- বইয়ের নামঃ রানী হেলেন
- লেখকের নামঃ লুৎফর রহমান
- প্রকাশনাঃ জোনাকী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. গ্রীস দেশে স্পার্থা শহরে
০১.
অনেক কাল আগে গ্রীস দেশে স্পার্থা শহরে এক রাজা ছিলেন। তার নাম তানীরজ। হেলেন নামে তার এক মেয়ে ছিল। হেলেন বড় খুবসুরত মেয়ে, একেবারে চাঁদের মতো। চুলগুলি মেঘের মতো কালো আর পা পর্যন্ত লম্বা। মেয়ের রূপের প্রশংসা সমস্ত গ্রিসে ছড়িয়ে পড়লো,–স্পার্থা শহর তো নয়, গ্রিস দেশে আর অমন সুন্দরী মেয়ে দ্বিতীয় ছিল না।
ক্রমে মেয়ে সেয়ানা হলেন। নানা দেশ থেকে রাজপুত্রেরা এসে হেলেনকে বিয়ে করবার জন্য রাজার কাছে দরবার করা শুরু করলেন। সকলেই রাজাকে বললেন–“কন্যাটি আমাকেই দিন; যদি না দেন তা হলে যাকে দেবেন; তার নিস্তার নেই, তাকে খুন করবো, কন্যার মা-বাবাকেও ছাড়বো না।”
রাজা একে বুড়ো তার উপর বড় দুর্বল। তিনি মহাবিপদে পড়লেন। শেষে এক মতলব এঁটে সব রাজপুত্রকে ডেকে একদিন বললেন, বাপু সকল, তোমরা এক কাজ করো, এতে তোমাদের সকলের পক্ষেই সুবিধা হবে। আমার মেয়েকে যদি বিয়ে করতে চাও, তা হলে তোমাদেরকে একরার করতে হবে। একরারটি হচ্ছে, যে হেলেনকে বিয়ে করবে তার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না, কেউ ক্ষতি করতে এলে সকলে মিলে তাকে জব্দ করবে! সকলেই প্রতিজ্ঞা করলেন–হ্যাঁ, তাই হবে।
তারপর রাজা মেয়েকে বললেন, মা, এখন তুমি, জের পছন্দমতো বর খুঁজে নাও। মেয়ে এগামেমননের ভাই মেলাসকে স্বামীরূপে গ্রহণ করেন। এগামেমনন লোকটা কে তা জান? ইনি হচ্ছেন হেলেনের ভগ্নীপতি। এর সঙ্গে হেলেনের বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল।
মেয়ের বিয়ের পর জামাইকে রাজ্য দিয়ে বুড়ো রাজা বিশ্রাম করতে লাগলেন।
গ্রিসের পূর্ব দিকে সমুদ্র পাড়ে এশিয়া মাইনরে ত্রয় বলে এক নগর ছিল। এখানকার রাজা ছিলেন প্রিয়াম। প্রিয়াম বড় জবরদস্ত রাজা–ঘর বাড়ি দালান কোঠা যে কত তার ছিল, তার ইয়ত্তা নেই। পেরিস বলে তার এক ছেলে হলে, রানী স্বপ্ন দেখলেন যেন শিশু পেরিস একটা জ্বালানো মশাল নিয়ে আকাশ থেকে নেমে এসেছে, সেই মশাল দিয়ে সারা। ত্রয় শহরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে।
রানী স্বপ্ন দেখে ভীত হয়ে উঠলেন, রাজাও রানীর মুখে স্বপ্নের কথা শুনলেন। শুনে বললেন, এই ছেলে দেশে মহাবিপদ টেনে আনবে, অতএব একে মেরে ফেলাই ভালো। ছেলে কি না, গলা টিপে মেরে ফেলতে রাজা-রানীর বড় মায়া হল, শেষে রানী শিশুকে দূরে ইদা নামক পাহাড়ের জঙ্গলে রেখে এলেন।
খোদার মরজি! একটা গরিব মানুষ সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। সে মেষ চরিয়ে খেতো। সে শুনতে পেলো, বনের মধ্যে যেন একটা শিশু মিহিসুরে পিপি করে কাঁদছে। একটু এগিয়ে লোকটা দেখলে, একটা সোনার বরণ শিশু কাঁটার মধ্যে পড়ে কাঁদছে। তার বড় মায়া হল, বুকে করে তুলে এনে সে শিশুকে মানুষ করতে লাগলো। গরিব মানুষটা শিশুর নাম রাখলো পেরিস। পেরিস ক্ৰমে বড় হতে লাগলেন। বেড়ে বেড়ে শেষে যুবক হয়ে উঠলেন। পেরিস যে রাজার ছেলে এ কথা তিনি বা কেউ জানলো না। তিনি আর কী করবেন?–পাহাড়ে মেষ চরাতেন আর বাঁশি বাজিয়ে গান করতেন। তাঁর শ্রী দেখে পাহাড়ের মাঝেকার একটা পরী তাকে ভালবাসতে লাগলো–এই পরীটার নাম ওনোন।
তোমরা পরীর কথা অনেকে শুনেছ, কেমন? একবার স্পার্থা নগরের কাছে এক যুবক এক পরীকে খাঁচায় আটক করে বললে, আমাকে যদি বিয়ে না কর তা হলে কিছুতেই তোমাকে ছাড়ছি নে। পরীটা আর কি করবে, শেষে রাজি হল। এমনটি আর কখনও হয় নি–পরীর সঙ্গে মানুষের বিয়ে! বিয়ের উৎসবে হাজার হাজার জিন-পরী এসে যোগ দিলেন। কত মানুষ এসে সভার আনন্দ বর্ধন করতে লাগলেন। খানা-মজলীশে কত মিঠাই, কত ছানা, কত দই, কত হালুয়া, কত পোলাও-কোর্মা সে আর কী বলবো।
পরীদের রাজার তিনটি মেয়েও সে সভায় এসেছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন হেরা, এথেন এবং এফ্রোদাইত।
একটা শয়তান জিন, তার নাম এরিস, সে কেবল সকলের মাঝে ঝগড়া বাঁধিয়ে। বেড়াতো। তাকে কেউ ভালবাসতো না। তাকে এই উৎসবে দাওয়াত করা হয় নি বলে সে। মনে মনে ঠিক করলে, বেশ, মজা দেখাচ্ছি।
সে রাজার তিনটি মেয়ের সামনে একটি সোনার আতা ফেলে দিল–আতায় লেখা ছিলো, যে সকলের চেয়ে দেখতে ভালো–সে-ই এই আতা পাবে। তিন বোনের প্রত্যেকেই আতা দাবি করলেন। শেষে রাজার তিন মেয়ের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী এই নিয়ে মহাঝগড়া আর দলাদলি আরম্ভ হল। তিন বোনের বাপ ঝগড়া থামাবার জন্য বললেন, তোমরা ইদা পাহাড়ে রাজা প্রিয়ামের ছেলে পেরিসের কাছে যাও, সে যাকে অধিক সুন্দরী বলবে, তারই জয় হবে–সে-ই আতা পাবে।
এদিকে ইদা পাহাড়ে যুবক পেরিস গাছের ছায়ায় ঘুমোচ্ছিলেন।দূরে বনের আড়ালে পরী বলিকা ওনোন দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেষগুলি নিঝরের পাশে একটার উপর আর একটা গা রেখে আরাম করছিল। এমন সময় হঠাৎ পেরিস চোখ খুলে দেখলেন, পরী রাজার তিনটি মেয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। সমস্ত বনভূমি তাঁদের আলোক-পুলকে পূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্রথমেই হেরা মুখ খুলে বললেন–দেখ, পেরিস, আমাদের মধ্যে কে বেশি সুন্দরী তাই তোমাকে বিচার করতে হবে, প্রামণস্বরূপ তাকে এই সোনার আতাটি দেবে। তুমি যে রাজা প্রিয়ামের ছেলে তা হয়তো জান না। আমি তোমাকে জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠরাজা করবো, পৃথিবীর সকল রাজা তোমার কাছে কৃপা ভিক্ষা করবে, অসংখ্য গাড়ি ঘোড়া হাতি সৈন্য তোমার হবে। হাজার হাজার সৈন্য, সেনাপতির মালিক হবে তুমি। শস্য ভরা মাঠ, কত গিরি, দুর্গ, কত মহিষ, গাভী, কত পাল দেওয়া জাহাজ তোমাকে দেবো; জীবনে তোমার সুখের অবধি থাকবে না। এখন যদি বুদ্ধিমান হও তবে আমাকে অসন্তুষ্ট করো না, সোনার আতাটি আমাকেই দাও।
এথেন বললেন–দেখ পেরিস, হেরার কথা শুনো না, আতাটি আমাকে দাও। আমি তোমাকে জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবার সুবিধা করে দেব। তোমার পুণ্য জীবনের গৌরব পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। ছার ঐশ্বর্যের লোভ করো না, সাধুর জীবনের তুলনায় রাজার। জীবনের কোনো মূল্য নেই।
ওনোন ফিস ফিস্ করে পেরিসের কানে বলতে যাচ্ছিল–এঁকেই আতাটি দাও–অমনি এফ্রোদাইত বললেন–আমাকে যদি সোনার আতাটি দাও তা হলে জগতের মধ্যে। শ্রেষ্ঠ সুন্দরী মেয়ে তোমাকে ভালবাসবে। সকলের কথাই তুমি শুনেছ, এখন যা ইচ্ছে কর।
পেরিস এফ্রোদাইতকে আতাটি দিলেন। তার পর পরীরা চলে গেলেন।
পেরিস যখন বুঝতে পারলেন তিনি রাজার ছেলে, তখন আর তার সে জায়গা ভালো লাগলো না। পরী বালিকা ওনোনকে তিনি ভুলে গেলেন। একেবারে রাজা প্রিয়ামের কাছে। এসে পেরিস নিজের পরিচয় দিলেন। হাজার হলেও ছেলে–রাজা রানী সন্তানকে বুকে তুলে নিলেন। তার পর সুখে দিন কাটাতে লাগলো, কিন্তু একটা চিন্তা পেরিসকে কষ্ট দিতে থাকলো–কি করে তিনি সেই সুন্দরী কন্যাটিকে খুঁজে বের করবেন। একদিন পেরিস বাপের কাছে বললেন–বাপজান, নানা দেশ ও নগর দেখবার সাধ আমার হয়েছে। আমি জাহাজে চড়ে দেশ ভ্রমণে যাব। কন্যা খুঁজতে বের হওয়াই তার আসল ইচ্ছা। অবিলম্বে রাজার হুকুমে বড় বড় জাহাজ তৈরি হতে লাগলো।
জাহাজ তৈরি হলে পেরিস যাত্রা করবেন, এমন সময় তার ভাই ও বোন বাধা দিয়ে বললেন–ভাইজান, দেশ দেখা দিয়ে কাজ নেই, আমাদের মনে হচ্ছে তোমার এই যাত্রা অনেক অশুভের কারণ হবে। অতএব এই মন্দ কাজ করো না। পেরিস হেসে বললেন তোমরা পাগল!
