দোয়াত কলম আনা হইল! শ্বশুরের হুকুমে আমেনা কাগজ-কলম লইয়া লিখিল :
বর্ধমান
বখেদমতেষু,
অসংখ্য আদাব জানিবেন। মায়ের ও আপনার কোনো সংবাদ না পাইয়া বড় চিন্তিত আছি। আমি বোধ হয় খুব সুখে আছি৷এই আপনাদের বিশ্বাস।তাই এই দীর্ঘ সময়ে আমার কাছে, একখানা পত্র লেখাও দরকার মনে করেন নি।
সত্য কথা বলিতে কি৷আমি সুখেই আছি! শ্বশুর-শাশুড়ির অসীম দয়া ও মমতায় আমি ভাগ্যবতী। তা হলেও আমার ইচ্ছা করে এখানকার আমার অতি প্রিয়তম আত্মীয়দের সংবাদ আপনারা লয়েন। আমি খুব সুখে আছি, আমার জন্য একটুও চিন্তা করিবেন না।
আপনার ফিদবী।
আমেনা।
পত্রখানি আমেনার হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া নজির পড়িয়া দেখিল। উহার প্রতি ছত্র নজিরের প্রতিহিংসাপরায়ণ চিত্তকে আরো জ্বালাময় করিয়া তুলিল। সে কী চায়? সে চায়। তার পুত্রবধুর দুঃখ তাহার আত্মীয়-স্বজনের মনে ও মুখে কালি ফুটাইয়া তোলে এবং এই করিয়া সে তার মনে সান্ত্বনা লাভ করে।
নজির চিঠিখানা শতভাগে ফাড়িয়া ফেলিল। সে ইচ্ছা করিল, সে নিজেই একখানা চিঠি লিখিবে। তাতে থাকিবে আমেনার দুঃখ-দুর্গতির কথা।
সেই দিন হইতে আমেনাকে একখানা পুরোনো সেঁতসেঁতে কোণার ঘরে বাস করিতে দেওয়া হইল। বাপের বাড়ি হইতে সে কোনো বিছানা আনে নাই, সেই কথা জানাইয়া তাহাকে বিছানা দেওয়া হইল একখানা পুরোনো ছালা। আমেনা ভিখারিনী–সে মেয়ে মানুষ।
সেদিন উঠানে বসিয়া দাসীদের সঙ্গে আমেনা মাছ কুটিতেছিল। দাসীদের জন্য এক এক খানা আসন দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু আমেনা খালি মাটিতেই বসিয়া কাজ করিতেছিল।
আমেনার শাশুড়ি তাহাকে বলিলেন–“কুয়া থেকে ঘড়া দশেক পানি তুলে নিয়ে আয়। সেখানে এখন কেউ নাই।”
আমেনা বাক্য ব্যয় না করিয়া ঘড়া লইয়া পানি আনিতে গেল।
দেউড়ীর ধারেই গোয়াল-ঘর। দূরে বাড়ির চাকর মধু গোয়ালঘরে গাই দুটিকে জাব ঠিক করিয়া দিতেছিল।
আমেনা মাথায় ঘোমটা দিয়া খোদাকে ধন্যবাদ দিয়া পানি তুলিতে লাগিল।
এক ঘড়া-দুই-ঘড়া-চার ঘড়া-আমেনা আর পারে না। আঙুল ফাটিয়া তাহার রক্ত বাহির হইয়া পড়িল।
মধু দূর হইতে লক্ষ্য করিতেছিল–এই অবহেলিতা মলিন বসনা বৌটির অবস্থা। কৃষক হইলেও সহানুভূতির আবেগে স্থান কার ও পাত্র বিবেচনা না কারিয়া সে দৌড়াইয়া আসিয়া আমেনার হাত হইতে রশি লইয়া কহিল–ভাবিজান, আপনি সরুন, পানি আমি তুলে দিচ্ছি–এতগুলি চাকরানী থাকতে আপনার এই কষ্ট!
আহা! মধুর একটা সেয়ানা ভগ্নি এই সেদিন অনাদর ও অবহেলায় শ্বশুড় বাড়িতে প্রাণত্যাগ করেছিল।
দেউড়ীর ওধার হইতে কে একজন বলিয়া উঠিল–“আকাশ থেকে বজ্রাঘাত হোক! ওমা, সে কি! ছিঃ! ছিঃ! মধু বৌয়ের হাত ধরে!”
