নি; আজই যা দেওয়ালি আর বাজি পোড়ানো দেখতে বেরিয়েছে।
অমল বলল, “আমরা শহরের মধ্যে দিয়ে যাব না?”
“যাব। চকের পাশ দিয়ে চলে যাব।”
“তা হলে ত দেওয়ালি দেখতে পাব?”
“পাব।…আজ এরা খুব হইচই করে।”
“করুক, বছরে মাত্র একটা দিন। আমরাও করি; আমরা ত চার দিন ধরে করি, এরা সে জায়গায় একটা কি দুটো দিন।” অমল এমনভাবে বলল, যেন উৎসব করার ঢালাও অনুমতি দিয়ে রাখল লোকগুলোকে।
ভ্রমরের গায়ে পশমের একটা স্কার্ফ ছিল। নীল রঙের। অন্ধকারে ওটা কালো মনে হচ্ছিল। ভ্রমর অমলের দিকে একটু স্কার্ফ দিল। বলল, “এখানেও দুর্গা পুজো হয়।”
“এখানেও…! কারা করে?”
“বাঙালীরা।”
“বাব্বা, এত বাঙালী আছে এখানে?” অমল বেশ অবাক।
“অনেক নেই, একশো-ট্যাকশো আছে—। বাবাদের কলেজে আছে ক’জন, সারভে অফিসে জনাকয়েক, ডাক্তার আছে একজন, মিউজিয়ামে একজন…”
“পঁচিশজনও হল না।” অমল হাসল, “তুমি অঙ্কে একেবারে সরস্বতী।”
ভ্রমর যেন প্রথমে বুঝল না, পরে বুঝতে পেরে ঈষৎ অপ্রস্তুত হল। বলল, “আমি সকলের কথা বলি নি, ক’জনের কথা বললাম। কত আছে আরও, আমি চিনি না।”