তার পর একদিন বড় বড় জাহাজে পাল খাঁটিয়ে মহা আড়ম্বরে এজিয়ন সাগরের বুকের উপর পেরিস জাহাজ ভাসিয়ে দিলেন।
কত দ্বীপ, কত নীল জল অতিক্রম করে পেরিস স্পার্থার রাজা মেনেলাসের রাজ্যে এসে উপস্থিত হলেন। অতিথিকে অভ্যর্থনা করে বাড়িতে আনবার জন্যে রাজা মেনেলাস পত্নী ও পরিজনসহ পেরিসের জাহাজের কাছে এসে বললেন–আসুন যুবরাজ, আমাদের। বাড়িতে দুটি নুন-ভাত খাবেন। পেরিস খুব খুশি হয়ে মেনেলাসের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে এলেন। অতিথির আদর-আপ্যায়নের জন্য মেনেলাসের প্রাসাদে দিবা-রাত্রি পান-ভোজন চলতে লাগলো। রানী হেলেন নিজ হস্তে সকলের পরিবেশন করতে লাগলেন।
পেরিস দেখলে রানী হেলেনের মতো সুন্দরী ত্রিভুবনে আর নেই। ভাবলেন, এই তো সেই কনে, যার কথা এফ্রোদাইত বলেছিলেন, কিন্তু কী করে একে হাত করা যায়? হেলেন যে আর এক জনের পত্নী।
কয়েকদিনের জন্যে মেনেলাস অতিথিকে রানীর কাছে রেখে ক্রেতা দ্বীপে একটু বেড়াতে গেলেন। ব্যস, সুযোগ পেয়ে পেরিস রানীকে বললেন–রানী, আমার সঙ্গে চল, ত্রয় নগরে তোমাকে নিয়ে যাই। বিশ্বাসঘাতক রানী বললেন–বেশ চল।
রাজার অনুপস্থিতিতে রানীকে নিয়ে পেরিস ত্রয় নগর অভিমুখে যাত্রা করলেন।
০২. ঈদা পাহাড়ের যুবরাজ পেরিস পরী
সেই যে ঈদা পাহাড়ের যুবরাজ পেরিস পরী এথেন ও হেরার কথা শুনলেন না–ফুটফুটে বৌকে পাবার লোভে তাঁর মতিভ্রম হল–এতে এথেন ও হেরার বড় রাগ হল।
এইবার হেরা ঝগড়ার ঠাকুর এরিসকে দিয়ে দ্রুত মেনেলাসের কাছে সংবাদ পাঠিয়ে দিলেন–দুষ্ট পেরিস তার বৌকে নিয়ে পালিয়েছে, শিগগির বাড়ি এসে যা হয় ব্যবস্থা করুন।
মেনেলাস এই দারুণ সংবাদ পেয়ে শোকে অস্থির হলেন। অতিথির বিশ্বাসঘাতকতা। স্মরণ করে সংসারকে নিতান্ত খারাপ স্থান বলে তাঁর মনে হতে লাগলো। অবিলম্বে বাড়ি ফিরে এসে দেখলেন–ঘর-দোর দালান-কোঠা সব খালি। পত্নী হেলেন নাই।
কি যে ব্যথা তাঁর মনকে কাঁদিয়ে তুললে তা আর বলে কী হবে? আহা, তাঁর জীবনের সঙ্গিনী কী করে তাকে ফেলে চলে গেল? মেনেলাস ভাবলেন–এ সংসারে আমার কেউ নেই। বৃথা আমার টাকা-কড়ি।
দুঃখের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মনে খুব ক্রোধ হল। দারুণ উত্তেজনায় তাঁর চোখ রক্তময় হল–শরীরের প্রত্যেক পেশী ভীষণ প্রতিশোধের জন্য গরম হয়ে উঠলো। কোথায় সেই নেমকহারাম, শয়তান পেরিস–সে যে বহু দূরে–সেই অকূল সাগরের পারে।
হোক সাগরের পারে। তাঁকে বিনাশ করে হেলেনকে ফিরিয়ে আনতে হবে। যে শয়তান তার বুকে এমনি করে আগুন জ্বেলেছে তার কলিজার রক্ত দিয়ে স্নান করতে হবে।
রাগে দুঃখে মেনেলাস যেন পাগল হয় উঠলেন। তোমরা কি মেনেলাসের মনের অবস্থাটা ঠিক বুঝতে পাচ্ছ?
কত সুখ, কত প্রেমে মেনেলাস হেলেনের সঙ্গে এতকাল বাস করেছেন! এতটুকু অবিশ্বাস তার মনে কোনোদিন আসে নি। এই কঠিন বেদনা–এই নিষ্ঠুর আঘাতই যদি স্বামীকে দেবে, তবে ওগো হেলেন, কেন মিথ্যা-প্রণয়ে মেনেলাসকে আপন করেছিলে?
মেনেলাস মহিসেন নগরে যেয়ে তাঁর ভাই এগামেমননকে সব কথা বলে জিজ্ঞাসা করলেন–এখন কী করি?
এগামেমনন ভাইয়ের দুঃখে যার পর নাই মর্মাহত হয়ে বললেন–দুষ্ট পেরিস সহজে হেলেনকে ফিরিয়ে দেবে না। এগামেমননের কাছে বীর নেস্তর ছিলেন। পেরিসের কুকাজের কথা সমস্ত শুনে বললেন–সমস্ত গ্রিসবাসীকে এই কুকাজের প্রতিশোধের জন্য লড়াই করতে হবে। এগামেমনন জিজ্ঞাসা করলেন–কেমন করে তা সম্ভব বলুন। আপনি জ্ঞানী। আপনার সুপরামর্শ ছাড়া আমরা কিছু বুঝতে পাচ্ছি না।
নেস্তর বললেন–আমাদের সকলের মুরুব্বি পালমিদাসের কাছে চলুন। তারপর গ্রিসের যে রাজপুত্র, রাজা নীরজের কাছে শপথ করেছিল তাদের কছে যাবো। মেনেলাসের এই বিপদে তাকে সাহায্য করতে তারা বাধ্য। পরী হেরা ও এথেন রাজপুত্র পেরিসের উপর খুব বিরক্ত হয়েছিলেন–তাঁরা এখন সারা গ্রিসের ভিত পরিসের বিরুদ্ধে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে লাগলেন।
গ্রিস ক্ষেপে উঠল। পেরিসের দেশ, ত্রয় নগর, পুড়িয়ে ছাই করে হেলেনকে উদ্ধার করতে হবে, এই হল তাদের প্রতিজ্ঞা। যে কথা সেই কাজ। হাজার হাজার জাহাজ সমুদ্রকূলে জমা হল। লক্ষ লক্ষ বীর যুবক যুদ্ধসজ্জায় বন্দরে এসে উপস্থিত হল।
প্রতিশোধের একটা বিরাট বিপুল আয়োজন দেখে এহগামেমননের মন গর্বে পূর্ণ হয়ে উঠলো। পেরিসের পরাজয়ের কথা চিন্তা করে তাঁর মনে গভীর আনন্দ হল।
বীরবর ওদেসিজ প্রথমে এই যাত্রায় যোগ দেন নি। বিয়ের পরই যুদ্ধে যাবার ডাক পড়ল কি না নববধূকে ছেড়ে যেতে তার মন সরছিল না। যেন পাগল হয়েছেন, এই ভান করে তিনি সমুদ্রকূলে যেয়ে লাঙ্গল চাষ আরম্ভ করলেন–কিন্তু তাঁর এই চালাকি জ্ঞানবৃদ্ধ পালমিদাস বুঝতে পারলেন। জব্দ করবার জন্য তিনি ওদেসিজের খোকা তেলিমেকাকে নিয়ে লাঙ্গলের সামনে ফেলে দিলেন, ওদেসিজ অমনি লাঙ্গল থামিয়ে ফেললেন। পাগলের কি জ্ঞান থাকে?–পালমিদাস হেসে ওদেসিজকে বললেন–দাদা, তোমার চালাকি বুঝতে পেরেছি-যুদ্ধে তোমাকে যেতেই হবে। ওদেসিজ শেষে যুদ্ধে যেতে বাধ্য হলেন। কিন্তু তাঁর মনে বড় রাগ হল। পরে এইজন্যে ওদেসিজ পালমিদাসকে খুব জব্দ করেছিল।
তোমাদের মনে আছে–রাজা পেলাস পরী-কুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। এর নাম তিতিশা। পরে দেখবে, এই বিয়ে হতেই এই কাহিনীর সব অনর্থ শুরু হয়েছে। যাই হোক, এঁদের এক ছেলে হয়েছিল–তাকে সবাই নাম দিয়েছিলেন এচিলীস (খরগোস)। এচিলীস ভারি তুখোড় ছেলে–পরীর বাচ্চা কি না! দৌড়াতে, ঘোড়ায় চড়তে, তীর ছুঁড়তে, লেখা পড়ায় সকল দিক দিয়েই শ্রেষ্ঠ। চোহারাও অতি সুন্দর। তাই এই তামাসার নাম। এখন এচিলীসকেও যুদ্ধে যেতে হচ্ছে। ছেলে জন্মাবার পরই পণ্ডিত এনে মা তার কপাল গুনেছিলেন। তারা গুনে বলেছিলেন–এই ছেলের যশে পৃথিবী ভরে উঠবে, কিন্তু যুবক বয়সেই তাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। মা এই কথা শুনে মনে করে ছেলেকে কিছুতেই যুদ্ধে পাঠাতে ইচ্ছা কচ্ছিলেন না। কিন্তু দেশের লোকের কথা তো না করা যায় না। তাই তিনি গোপনে এচিলীসকে বহু দূরে–এক রাজার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন।
এই রাজার কয়েকটি মেয়ে ছিল। কী করে এচিলীসকে গোপন করে রাখা যায়, এই চিন্তায় তিনি অনেকটা বিব্রত হয়ে উঠলেন। শেষে এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করলেন। রাজার সাত মেয়ে ছিল, তিনি এচিলীসকে বালিকার পোশাক পরিয়ে তাদের সঙ্গে রাখলেন। কেউ বুঝতে পারলো না। এচিলীস মেয়ে-মানুষের পোশাকে এখানে লুকিয়ে আছে।
রাজার সেজো মেয়ে যেমন পরীর মতো খুবসুরত তেমনি সৎস্বভাব। এচিলীস তারই সঙ্গে বেশি করে মিশতেন। তার মিষ্টি কথা, তার সরল ব্যবহার এচিলীসেকে মুগ্ধ করে দিলো–তিনি তাকে বড় ভালবাসলেন। তাঁর জীবনের লক্ষ্যের কথা, দেশের কথা সব ভুলে গেলেন। একটা রঙ্গিন স্বপ্নে তাঁর দিনগুলি সুখে কেটে যেতে লাগলো।
একদিন হঠাৎ এক বিদেশী কতকগুলি পণ্যদ্রব্য এনে রাজপ্রাসাদে ঢুকলো। কত রং বেরং-এর কাপড়, কত বিচিত্র পোশাক-পরিচ্ছদ তাঁর ঝাঁকার মধ্যে স্তরে স্তরে সাজান ছিল। মেয়েরা ঘিরে সেই সব জিনিসপত্র দেখতে লাগলো।
এচিলীসও নারীবেশে মেয়েদের মাঝে দাঁড়িয়ে সেই ঝাঁকার দিকে তাকিয়েছিলেন। তিনি নারীর পোশাক পরলেও অন্তরে তাঁর পুরুষের তেজ ঘুমিয়েছিল। মেয়েরা সুদৃশ্য হার, গয়না
আর জরির পোশাক নাড়া-চাড়া করছিলেন–এচিলীস সে সব ফেলে একখানা তলোয়ার তুলে তার ধার পরীক্ষা করতে লাগলেন। ব্যস! আর যাবেন কোথায়? যাকে তোমরা সওদাগর বলে মনে করছ, ইনি হচ্ছেন গ্রিসের বড় বীর ওদেসীজ। মিথ্যা সাজে এচিলীসের খোঁজে বের হয়েছেন। ওদেসীজ এচিলীসের হাত ধরে বললেন–তোমাকে চিনেছি। এখন নারীর পোশাক রেখে তীর তলোয়ার হাতে করে বেরিয়ে পড়। সমস্ত গ্রিসের বীর যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হচ্ছে আর তুমি এইখানে মেয়ে-মানুষের পোশাক পরে লুকিয়ে আছ?