সত্যিই যেন বজ্রাঘাত হইল–আমেনা মূৰ্হিতা হইয়া কাদা ও পানির মধ্যে পড়িয়া গেল। মধু ভীত হইয়া কাহাকেও কিছু না বরিয়া সে স্থান হইতে পলায়ন করিল।
.
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
একটি সুন্দর-আকৃতি দরবেশ কোথা হইতে আজ সাতদিন হইল থানার সম্মুখে আড্ডা লইয়াছেন। দরবেশ কাহারও সঙ্গে কথা বলেন না। খোরশেদ অনেক বার চেষ্টা করিয়াছে। তাঁহার সহিত কথা বলে, কিন্তু বারে বারেই সে বিফল মনোরথ হইয়াছে।
নিশীথকালে একবার কথা বলিতে চেষ্টা করিয়া দেখিবার জন্য খোরশেদ এই সময়ে তাঁহার কাছে আসিয়াছে।
সে সন্তর্পণে দরবেশের সম্মুখে যাইয়া বসিল। ফকির তখন চোখ বুজিয়া তসবি গণিতেছিলেন।
খুব শঙ্কার সহিত খোরশেদ করজোড়ে ফকিরের সম্মুখে বসিয়া থাকিল। একটু একটু বাতাস থাকিয়া থাকিয়া সাধুর অগ্নিকুণ্ডকে দ্যুতিময় করিয়া তুলিতেছিল।
দূরে বারান্দায় একটা সিপাই এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।
প্রায় এক ঘণ্টা অতীত হইলে–ফকির ধীরে ধীরে চোখ খুলিয়া দেখিলেন, একটা যুবক তাঁহার সম্মুখে উপবিষ্ট।
খোরশেদ ফকিরের পদধূলি লইয়া কহিল–শাহ্ সাহেব, একটা নিবেদন।
খোরশেদকে অবাক করিয়া ফকির জিজ্ঞাসা করিলেন কি নিবেদন বাবা।
খোরশেদ আহ্লাদিত হইয়া কহিলেন–এই পাপীর সঙ্গে আপনি কথা বল্লেন! এ আপনার অনুগ্রহ।
ফকির আবার জিজ্ঞাসা করিলেন–কী কথা বলতে চাও?
খোরশেদ–বলতে ভয় হয়, অনুমতি দিলে বলতে পারি।
ফকির–আমাকে কি অনুপযুক্ত পাত্র বলে তোমার সন্দেহ হচ্ছে?
খোরশেদ–না, না, ওকথা বলে এ অধমকে লজ্জিত কচ্ছেন কেন?
ফকির–তবে বল।
খোরশেদ-জীবনের কোনো এক সময়ে একটি মেয়েকে আমি ভালবাসি। তাকে আমি পেতে চাই।
ফকির–আমি কী কত্তে পরি? খোরশেদ–আপনি দোয়া করলে আমার মোকসেদ হসিল হতে পারে।
ফকির-ফকিরদের কাজ মানুষকে উন্নত পথে টেনে আনা। প্রেম অপার্থিব জিনিস হলেও ফকিদের কাছে এই সব কাজে সাহয্য চাওয়া কর্তব্য নহে। খোদার কালাম এই সমস্ত কার্যে ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। যাকে ভালবাসতে এখনও তাকে ভালবাস–কেউ। তোমাকে নিষেধ করছে না। এই উদ্দেশ্যে কোনো অসাধারণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করার দরকার নাই।
বিধাতার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার বঞ্চিতকে লাভ করবে, নইলে নয়। পর স্ত্রীর রূপলাবণ্যের কথা চিন্তা করিয়া ব্যভিচার দোষে আত্মাকে কলঙ্কিত করিও না। তোমার বাঞ্ছিতা যদি অপরের ভার্যা হয়ে থাকে তবে বিশ্বাস করিও সে তারই পত্নী হবার জন্যে মতে এসেছিল–তোমার জন্য নহে; তুমি ভুল করে পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়েছিলে।