যথা সময়ে হাজার হাজার বীর ত্রয় দেশের দিকে যাত্রা করলেন। সে কী দৃশ্য! অগণিত তীর, তলোয়ারের আস্ফালন, সহস্র মুখের মিলিত ধ্বনি। এগামেমননের মনে তা দেখে অহঙ্কার হল, তাঁর মনে হল তিনি যেন সমস্ত দুনিয়া জয় করতে পারবেন। গর্বে খোদার নামটি পর্যন্ত ভুলে গেলেন–অহঙ্কার করে আল্লাহকে উপহাস করে কথা বলতে লাগলেন।
একদিন গভীর রাত্রে সমুদ্রবক্ষে নাবিকেরা দিগৃহারা হয়ে গেল–এত করে তারা ঠিক পথে জাহাজ চালাতে চেষ্টা করলো, কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা হল। সাত দিন সাত রাত্রি তারা কিছুই ঠিক করতে না পেরে শেষে সমুদ্রকূলের এক পাহাড়ের কাছে এসে উপস্থিত হল। সেই পাহাড়ে ভীষণ জঙ্গল ছিল। বীরগণ ভাবতে লাগলেন–কোথায় হয় নগরে যুদ্ধ করে গৌরব অর্জন করবো, তানা, কোথায় পথ ভুলে এসে উপস্থিত হলাম। এখন উপায় কী?
জাহাজ খুলে পুনরায় পথের সন্ধানে যে তারা বের হবেন সে সুবিধা হল না, কারণ উল্টো দিক থেকে এমন প্রবলভাবে বাতাস বইতে লাগলো যে, কার সাধ্য জাহাজ এক রশি চালায়। তার পর তারা একমনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলেন।
একদিন ওদেসিজ স্বপ্ন দেখলেন–এক ব্যক্তি তাঁকে বলছেন, এগামেমননের পাপে তোমাদের সকলকে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে। এগামেমনন বড় অহঙ্কারের পরিচয় দিয়েছে এবং সেই কারণে তোমাদের মাথায় এই অভিশাপ পড়েছে। জান তো, খোদা অহঙ্কার ভালবাসেন না। ওদেসিজ সেই স্বপ্নপুরুষকে জিজ্ঞাসা করলেন–তা হলে এই অভিশাপ হতে কী করে মুক্ত হই? দয়া করে বলে দিন।
সেই পুরুষ বললেন–মুক্তির পথ আছে। সে কাজ কি করতে পারবে? ওদেসিজ বললেন-পারবো, নিশ্চয় পারবো।
স্বপ্ন পুরুষ–তোমাদের মুক্তির পথ বলে দেবার জন্যেই আজ আমি এখানে এসেছি। আমার দেরি করার যো নেই। শোন, এগামেমননের কুমারী কন্যাকে যদি কোরবানি দিতে পার, তা হলেই তোমরা মুক্তি পাবে, নইলে নয়। এই কথা বলেই স্বপ্ন পুরুষ অদৃশ্য হলেন।
প্রাতঃকালে উঠে ওদেসিজ বন্ধু ও দলপতিগণকে সব বৃত্তান্ত বললেন। সকলেই স্বপ্ন পুরুষের কথা বিশ্বাস করেন। সকলে দল বেঁধে এগামেমননের কাছে যেয়ে বললেন–তোমার মেয়েকে কোরবানি দিয়ে আমাদের উদ্ধার করো। গত রাত্রে এক মহাপুরুষ স্বপ্নে ওদেসিজকে বলে গেছেন তোমার কুমারী কন্যার জীবন দানের উপর শুধু আমাদের নয়, জাতির সম্মান নির্ভর করছে।
এগামেমনন একবার মুখ তুলে দলপতির রক্তচক্ষুর পানে তাকালেন। তাঁদের মুখে কঠিন ইচ্ছার ছায়া দেখে এগামেমননের মনে ভয় হল।
এগামেমননকে চুপ করে থাকতে দেখে তাঁরা রেগে বললেন–কাপুরুষ, জাতির সম্মানের জন্য, খোদার উদ্দেশ্যের পথে কন্যার হৃদয়রক্ত দান করতে সঙ্কোচ বোধ করছো? গ্রিক জাতির মুখে কালি দিয়ে, লক্ষ নর-নারীর মাথা অপমানে নত করে তুমি তোমার কন্যাকে বাঁচাবে? এই তোমার বীর জীবনের ইচ্ছা? বল, তোমার ইচ্ছা কী? এগামেমনন মৃদু কণ্ঠে বললেন–রাজি আছি।
এগামেমননের পত্নীর কাছে লোক গেল। কন্যাকে কোরবানি করা হবে, এ কথা না বলে, লোকটি বললে–বীরবর এচিলীসের সঙ্গে আপনার মেয়ের বিয়ে হবে। আপনার স্বামী অবিলম্বে মেয়েকে নিয়ে যেতে বলেছেন। মা মহাআনন্দে মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন।
মেয়ে এসে দেখলেন, বিয়ের কোনো উৎসব হচ্ছে না। বাঁশির গান, ফুলের মালা কিছুই নেই। কতকগুলি রাজা ছুরি হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে।
যথাসময়ে তাকে সব কথা বলা হল–পিতার পাপের জন্য তাঁর জীবন নেওয়া হবে। কন্যা ভীত হলেন না। তিনি নির্ভীক চিত্তে ঘাতকের ছুরির মুখে গলা এগিয়ে দিলেন। সমুদ্রের নীল পানি চতুর্দিকে থই থই করছিল। একবার মেয়ে বাপের মুখের দিকে তাকালেন–তার পর বীরবালার মতো বললেন–চালাও। ছুরি উঠাতেই কোথা থেকে একটা ঝড় এসে মেয়েকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে গেল। খোদা তাকে বাঁচালেন,–খোদার ইচ্ছায় যে প্রাণ দিতে যায়, খোদা তাকে রক্ষা করেন।
০৩. গ্রিকরা ত্রয় নগরের তীরে
যথাসময়ে গ্রিকরা ত্রয় নগরের তীরে এসে উপস্থিত হলেন। পথে তাঁরা একটা বড় নিষ্ঠুর কাজ করেছিলেন। একজন সঙ্গীর সাংঘাতিক পীড়া হয়–কিছুমাত্র লজ্জাবোধ না করে পীড়িত লোকটিকে সমুদ্রের এক দ্বীপের মাঝে তারা তাকে রেখে এসেছিলেন।
মেনেলাস ও ওদেসিজ যখন জাহাজ ছেড়ে তীরে নামলেন, তখন ত্রয় শহরের বুড়ো রাজা প্রিয়াম এবং আরও একজন ভালো লোক তাদেরকে আদর করে বাড়ি নিয়ে যেয়ে বললেন–আপনাদের সঙ্গে আমার ছেলে যে কুব্যবহার করেছে, সেজন্য আমি বড় লজ্জিত আছি। শুধু যে হেলেনকে ফিরিয়ে দেবো তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিপূরণস্বরূপ অনেক টাকাও দেবো-আমাদের অপরাধ ক্ষমা করুন।
মেনেলাসও ওদেসিজ খুব খুশি হয়ে রাজা আর সেই ভদ্রলোককে ধন্যবাদ দিলেন। সে ভদ্রলোক রাজদরবারেরই একজন।
এই সময় যুবক পেরিস ক্রোধে মেনেলাসকে শুনিয়ে বললেন–যে রহ আমি হাতে পেয়েছি,তাকে কিছুতেই ছাড়বো না। যদি প্রাণে বাঁচতে চাও, তবে দেরি না করে নগরের। সীমা ত্যাগ করে বাড়ি চলে যাও। মেনেলাস ও ওদেসিজ নিতান্ত অপমানিত হয়ে নিজেদের দলে ফিরে এলেন।
এরপর ভীষণ যুদ্ধ বেধে উঠলো। ত্রয়-বাসীদের মধ্যে যুদ্ধের সাড়া পড়ে গেল। রাজা প্রিয়ামের বড় ছেলে হেক্তর হলেন তাদের সর্দার–আরও অন্যান্য বহু লোক তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন।, গ্রিকেরা জাহাজ ছেড়ে তীর বল্লম নিয়ে কূলে নামলেন। অসংখ্য মানুষের মাথা–তা দেখলে তোমরা অবাক হয়ে যেতে, তোমাদেরও গায়ের রক্ত নেচে উঠত!
জনৈক গ্রিক যুবক প্রথমেই বীরদর্পে শত্ৰুদলের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ালেন, আর সঙ্গে সঙ্গে হেকতর তার দীর্ঘ তরবারির আঘাতে তার মাথাটা কেটে ফেললেন–তার পর ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। তোমরা যেমন ছুরি দিয়ে কচু কেটেছ, ত্রয়-বাসীরা তেমনি গ্রিকদের কেটে ফেলতে লাগলো। সে কী ভয়ানক দৃশ্য!
বীরবর এচিলীস রক্তের স্রোতকে উপেক্ষা করে তার বিরাট তলোয়ারখানা আকাশের দিকে ধরে উচ্চকণ্ঠে বললেন–এচিলীসের সম্মুখে কে আসতে সাহস কর, এস।
সম্মুখে সাইনাস নামক এক ব্যক্তি দাঁড়িয়েছিল। ত্রয় দলের যোদ্ধাদের মধ্যে এ লোকটি ভয়ানক বীর–যেমন তার দীর্ঘ বিরাট দেহ, তেমনি তার অস্ত্র নিক্ষেপে পারদর্শিতা। তার চোখ দিয়ে আগুন বের হচ্ছিল! তার ঘোড়াটাই বা কত বড়! আর কেউ হলে তার সম্মুখে যেতেই বেহুশ হয়ে পড়তে, কিন্তু এচিলীস দমলেন না। এচিলীসও তো কম বীর নয়–পরী-মায়ের রক্ত তার শিরায় শিরায় বইছে। তিনি ভীমবেগে দীর্ঘ ধারাল বর্শা ফেলে সাইনাসের বুকে আঘাত করলেন! বর্শা জোরে ঘুরে এল। সাইনাসের গায়ে পুরু লোহার কোট ছিল–বর্শার আঘাতে তার বুকের উপর থেকে আগুনের ফুলকী বের হল, তবু বিশেষ কিছু হল না। এইবার ভীষণ গদা তুলে এচিলীস তার মাথায় আঘাত করলেন। এবারও আঘাত ব্যর্থ হল। এচিলীস বিস্মিত হয়ে ভাবলেন, আমার আঘাত তো কোনোদিন ব্যর্থ হয় নি!
একবার হাত দিয়ে নেড়ে দেখলেন–বর্শার মাথা ঠিক আছে কি না। দেখলেন, ঠিক আছে তবে এমন হচ্ছে কেন?
কাছেই আর একটা পাহাড়ের মতো লোক দাঁড়িয়েছিল–অস্ত্রের ফলা পরীক্ষা করবার জন্যে, সাইনাসকে রেখে এচিলীস তাকে আক্রমণ করলেন–এক আঘাতেই বেচারা দুই খণ্ড হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
এচিলীস দেখলেন–অস্ত্রের ধার তো কমে নি। এবার দারুণ ক্রোধে তলোয়ার দিয়ে শক্রকে পুনরায় আঘাত করলেন। সাইনাসও চুপ করে বসে ছিল না। সেও গদা দিয়ে এচিলীসকে আক্রমণ করছিল। সে ভীষণ আক্রমণ সহ্য করা এচিলীসের পক্ষে কঠিন হচ্ছিল।
ঘৃণা ও ক্রোধে এচিলীসের সর্ব শরীর কাঁপছিলো। একবার আল্লার নাম ধরে এচিলীস মৃদু স্বরে প্রার্থনা করলেন–হে খোদা, অন্যায়কে হত্যা করার জন্যে যুদ্ধে এসেছি, আমার বাহুতে বল দাও।
কে যেন তাঁর কানের কাছ বলে গেল–ভয় নেই। এচিলীস বুকের ভিতর নূতন করে শক্তি অনুভব করলেন–সাইনাসের দিকে অগ্রসর হয়ে বললেন–দুর্বত্ত, এইবার আমার আঘাত সহ্য কর। এই কথা বলতে বলতে সাইনাসের কাঁধের উপর তিনি এরূপ পুনঃ পুনঃ আঘাত করতে লাগলেন যে সাইনাসের লোহার কোট কেটে গেল। এচিলীসের তলোয়ার সাইনাসের পার্শ্ব ভেদ করে গেল, সাইনাস বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
সাইনাসের পতন দেখে ত্রয়-বাসীদের মনে ভয়ানক আতঙ্কের সঞ্চার হল।
যেদিক হেক্টর ও প্রিয়াম রাজার ছোট ছেলে যুদ্ধ করছিল, বর্শা তুলে সেই দিকে এচিলীস দ্রুতবেগে ধাবিত হলেন। এচিলীসের ভীম চেহারা দেখে ভয়ে সে কাঁপতে লাগলো,–কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এলে ভয়ে কাঁপলে তো যমে ছাড়বে না! এচিলীসের কোনো কিছু বলবার আগে সে তার তলোয়ারখানা তুলে একবার এচিলীসকে আঘাত করতে চেষ্টা করলে, কিন্তু অবশ হাত তার নিচে নেমে এল। এচিলীস হাতের তলোয়ার তুলতেই, সে ঘাড় ফিরিয়ে দে ছুট!
এচিলীসের বীরত্ব দেখে ত্রয়-বাসীরা বুঝতে পারলে এমন করে সামনাসামনি যুদ্ধ করলে কিছুতেই তাদের জেতবার উপায় নেই–তারা স্থির করে, শহরের ভিতর প্রাচীরের আড়ালে থেকেই যুদ্ধ করবে।
এদিকে গ্রিকরাও বুঝলেন এ যুদ্ধ সহজে মেটবার নয়। তাঁরাও ঠিক-ঠাক হয়ে বসলেন। শিবিরের চতুর্দিকে একটা প্রকাণ্ড গড় কাটা হল–যাতে শত্রুরা তাহাদের হঠাৎ আক্রমণ করতে না পারে।
ইতোমধ্যে এচিলীস এক নূতন রাজ্য জয় করে ফেললেন, কিছুদিন বাদে আর একটা রাজত্ব জয় করতে গিয়ে তিনি এক পরমা সুন্দরী কুমারী লাভ করলেন। মেয়েটির নাম ব্রীসাস। ব্রীসাসকে শেষে এচিলীস বিয়ে করলেন।
বীরবর এগামেমনন এচিলীসের সৌভাগ্য দেখে মনে মনে ভারি ঈর্ষান্বিত হলেন। তিনিও এক নূতন দেশ জয় করবার আয়োজন করলেন। তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল। ব্রীসাসের মতো এক সুন্দরী কন্যা লাভের আশায় তিনি সে দেশের এক সাধু ব্যক্তির কন্যাকে জোর করে হরণ করে নিয়ে এলেন।
কন্যার পিতা দারুণ বেদনায় এগামেমননের কাছে এসে বহু মিনতি করে বললেন, হে দেশের রাজা, হে বীর, আমার বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বনকে আপনি হরণ করবেন না। ওকে নিয়েই আমি বেঁচে আছি। কন্যার অদর্শনে আমি বাঁচবো না। দয়া করে আমার নয়নের মণিকে ফিরিয়ে দেন।
এগামেমনন বৃদ্ধের কন্যাকে তো ফিরিয়ে দিলেনই না, বরং হুকুম দিলেন, এ লোকটাকে এইখান থেকে তাড়িয়ে দাও।
সাধু মহাজনকে ব্যথা দিলে তার ফল হাতে হাতে ফলে। এগামেমননের এই দুর্ব্যবহারের কী ফল হবে তা তোমরা একটু পরেই বুঝবে। সাধু দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলেন–হে খোদা, তুমি এর বিচার করো। খোদা সত্যই সাধুর কাতর নিবেদন শুনলেন। কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রিক সৈন্যদের মাঝে খোদার অভিশাপ এসে দেখা দিল। তাদের মধ্যে ভায়নক কলেরা আরম্ভ হল।–সে যে কী ভীষণ ব্যাপার তা বুঝে উঠা কঠিন। মানুষের পাপের জন্যে তাকে অনেক সময় খোদার গজব নাজেল হয়, তা জান? এ কলেরা আর কিছু নয়–এগামেমননের পাপে খোদার গজব।
প্রায় ১৫ দিন ধরে এই ভীষণ ব্যাধির প্রকোপ চলতে লাগলো–গ্রিকরা ভাবলো, যুদ্ধবিগ্রহ ফেলে যার যার প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।
কী কর্তব্য ঠিক করবার জন্যে একটা সভা আহুত হল। সভার মাঝে এক জ্ঞানবৃদ্ধ মহাজন গম্ভীর স্বরে বললেন–তোমরা কি জান, খোদা কেন এই ভীষণ ব্যাধি আমাদের উপর পাঠিয়েছেন? এগামেমনন কি পাপ করেছে, তার খবর তোমরা রাখ? সে জনৈক সাধুর কন্যাকে হরণ করেছে। সাধু যখন কাঁদতে কাঁদতে এগামেমননের কাছে কন্যা ফিরিয়ে পাবার জন্য বলেছিল তখন তাকে বড় অপমান করে এগামেমনন তাড়িয়ে দিয়েছে। সাধুর অভিশাপই আমাদের এই বিপদের কারণ।
এগামেমননও সেই সভায় ছিলেন। বৃদ্ধের বাক্য শেষ হলে তিনি সরোষে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন–দুর্বৃত্ত, তুমি বহুবার আমার ক্ষতির চেষ্টা করেছ। আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি যে একজন বকধার্মিক, তা আমার জানা আছে। এচিলীস কুমারী ব্রীসাসকে লাভ করেছে, সে বেলা তোমার মুখ ফোটে নি। আমার বেলায় ধর্মজ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছ!
ক্রোধে এচিলীস বললেন–এগামেমনন, মুখ সামলে কথা বলো। কারো মনে ব্যথা দিয়ে আমি ব্রীসাসকে লাভ করি নি। তা ছাড়া যুদ্ধ জয়ের পরে লব্ধ ধনসম্পত্তি সকলের মধ্যে সব মতানুসারে ভাগ হয়েছে–তোমার ভাগ্যে যা পড়েছে, তাতেই সন্তুষ্ট থাক। তুমি অবিলম্বে সাধুর কন্যাকে ফিরিয়ে দাও।
এগামেমনন বললেন–স্বার্থপর এচিলীস, নিজে এক সুন্দরী রমণী লাভ করেছ–অপর কেউ কিছু পাক না পাক, সেদিকে তোমার কিছুমাত্র দৃষ্টি নেই। মানুষ এতই অন্ধ!
এচিলীস বললেন–এগামেমনন তোমার পাপে জাতির মাথা নত হবে। রমণী লাভ করবার জন্যেই কি যুদ্ধক্ষেত্রে নেমেছ?
এগামেমনন তোমার ঐ সব রঙ্গিন কথা ফেলে রাখ। বেশ, তোমার ব্রীসাসকে আমায় দিয়ে দাও, নইলে আমি আমার বিজিতা কুমারীকে কিছুতেই ছাড়ব না। যে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে, তার রক্তে এই তরবারি লাল করবো, এই আমার কথা।
এচিলীস বললেন–অকৃতজ্ঞ এগামেমনন, কাঁদের জন্য যুদ্ধ করতে এসেছি? আমার কি ক্ষতি হয়েছিল? আমার সঙ্গে এই দুর্ব্যবহার! তোমারি বোনকে পেরিস চুরি করে এনেছে, তাতে আমার কী? আমি দেখে আসছি, যত কষ্টের কাজ আমাকেই করতে হয়, অথচ ভোগের বেলায় তোমরাই বড় ভাগ নেবার জন্যে এগিয়ে আস! তাতেও আমার দুঃখ ছিল না, কিন্তু তোমার এ অপমান আমার সহ্য হচ্ছে না। থাক, আমি আর দুঃখ করতে চাই নে, তোমরা থাক, আমি দেশে যাই।
নিতান্ত ধৃষ্টের মতো এগামেমনন বললেন, তা বেশ–যাও তুমি চলে, তোমায় দিয়ে আমাদের কোনো দরকার নেই। কে তোমাকে আসতে বলেছিল? গায়ে শক্তি আছে বলে, তোমার এত অহঙ্কার? তুমি যদি আমায় না মানো তাতে আমার বিশেষ আসবে–যাবে না–এখানে বহু বীর আছে, যারা আমার সম্মান বোঝে। কে তোমার শরীরে অসীম শক্তি দিয়েছে? খোদা দিয়েছেন বলেই এত বড় হয়েছ,তার জন্যে এত অহঙ্কার কেন? তোমার জাহাজ, তোমার লোক-লস্কর নিয়ে এই মুহূর্তে ত্রয়ভূমি ত্যাগ কর–আমি আমার কুমারীকে। ফিরিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু ঠিক জেনো, ব্রীসাসকে নিয়ে তুমি কিছুতেই জাহাজে চড়তে পারবে না।
এচিলীস এই অপমান সহ্য করতে পারলেন না, কম্পিত বাহুতে দীর্ঘ তলোয়ার কোষ মুক্ত করতে যাচ্ছিল, এমন সময় দেখতে পেলেন–মহাশূন্যে পরী কুমারী এনিথী তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলছেন–থাম এচিলীস, বীরধর্মের অবমাননা করো না। নিজেদের মধ্যে কলহ, বিবাদ করে জাতির অসম্মান বাড়াচ্ছো? গ্রিসের প্রতি কত বড় অন্যায় হয়েছে, এর প্রতিশোধ নেবে না? পেরিসের পাপের যদি শাস্তি না দাও, তা হলে তোমার তরবারি ধারণ বৃথা। পরীবালা হেরা তোমাকে ভালবাসে, তারি আদেশে তোমার কাছে এসেছি। দেখ, জীবনে মহৎ হতে অনেক বেদনা সহ্য করতে হয়, ক্রোধে তোমার মহত্ত্বকে খাটো করে ফেলো না। এও তোমার বলে রাখছি, শীঘ্রই সময় আসবে যখন এগামেমননকে এই দুর্ব্যবহারের জন্য অনুশোচনা করতে হবে।
এচিলীস তলোয়ার ছেড়ে দিয়ে বললেন–পরীরা চিরকালই মানুষের মঙ্গল কামনা করে–হে পুণ্যের ছবি, তোমার আদেশ আমি পালন করলাম।
এচিলীস অতঃপর এগামেমননকে বললেন–কাপুরুষ, তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে জাতির সর্বনাশ করতে চাই নে। বীর নামের কলঙ্ক তুমি; তোমার প্রজারা কাপুরুষ, তাদের রাজা তুমি, তাই এই স্বার্থান্ধ স্বভাব তোমার। আমি আজ আল্লাহকে সাক্ষী করে বললাম, আমাকে যে আপমান করেছ, তার ফল তোমাকে ভোগ করতে হবে। বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ ব্রীসাসকে তোমরাই আমাকে দিয়েছিলে–ফিরিয়ে যদি নিতে চাও, নাও আমার তাতে আপত্তি নেই।
তারপর সভা ভেঙ্গে গেল। এগামেমনন সাধুর মেয়েকে বাড়ি যেতে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গ্রিকদের মধ্যে আবার শান্তি ফিরে এল–সে ভীষণ ব্যাধি হতে তাঁরা রক্ষা পেলেন।
এচিলীস ব্রীসাসকে পরিত্যাগ করলেন। গভীর শোকে এচিলীসের হদয় চূর্ণ হয়ে গেল। দুঃখ যখন বেশি লাগতো, চোখের পানি ঠেকিয়ে রাখতে পারতেন না, তখন সাগর কূলে যেয়ে বসতেন, দূর সমুদ্রসীমার পানে চেয়ে থাকতেন।
০৪. মন পরীক্ষা করবার জন্যে
মন পরীক্ষা করবার জন্যে একদিন এগামেমনন সৈন্যদেরকে ডেকে বললেন–চল, আমরা দেশে যাই; কেন আর মিছামিছি পরের জন্য লড়াই করে মরি!
সৈন্যেরা আনন্দিত হয়ে বললে–তাই তো! কেন আমাদের এই মাথা ব্যথা? কেন জন্মভূমি ত্যাগ করে সাগরপারে হেলেনের জন্যে প্রাণ দিতে এসেছি? সে শয়তানী গোল্লায় গিয়েছে, তাতে আমাদের কী? এই কথা বলে মহাউল্লাসে তারা জিনিসপত্র ও তাঁবু বেঁধে জাহাজে ওঠা শুরু করলো।
আসলে হেলেনকে রেখে যে গ্রিক বীরেরা দেশে চলে যাবেন, তা তো হতে পারে না, এগামেমননের ইচ্ছে–একবার সকলের মন পরীক্ষা করেন।
অনেক কষ্টে ওদেসিজ সৈন্যদেরকে জাহাজ থেকে ফিরিয়ে আনলেন। ওদেসিজ বললেন, হে গ্রিসের বীরগণ, তোমরা যে কাপুরুষের মতো দেশে ফিরে যাচ্ছো–দেশের লোকেরা যখন জিজ্ঞাসা করবে, কী করে এলে? তখন কী বলবে? নারীরা যখন জিজ্ঞাসা করবে–হেলেন কই, তখনই বা কী বলবে? রিক্তহস্তে পরাজিত হয়ে ফিরে যাবার জন্য কি তোমরা আস্ফালন করে ত্রয়বাসীদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিলে? অসম্মানে বেঁচে থাকা অপেক্ষা মরণই যে শ্রেয়, তা কি তোমাদের মা তোমাদেরকে শেখান নি? প্রতিজ্ঞা কর, হে গ্রিসের সন্তানগণ, যাবৎ না আমরা হেলেনকে উদ্ধার করতে পারি, ঐ ত্রয় নগর যতদিন না আমাদের হয়, ততদিন এখান হতে ফিরে যাবো না। হেলেনের বিয়ের সময় বৃদ্ধ রাজা তানীরজের কাছে তোমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলে, তা কী তোমাদের স্মরণ নেই?
সৈন্যেরা করতালি দিয়ে বললে, গ্রিকজাতি কোনো যুদ্ধে পরাজিত হয় নি, কোনো দিন তারা কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে নি। এই বিশাল নগর আমরা জয় করবোই করবো, গ্রিসের জয়পতাকা এখানে উড়াবো।
এগামেমনন বললেন, বেশ, তা হলে সজ্জিত হও, সূর্যাস্তের পূর্বেই আমাদেরকে একটা ভীষণ লড়াই করতে হবে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সৈন্যশ্রেণী নিয়ে এগামেমনন যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হলেন। ওদিক থেকে ক্রয়-বাসীরও বেরিয়ে এলো। যুদ্ধক্ষেত্রে যে কী ভীষণ দৃশ্য হল, তা না দেখলে ঠিক বুঝতে পারা যাবে না।
বৃদ্ধ রাজা প্রিয়াম ছাদের উপর থেকে সে দৃশ্য দেখতে বসলেন।
তিনি উপর থেকে গৃহের আঙ্গিনায় দেখলেন তার নূতন পুত্রবধূ হেলেনকে। হেলেন তার সখীদের সঙ্গে ফুলের মালা গাঁথছিলেন। প্রিয়াম একদৃষ্টে বধূর রূপ দেখে ভাবতে লাগলেন, এ হেন রূপসীর জন্য যে আমার ছেলে পাগল হয়েছে, এতে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। হেলেনের জন্যে ক্রয় ও গ্রিসে যুদ্ধ বেধেছে–এও আশ্চর্য নয়।
একটা মেয়ে দিয়ে হেলেনের কাছে খবর পাঠিয়ে দিলেন–আমার বধূকে একবার এদিকে আসতে বল।
হেলেন লজ্জাজড়িত চরণে, নত-মাথায় শ্বশুরের কাছে এসে উপস্থিত হলেন।
প্রিয়াম বললেন–মা, একবার যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে চেয়ে দেখ। তুমি গ্রিসের বীরদেরকে নিশ্চয়ই চেন। ঐ যে বিরাট মূর্তি বীর, যিনি আমার পুত্র পেরিসের সঙ্গে সোজা দাঁড়িয়ে আছেন, উনি কে? উনি বোধ হয় কোনো রাজা হবেন, তাঁকে সাধারণ সিপাইদের মতো দেখা যাচ্ছে না।
হেলেন বললেন–আপনার সম্মুখে আসতে আমার লজ্জা করে। আমি পরের বৌ, আপনার ছেলে আমাকে চুরি করে এনেছে, কুলকামিনীর পক্ষে এর চেয়ে অপমান আর কি হতে পারে? আমি অভাগিনী কী বুঝে যে এই সর্বনাশ কাজ করেছি, খোদা জানেন। আমার লজ্জা রাখবার স্থান নেই। হায়, আমরা কপাল! যদি এখানে আসবার আগে আমার মৃত্যু হতো, সেও ভালো ছিল! হেলেন কেঁদে বললেন–আমার স্বামী আছেন, ঘরে আমার সোনার চাঁদ শিশু আছে। যাক আপনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেন এই সব বাজে বকছি? যার পরিচয় আপনি জিজ্ঞাসা করছেন, উনি হচ্ছেন আমার দেবর, এগামেমনন।
প্রিয়াম আবার জিজ্ঞাসা করলেন–আচ্ছা মা, ঐ যে যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ পূর্ব কোণে একটা সাদা ঘোড়ায় চড়ে ত্রয় নগরের দিকে আসছেন, উনি কে? এগামেমননের ন্যায় তার বাহু তত বিশাল নয়, কিন্তু গায়ে যে তার খুব শক্তি রয়েছে, তাতে আর সন্দেহ নেই।
হেলেন বললেন–উনি ওদেসিজ, গ্রিসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর।
দাসী বালিকা বললেন–ওকে আমি চিনি। যখন প্রথম হেলেনকে ফিরিয়ে পাবার জন্যে উনি ও আর একজন এসেছিলেন, তখন ওঁকে আমি দেখেছিলাম। ওঁর গলার আওয়াজ বজ্রপাতের মতো ভীষণ ও উচ্চ।
আর একজনের দিকে আঙ্গুল তুলে রাজা জিজ্ঞাসা করলেন–উনি কে মা?
হেলেন বললেন–উনি আজা, তেলামনের পুত্র। আজাসের কাছে ঐ যে। একজনকে দেখতে পাচ্ছেন, ওঁর নাম ইদিয়মেনাস। ইদিয়মেনাস প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন! আমার স্বামীর সঙ্গে তাঁর খুব বন্ধত্ব ছিল। অনেককেই দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু আমার ভাই দুটিকে তো দেখতে পাচ্ছিনে। তারা কি গ্রিক বীরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছে? হায় হায়, লোকসমাজে তাদের মুখ দেখাবার উপায় নেই–আমি হতভাগিনী কুল কলঙ্কিনী যে তাদের বোন! এই কথা বলতে বলতে হেলেন কাঁদতে লাগলেন।
ত্রয়-বাসীরা বীর বিক্রমে গ্রিকদের আক্রমণ করলে মেনেলাস দেখলে, যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে পেরিস। সিংহের ন্যায় তলোয়ার আস্ফালন করতে করতে তিনি পেরিসের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে তাঁর জীবন শত্রুর হৃদয়রক্তে তলোয়ার ভিজাতে পারবেন, এই আশায় তার বাহুতে প্রচণ্ড শক্তি এলো, তার চক্ষু হতে আগুন বের হতে লাগলো। নরপিশাচ পেরিস মেনেলাসের সে ভায়ানক মূর্তি দেখে স্থির থাকতে পারলো না। শরীর তাঁর কাঁপতে লাগলো, কাপুরুষের মতো ঘোড়া ছুটিয়ে সে সৈন্যদের ভিড়ের মাঝে ঢুকে পড়লো। প্রিয়ামের বড় ছেলে হেকতর তা দেখলেন। তিনি উচ্চস্বরে পেরিসকে লক্ষ্য করে বললেন–ওরে এয়-কলঙ্ক তুই আমাদের মুখে কালি দিয়েছিস। তোরি দুষ্কর্মের জন্য আজ ত্রয় ধ্বংস হতে চললো। পরস্ত্রী চুরি করতে লজ্জা করে না? লজ্জা হয় বুঝি যুদ্ধ করতে? কেবল শৃগালের মতো পালাতে জান? কোন্ কাপুরুষের দল তোমার সঙ্গে বীর মেনেলাসের পত্নীকে চুরি করবার জন্য গ্রিসে গিয়েছিল? ধিক তাহাদেরকে, ধিক তোমাকে! ত্রয়বাসীরা তোমার ন্যায় নরাধমকে যে বহু পূর্বেই মেরে ফেলে নি, এজন্য তাহাদেরকে ধন্যবাদ দাও। পেরিস বললেন, ভাই হেকতর, তুমি আমাকে অন্যায় ভর্ৎসনা কচ্ছো। কিন্তু ভেবে দেখ, অনর্থক এত জীবন নাশের আবশ্যকতা কী? শান্তি ঘোষণা করো। আমি ও মেনেলাস, যারা এই যুদ্ধের প্রকৃত কারণ, সম্মুখযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হই, সকল লোক বসে থাকুক–আমাদের দুই জনার মধ্যে যে জিতবে, সেই হেলেনকে পাবে।
হেকতর পেরিসের প্রস্তাবে সন্তুষ্ট হলেন। অবিলম্বে যুদ্ধ স্থগিত করা হল। রাজধানীতে বৃদ্ধ রাজা প্রিয়ামের কাছে সন্ধি-সংবাদ প্রেরিত হল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হলেন। এগামেমনন ও ওদেসিজ তাঁকে অভ্যর্থনা করতে ক্রটি করলেন না। তখন আর কারো মনে হিংসা-বিদ্বেষ ছিল না। গ্রিস ও ত্রয়ের বীরবৃন্দ একস্থানে সমবেত হয়ে সন্ধি-শর্ত আলোচনা করতে লাগলেন। বৃদ্ধ প্রিয়াম পুত্রের ইচ্ছায় সন্তুষ্ট হলেন, কোনো অনর্থক লোকক্ষয়-যাদের কারণে যুদ্ধ হচ্ছে, তারাই করুক। যে জিতবে সেই হেলেনকে পাবে–এ ন্যায্য কথা।
এগামেমনন যুদ্ধের জন্যে স্থান প্রস্তুত করলেন। হেকতর পেরিসকে যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত করে দিলেন। এদিকে গ্রিকেরা মেনেলাসকে নানাবিধ অস্ত্র দিয়ে মনের মতো করে সাজালেন।
তারপর মেনেলাস ও পেরিসে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ আরম্ভ হল। পুত্রের মৃত্যু দৃশ্য দেখতে হবে, এই ভয়ে রাজা প্রিয়াম যুদ্ধক্ষেত্র হতে বাড়ি ফিরে গেলেন। মেনেলাস তার ভীষণ তরবারি তুলে পেরিসকে এরূপ মুহুর্মুহু আঘাত করতে লাগলেন যে, শেষে পেরিস কাপুরুষের মতো যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে পলায়ন করলেন। মেনেলাস তাকে ধরবার জন্যে, জনতার মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন–কিন্তু পেরিসের আর কোনোই পাত্তা পাওয়া গেল না। আসল কথা, পেরিসের সেই বন্ধু পরী, যে ইদা পাহাড়ে সুন্দরী বৌ দিতে চেয়েছিল, সে তাকে মেঘে ডেকে একেবারে বাড়িতে রানী হেলেনের কামরায় এনে তুলে দিল যখন যুদ্ধক্ষেত্রে ‘পেরিস গেল’ বলে চীকার হচ্ছিল, পেরিস তখন হেলেনের কাঁধে মাথা রেখে তাঁর ভয়ে-ভীত অন্তরে শক্তি-সান্ত্বনা খুঁজছিল।
ত্রয়বাসীরা পেরিসকে রক্ষা করবার জন্যে কিছুমাত্র লালায়িত ছিল না। এই হতভাগ্য রাজপুত্রের পাপের জন্যে যে তারা ধ্বংসের পথে ছুটেছে!
এগামেমনন উচ্চকণ্ঠে বললেন–হে সমবেত জনমণ্ডলী, যুদ্ধে কে জিতেছে তা তো দেখতে পেলেন। হেলেন এখন কাঁদের প্রাপ্য, তার বিচার করুন? যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ, আর হেলেনকে আমরা চাই।
০৫. সন্ধি অনুসারে যুদ্ধ মিটমাট
সন্ধি অনুসারে এখানেই যুদ্ধ মিটমাট হয়ে যাওয়া উচিত ছিল; কিন্তু সহসা একটা দুষ্ট ত্রয়বাসীর মনে হল যদি কোনো রকমে মেনেলাসকে মেরে ফেলতে পারতাম, তা হলে ভারি নাম হতো। পেরিস আমাকে বহু টাকা-কড়ি, ধনদৌলত দিত। এখন তো সন্ধি হয়েছে, এই সন্ধি-শান্তির মধ্যে শত্রুকে যদি জব্দ করতে পারি তাহলে তো সুবিধা।
এই কল্পনা মনে হতেই, তাঁর মনে পাপ বাসনা উদয় হল। আরও কয়েকজন সঙ্গীকে সে এইকথা বললে। তারা এই কু-কাজ থেকে তাকে নিরস্ত করবে কি, আরও উৎসাহ দিলে।
দীর্ঘ ধনুকটি খাড়া করে সে তাতে একটা তীক্ষ্ণধার তীর বসালে; কিন্তু কয়েকজন ছাড়া কেউ বুঝতে পারলে না, কি অভিসন্ধি তার মনে রয়েছে। যাই হোক, ধীরে ধীরে সে গ্রিক সৈন্যনিবাসের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো–তার দুষ্ট কাজের বন্ধুরাও তাঁকে ঘেরাও করে সম্মুখের দিকে চল্লো, কেউ যেন কিছু বুঝতে না পারে।
গ্রিকদের মনে এখন আর কোনো সন্দেহ ছিল না। হঠাৎ একটা তীর এসে মেনেলাসের স্কন্ধ ভেদ করে গেল, শরীর হতে রক্তধারা বের হতে লাগলো। এগামেমনন ক্ষিপ্রগতিতে মেনেলাসকে কোলে তুলে নিলেন। গ্রিকেরা অসর্তক ছিলেন বলেই এই দুর্ঘটনা হয়েছে–এত সহজে বীর মেনেলাসকে আঘাত করে এমন সাধ্য অতি অল্পলোকেরই ছিল।
এগামেমনন মেনেলাসের যত্ন করতে লাগলেন। আর বলতে লাগলেন হতভাগ্য জাহান্নামী ত্রয়বাসী, যে অধর্ম তোমাদের রাজপুত্র করেছে তার তুলনা নেই; তোমরা যে এত বড় হীন তা স্বপ্নেও ভাবি নি। সন্ধির বাহানায় আজ আবার এ কী কাজ করলে? ঠিক জেনো এর প্রতিফল পাবেই। তোমরা এত বড় শঠ, তা জানতাম না। ভেবেছিলাম, রাজপুত্রের কুকর্মের সঙ্গে তোমাদের কোনো যোগ নেই, অনিচ্ছায় যুদ্ধ করতে এসেছে–সে ধারণা আমার ভুল। যাক, আর না-হয় গ্রিকেরা এই সমুদ্রকূলে ধ্বংস হবে, নতুবা ত্রয় নগরকে চূর্ণ করে, পেরিসকে জীবন্ত জ্বালিয়ে তারা হেলেনকে উদ্ধার করবে।
তার পর মেনেলেসকে লক্ষ্য করে বল্লেন–বন্ধু মেনেলাস, জীবনের এই অসময়ে তোমাকে হারাবার জন্যেই কি এখানে এসেছিলাম? তোমাকে ছেড়ে কী করে দেশে ফিরবো, আর তো সহ্য হচ্ছে না; হে মাটি, তুমি দু’ভাগ হয়ে যাও–তোমার গর্ভে প্রবেশ করে এ শোক আমি জুড়াই।
মেনেলাস সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–ভাই এগামেমনন, অধীর হইও না, আঘাত তত গুরুতর হয় নি। চিকিৎসককে ডাক, খোদার মরজি শীঘ্রই ভালো হবো, জন্মভূমির গৌরব রক্ষার্থে আবার তোমার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে সক্ষম হবো। হা হতভাগী হেলেন–এই কথা বলে মেনেলাস অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন।
চিকিৎসক তাঁর ঔষধ নিয়ে এলেন। নির্মল শীতল পানিতে ক্ষতটা ধুয়ে ঔষধ লাগাতেই মেনেলাস অনেকটা আরাম বোধ করলেন। ক্ষতমুখে রক্ত বন্ধ হয়ে গেল।
এগামেমনন বন্ধু মেনেলাসকে জাহাজে পাঠিয়ে সমবেত সৈন্য শ্ৰেণীকে উচ্চকণ্ঠে বললেন, তোমরা বুঝতে পেরেছ, ন্যায়ধর্মের প্রতি তাদের কোনো মন নেই। তাদের কুমতলবের অন্ত নেই। বৃথা তোক ক্ষয়ে বিশেষ লাভ কি ভেবে আমি সন্ধিপ্রার্থী হয়েছিলাম–ত্রয়বাসীরা তার প্রতিদান কী দিয়েছে, তা তোমরা স্বচক্ষে দেখলে। ত্রয় নগরের একটি প্রাণী যতক্ষণ বেঁচে থাকবে, যতক্ষণ না তাদের পাপের চরম শাস্তি দিয়ে হেলেনকে উদ্ধার করতে পারি, ততক্ষণ আমরা ত্রয় ত্যাগ করবো না। যদি এখানে কোরবানি হয়ে যেতে হয় সেও ভালো তবুও অন্যায়কে জয়যুক্ত দেখে আমরা ফিরে যাবো না। পাপ দমন করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম–কুকুরের ন্যায় হীন হয়ে এ জগতে বেঁচে থাকতে গ্রিসের কোনো মানুষ যেন না চায়।
সৈন্যগণ উত্তেজিত হয়ে উঠলো।
অতঃপর সেখানে দুই মহাবীর ছোট ও বড় আজাক দাঁড়িয়ে ছিলেন, এগমেমনন সেখানে উপস্থিত হলেন। বীরত্ব গৌরবে তেলামনের ছেলে বড় আজাকের স্থান এচিলীসও ওদেসিজ এর নিচেই।
বিদ্যুৎ-প্রবাহ মেঘপুঞ্জের মতো গ্রীক সৈন্য সম্মুখে ছুটতে লাগলো।
এগামেমনন বড় আজাককে বললেন–ভাই, তোমাকে আমার কিছু বলতে হবে না, এদিকের সকল ভার তোমার উপর রইল আমি অন্যদিকে চলোম।
বৃদ্ধ বীর নেস্তরকে যেয়ে বললেন, বার্ধক্য আপনাকে দুর্বল করে দিয়েছে, নইলে গ্রিক যোদ্ধাদের মধ্যে আপনিই শ্রেষ্ঠ। নেস্তর হেসে বললেন–যুবক বয়সের শক্তি আর নেই, তাই বলে ভয় করবেন না; আমি একা যা করতে পারি, সহস্র গ্রিক যুবকও তা করতে পারবে না।
এগামেমনন সন্তুষ্ট হয়ে সম্মুখে অগ্রসর হলেন। ওদেসিজ বসে বসে গল্প করলেন, যুদ্ধের কথা কিছু ঠিক পান না। সন্ধি যে ভেঙ্গে গিয়েছে, তাও তিনি জানেন না। এগামেমনন কঠিন ভাষায় ওদেসিজকে লক্ষ্য করে বললেন–কাপুরুষ! সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, আর তুমি বসে বসে গল্প করছে।
ওদেসিজ ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন–এগামেমনন, তেলিমেকাসের বাপ ওদেসিজকে কাপুরুষ বলেছো? তুমি আমাকে এত ছোট মনে করো?
এগামেমনন লজ্জিত হয়ে বললেন–কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেলেছি, মাপ কর।
বৈশাখের ঝড়ের মতো গ্রিক-সৈন্য ত্রয় সৈন্যশ্রেণীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। সমুদ্র তরঙ্গ শত বিভঙ্গে যেমন করে গর্জে ওঠে, গ্রিক সৈন্যরাও তেমন করে গর্জে উঠতে লাগলো। মার মার, কাট কাট করে শত্রু-সৈন্যরা আক্রমণ করলে তলোয়ারে তলোয়ারে, গদায় গদায়, বর্শায় বর্শায় ঝনঝন ঝন শব্দ শুরু হল। ত্রয়ের যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তস্রোত বইতে লাগলো। দিন। ভর যুদ্ধ চললো। ত্রয়বাসীরা কিছুতেই পারছে না। এগামেমনন, ওদেসিজ, আজাক, নেস্তর প্রভৃতি যোদ্ধার ভীষণ তলোয়ারের সামনে ত্রয় বীরগণ কেবল হটে যেতে লাগলো।
উপায়হীন হয়ে হেক্তর দ্রুত বেগে পথে ধাবিত হলেন। সারা শহরের নারী ও বুড়োদেরকে উচ্চৈঃস্বরে ডেকে বললেন-হে ত্রয়বাসীগণ, তোমরা একস্থানে জমা হয়ে আল্লা আল্লা করো, নইলে রক্ষা নেই। শত্রুর ভীষণ আক্রমণের সামনে সৈন্যেরা কিছুতেই টিকতে পারছে না। তার পর দ্রুতবেগে হেক্তর একবার তার পত্নী ও শিশু পুত্রকে দেখতে গেলেন। পত্নী শিশুকে কোলে করে উঁচু মাচার উপর দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখেছিলেন। স্বামীকে আসতে দেখেই তিনি নেমে এলেন। তার পর স্বামীর বাহু ধরে বললেন–প্রিয় স্বামী, তোমার এই শিশুর মুখের দিকে একবার চেয়ে দেখ। যে যুদ্ধ বেধেছে তাতে তুমি কিছুতেই বাঁচবে না, এই যুদ্ধই তোমার মুত্যুর কারণ হবে। প্রিয়তম, তুমি ছাড়া আর আমার কেউ নেই। তোমাকে হারিয়ে আমি কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারবো না। আমার যারা আপন ছিল, তারা সকলেই থেবসের যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন। এ জগতে শুধু তুমিই আমার আছ, তবে। কি বলে আমাকে অনাথিনী করে যাচ্ছ? আমি যে তোমার বিবাহিতা পত্নী। আমাকে কার। হাতে দিয়ে যাচ্ছ? এই শিশু কাকে বাপ বলে ডাকবে?
হের অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন–প্রিয়তম, তোমার কথা ঠিক। কিন্তু বল দেখি, দশজনকে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেলে কেমন করে পালিয়ে থাকি? তোমার স্বামী যে কাপুরুষ নয়। অস্ত্র নিয়ে খেলা করতেই তার আনন্দ।
শিশুকে আদর করবার জন্যে হেত্তর হাত বাড়ালেন–শিশু অস্ত্রসজ্জিত পিতার মূর্তি দেখে ভয় পেয়ে কাছে এলো না। হের একটু হাসলেন!
হের বললেন–প্রিয়তমে, তুমি যে বীর স্ত্রী। তোমার কি এ দুর্বলতা সাজে?
হেকতর-পত্নী আন্দ্রমেকি বললেন–না পতি! দুর্বলতা আমার সাজে না। যাও, যুদ্ধ করতে যাও, তবে এ বেদনা যে সহ্য করতে পারি নে।
হেকতর বললেন–আমাদের এই যুদ্ধ ধর্মের নয়। পেরিস মেনেলাসের পত্নীকে চুরি করে এনেছে, তা তুমি জান। ত্রয়ের প্রত্যেক বীরের পতন হবে, এ নগর ধ্বংস হবে, রাজপ্রাসাদ ধুলোয় মিশবে–এ আমি বলে রাখছি! রাজপরিবারের প্রত্যেকের কঠিন শাস্তি হবে। যে দিন বিজয়ী গ্রিক-সৈন্য ত্রয় নগর ধ্বংস করে পরাজিত শত্রুদের স্ত্রী-কন্যা ধরে নিয়ে যাবে, সে দিনের কথা মনে হচ্ছে। বীর হেকতরের রাজকুল-সেবিকা পত্নীকে একদিন গ্রিকেরা দাসীরূপে বিক্রয় করবে। কোথায় থাকবে তোমার শিশু আর কোথায় থাকবো
আমি। কোনো দূর দেশে কার বাড়িতে তুমি পানি তুলবে, এ দৃশ্য মনে উঠলেও যে আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছে।
হেক্তর-পত্নী বললেন–স্বামী, ত্রয়নারীরা কি এতই দুর্বলা? তারা নারীরূপে স্বামী সেবা করে, প্রয়োজন হলে অসি ধরে যুদ্ধ করতেও জানে। তারা যেমন কটাক্ষ হানতে পারে, তীর নিক্ষেপ করতেও তারা তেমনি অভ্যস্তা। আমাদের জন্যে ভেবো না। বীরপত্নী জানে, সম্মান রক্ষার জন্যে কী করতে হয়। অসম্মান অপেক্ষা মৃত্যুই সে ভালবাসে।
শিশু ও পত্নীর মুখে চুম্বন দিয়ে হেক্তর বললেন–তবে বিদায় দাও।
পত্নী হেরের স্কন্ধে মাথা রেখে অতিকষ্টে বললেন–যাও স্বামী যাও। খোদার হাতে তোমাকে সমর্পণ করলাম।
হেক্তর ঘোড়া ছুটিয়ে পেরিসের ঘরের দিকে এলেন। ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন–পেরিস, পেরিস, এ কি হেলেনকে নিয়ে আলাপ করবার সময়? সারা দেশের পুরুষ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিচ্ছে, আর তুমি এখানে রমণীর সঙ্গে প্রেম করছ! হায়, কেন তোমার ন্যায় নরাধমকে খোদা আমাদের ভাই করে পাঠিয়েছিলেন? ভিতর বাড়ি হতে বের হও।
পেরিস লজ্জিত হয়ে বাড়ির বের হয়ে এলো। তার হাতের তলোয়ার সূর্যরশ্মিপাতে ঝিকমিক করছিলো।
নগরের লোকগুলিকে আবার উপাসনা করতে বলে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটলেন।
তখন বেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। সৈন্যরা সারাদিন যুদ্ধ করে হয়রান হয়ে পড়েছে। শত্রু সৈন্যের সম্মুখীন হয়ে হেক্তর বললেন–হে গ্রিক সেনানী। দুর্বল সৈন্যদলকে বিশ্রাম করতে দাও। আজকার মতো যথেষ্ট রক্তপাত হয়েছে। এখন তোমাদের কোনো বীরকে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে দাও। এখন হাতিতে হাতিতে লড়াই হোক পিঁপড়ে দলের কামড়া-কামড়ি দেখে আর কাজ নেই! কে আছ, এগোও দেখি। হেকতর
আজ একা যুদ্ধ করে গ্রিসের যুদ্ধসাধ মিটাবে।
বৃদ্ধ নেস্তর গর্জে উঠে বললেন, কী, এত বড় কথা! এখনও গ্রিসের কোনো বীর দুর্বৃত্তকে শিক্ষা দেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে না? কী বলবো! যদি যৌবনের তরল রক্ত আজ আমার বাহুতে থাকতো, তা হলে এতক্ষণে হেতরের মাথা দেহের সঙ্গে থাকতো না! নেস্তরের দাপটে একদিন পাহাড় কেঁপেছে। আজ আমি অকর্মণ্য বলে কি সকলেই অকর্মণ্য?
সঙ্গে সঙ্গে নয়জন বীর লাফিয়ে উঠে বললেন–আমি হেরের সঙ্গে যুদ্ধ করবো!
বাহুতে কে কত বল ধরে তা দেখাবো। এচিলীস যুদ্ধক্ষেত্রে নেই বলে কি এখানে আর কোনো বীর নেই।
নয় জনের সঙ্গে একা হেকতরের তো যুদ্ধ হবে না।
নয় জনই শূন্যে তলোয়ার ছুঁড়ে বললেন–যার তলোয়ার সকলের উপরে উঠবে, সেই যুদ্ধে যাবে। বীরবর বড় আজাকের বৃহৎ তলোয়ার ভো ভো করে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল। হের ঊর্ধ্বে সেই ভীষণ তলোয়ারের ঘূর্ণমান চক্র দেখে একবার কেঁপে উঠলেন। বীর আজাকই জয়ী হলেন। গ্রিক সৈন্যেরা জয়ধ্বনি করে উঠলো।
এগামেমনন বললেন–বীরশ্রেষ্ঠ আজাক, হেৰ্তরের দর্প চূর্ণ করবার জন্যে তুমিই উপযুক্ত।
অদূরে হেকতর ক্রুদ্ধ ব্যাঘের মতো দাঁড়িয়েছিলেন। আজাক একবার তার দিকে চেয়ে দেখলেন উত্তেজনায় হৃৎপিণ্ড তাঁর ঘন ঘন কাঁপছিল।
তার পর সেই ভীষণ চেহারা আজাক ঘোড়ায় চড়লেন। মুহূর্তের জন্য কেন যে হেকতরের প্রাণ কেঁপে উঠলো। উভয় দলের সৈন্যগণ এই দুই মহাবীরের জীবন-মরণ লড়াইয়ের দিকে চেয়ে রইল।
হেকতরের উন্নত বিশাল বক্ষ, তার দীর্ঘ কঠিন বাহু, শক্তিশালী অশ্ব সেই রণভূমির বালুকণার প্রাণে পর্যন্ত ভয়ের সঞ্চার করছিল। মহাবীর আজাক এহেন বীরকে তুণের সমান জ্ঞান করলেন। যখন তিনি পাহাড়ের মতো উঁচু মাথায় হেকতরের সম্মুখীন হলেন তখন গ্রিক সৈন্যদের প্রাণ জয়োল্লাসে নৃত্য করতে লাগলো। কারণ ত্রয়বাসীদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হেকতর যদি হেরে যায়, তা হলে দুদিনেই ত্রয় নগর ধ্বংস করে হেলেনকে উদ্ধার করা যাবে।
হেকতর আজাকের পানে তার বর্শা নিক্ষেপ করলেন। পাহাড়ের গায়ে মাটির দলার যেমন দূরবস্থা হয়, হেরের বর্শাও তেমনি অবস্থা হল। সে কী ভীষণ আঘাত! বুকের উপরকার লোহার চাঁদর ভেদ করে হাড়ে যেয়ে লাগতো, যদি না হেক্তর মুহূর্তের মধ্যে উপুড় হয়ে বর্শা বেগকে একটু কমিয়ে দিতেন।
দুই হিংস্র ব্যাঘের মধ্যে যেমন করে লড়াই হয়, হেক্টর ও আজাকের তেমনি লড়াই। চলতে লাগলো। একখানি প্রকাণ্ড পাথর তুলে হেক্তর আজাকের উপর ছুঁড়ে ফেল্লেন, কিন্তু আজাকের তাতে কিছুই হল না। আজাকও প্রতিশোধ নেবার জন্য ততোধিক বড় একখানা পাথর নিয়ে হেকতরের মাথা সোজা নিক্ষেপ করলেন, কপালগুণে পাথরখানি হেকৰ্তরের হাঁটুতে যেয়ে লেগেছিল, নইলে তখনই তাকে যমের বাড়ি যেতে হতো।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল। উভয় বীর তলোয়ার নিয়ে যুঝতে যাচ্ছিলেন এমন সময় উভয় পক্ষের সৈন্যগণ চিৎকার করে বল্লে–সাবাস! সাবাস! কিন্তু আর নয়! আজকের মতো এই পর্যন্ত থাক। আঁধার হয়ে এসেছে। আজাক বল্লেন–হের প্রথমে আমাকে যুদ্ধে আহ্বান করেছে, যুদ্ধ স্থগিত রাখবার জন্যে প্রথমে তারই প্রস্তাব করা উচিত।
হেক্তর বল্লেন–আজাক, আপনার বীরত্বে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি, আসুন, আজ আমরা যুদ্ধে ক্ষান্ত দি। জাতির জন্যে যুদ্ধ করতে এসেছি সুতরাং আপনাতে আমাতে কোনোই শত্রুতা নেই। বন্ধুরূপেই আজকের মতো আমরা বিদায় নিই। তার পর আর এক শুভদিনে আমাদের পরস্পরের বল পরীক্ষা হবে।
আজাক বল্লেন–বেশ।
অতঃপর উভয়ে উভয়ের নিকট থেকে বিদায় নিলেন! আজাক হেরকে একটা সোনার কোমরবন্ধ উপহার দিলেন, হেরও আজাককে একখানা তলোয়ার দিলেন।
সে রাত্রিতে সমস্ত গ্রিক সৈন্য আজাককে নিয়ে আমোদ উৎসবে কাটিয়ে দিল।
০৬. পরের দিনও ভয়ানক যুদ্ধ হল
পরের দিনও ভয়ানক যুদ্ধ হল। ত্রয়-সৈন্যরা গ্রিক সৈন্যদেরকে একেবারে সমুদ্রতীরে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। নেস্তর, ওদেসিজ প্রভৃতি বীরগণ বড় অস্থির ও ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
এয়বাসীরা সারা রাত্রি ধরে ময়দানে বসে আগুন জালিয়ে কাটাল, পরদিন গ্রিকদিগকে একেবারে সাফ করে ফেলবে, এই তাদের উদ্দেশ্য। জয়ের আনন্দ তাদিগকে একেবারে পাগল করে তুলেছিল।
এদিকে গ্রিকেরা রাত্রিকালে এক সভা করলেন। অবস্থা তো খুবই শোচনীয়, কাল কী ভাবে শত্রুদলকে বাধা দিতে হবে, তারই জল্পনা-কল্পনা চালাতে লাগল।
নেস্তর বললেন–শত্রুরা এখন কী করছে, তার সংবাদ নেওয়া দরকার। কিন্তু কে প্রাণ হাতে করে এই দুঃসাহসের কাজ করবে? শক্রদলের কাছ দিয়ে যাতায়াত করলে হয়তো জীবন দিতে হবে।
দায়োমিদাস বললেন–এ কাজ আমি করব, কিন্তু আমার সঙ্গে আরও একটি লোক চাই!
দায়োমিদাসের কথা শুনে কয়েকজন বললে–আমরা যাবো। এদের মধ্যে ওদেসিজও ছিলেন। দায়োমিদাস ওদেসিজকেও সঙ্গে নিতে ইচ্ছা করলেন কারণ ওদেসিজ যেমন বীর তেমনি তার বুদ্ধি বেশি।
তার পর দুই বন্ধু অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শত্ৰুদলের দিকে আস্তে আস্তে পা ফেলে অন্ধকারে বেরিয়ে পড়লেন।
শক্রদলের নিকটবর্তী হলে তাঁরা দেখতে পেলেন, একটি লোক অন্ধকারে হেঁটে আসছে। দায়োমিদাস ওদেসিজের গা চেপে মৃদুকণ্ঠে বললেন–দেখতে পাচ্ছ লোকটিকে?
ওদেসিজ–হ্যাঁ আস্তে–ও আমাদের সৈন্য-দলের দিকে যাচ্ছে–নিশ্চয়ই ও হেরের গুপ্তচর। দায়ে এখন কী করা যায়? তীর ছুঁড়বো?
ওদে–না, সবুর কর। মারাবার আগে ওর কাছ। থকে কিছু আদায় করতে হবে। চল, ওর পিছনে পিছনে যাওয়া যাক, আমাদের সীমানার মধ্যে গেলেই ওকে পাকড়াও করবো, আর তার পর যা করবার আছে, করবো।
লোকটি নিঃসন্দেহে অগ্রসর হচ্ছিল, চোরের উপর যে বাটপাড়ি হচ্ছে, তা সে বুঝতে পারে নি।
গ্রিক সীমানায় পা দেওয়া মাত্র কে বজ্রগম্ভীর জিজ্ঞাসা করলেন–কে?
লোকটি ভীত-চকিত হয়ে এদিক ওদিক চাইতেই ব্যাঘ্র যেমন মেষকে ধরে তেমনি করে দুই বীর লাফিয়ে এসে লোকটির গলা চেপে ধরলেন। সে বাধা দেবার বিন্দুমাত্র সময় পেলো না।
কাদ কাদ হয়ে সে বললে–আমাকে দয়া করে প্রাণে মারবেন না। আমার কোনো দোষ নেই। হেক্তর অনেক টাকা ঘুষ দিয়ে আমাকে এই কাজ করতে পাঠিয়েছেন।
ওদেসিজ তার ঘাড়ে একটা নাড়া দিয়া বললেন–ঠিক ঠিক উত্তর দাও, তা হলে বেঁচে যাবে। শত্রুরা কোথায় কি ভাবে আছে সব বল। কেন এখানে এসেছ? লোকটি বললে নিতান্ত বেসামাল হয়ে তারা নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। আপনারা যদি এখন তাদেরকে আক্রমণ করেন, তা হলে তারা কুকুরের মতো পালাবে। একটা প্রকাণ্ড আগুনের কুণ্ডুর দিকে হাত উঠিয়ে বললে, ঐ ওখানে হেত্তর শুয়ে আছে। থেবসের রাজা এসেছে, সেও সেখানে আছে। তার সোনার সাজপরা ঘোড়াগুলিও বাইরে বাধা আছে। ওদেসিজ বললেন–দুর্বৃত্ত, প্রাণের মায়ায় স্বজাতির সর্বনাশ করতে অগ্রসর হয়েছ? তোমার জীবনের জন্য সহস্র লোকের মৃত্যু কামনা করছ। ধর, তোমার উপযুক্ত শাস্তি গ্রহণ কর। এই কথা বলে ওদেসিজ হতভাগ্যের গলায় তলোয়ার বসিয়ে দিলেন। স্থানটি রক্তে রক্তময় হয়ে গেল।
তার পর তাঁরা ধীরে ধীরে খুব সতর্ক ভাবে পা ফেলে থেবসের রাজা আর সেই সোনার সাজপরা ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়েছিল সেখানে উপস্থিত হলেন। অঘোরে মহাসুখে তারা নিদ্রা যাচ্ছিল। প্রহরীরাও ঘুমে কাতর হয়ে মাথা ঢুলোচ্ছিল।
ওদেসীজ বললেন–এই দুটি প্রহরীকে আগে শেষ করে ফেলি। এই কথা বলেই একটুও দেরি না করেই ওদেসিজ তাদের ঘাড়ের উপরে পড়ে দেহ হতে মাথা ছিঁড়ে ফেললেন।
দায়োমিদাসও প্রায় বার জন লোককে মেরে ফেললেন।
দায়োমিদাস বললেন–ওদেসিজ এইবার সরে পড়া যাক। এখনও কেউ জাগে নি, জাগলে সর্বনাশ হবে। আস্তে আস্তে ঘোড়াগুলিকে সরিয়ে ফেল।
ওদেসিজ আর দেরি করলেন না। গোড়াগুলো লাগাম ধরে বের করে আনলেন। তারপর দুজনে দুটির পিঠে চড়ে ঘোড়াগুলো নিয়ে দিলেন ছুট।
প্রাতঃকালে নেস্তর তাঁর তাঁবুর সামনে দেখলেন–ওদেসিজ, দায়োমিদাস আর একপাল ঘোড়া। নেস্তর বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন–এ কী? এ ঘোড়া তো জীবনে দেখি নি! কোথা হতে এগুলি এনেছ? জীবনে বেঁচে এসেছ, তাই কত–এর ওপর ঘোড়াগুলি কোথা থেকে এল? এ ঘোড়া তো যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না?
ওদেসিজ বললেন-থেবসের লোকেরা প্রিয়াম রাজার সঙ্গে যোগ দিয়েছে, যুদ্ধে স্বয়ং তাদের রাজা এসেছেন। এসব তাঁরই ঘোড়া, আমরা অনেক রাত্রে তাদের অনেক লোককে মেরে ফেলে ঘোড়া নিয়ে পালিয়ে এসেছি।
নেস্তর আনন্দে বললেন–ধন্যবাদ তোমাদেরকে।
দায়োমিদাস বললেন–বিপক্ষেরা এখনই যুদ্ধে নামবে, এ শয়তানী তারা সহ্য করবে। অতএব আনন্দ করবার সময় নেই, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।
এগামেমনন ও আর আর বীরগণ ওদেসিজ ও দায়োমিদাসকে সাদর সংবর্ধনা করলেন, অতঃপর বিশ্রামের পর সিঙ্গা, ঢোল ও অন্যান্য বাদ্য বাজিয়ে তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলেন।
অসংখ্য গ্রিক সৈন্য কাতারে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকূল হতে সম্মুখ দিকে অগ্রসর হতে লাগল। ওদিক থেকে ত্রয়-সৈন্যও এগিয়ে এল। তার পর ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হল।
তীর, বর্শা ও তলোয়ারের হানাহানি সমানে চলতে লাগল-ধীরে ধীরে সৈন্যে সৈন্যে মারামারি কাটাকাটি শুরু হল। বাপরে, সে কী ভয়ানক ব্যাপার! কত কাটা মাথা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল, কার ঘোড়া মাটিতে শুয়ে পড়ল, কত সওয়ার তীরের আঘাতে প্রাণ দিল।
আজ এগামেমনন ভয়ঙ্কর বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছেন। শত শত মানুষকে তিনি কেটে ফেলে দিলেন, তবুও তার লড়াইয়ের তৃপ্তি মিটছে না। অনবরত আগুনের তুবড়ীর মতো যুদ্ধক্ষেত্রে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে লাগলেন। শেষকালে হঠাৎ তীর এসে তার পাশে লাগল, রক্তাক্ত দেহে তিনি ময়দান হতে ফিরে যেতে বাধ্য হলেন।
এইবার হেক্টর বীর-বিক্রমে গ্রিক সৈন্যের সম্মুখীন হলেন। সারারাত্রি জেগে দায়োমিদাস ও ওদেসিজ খুব শ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তবুও তারা ভয়ানকভাবে যুদ্ধ করছিলেন।
দায়োমিদাস হেৰ্তরের মাথায় এমন একটা ভয়ানক আঘাত করলেন যে, হেকতর চোখে সরষে ফুল দেখলেন। দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে কষ্টকর হল। এমন সময় পেরিস। দায়োমিদাসের হাতখানা গুলতি ছুঁড়ে ভেঙ্গে দিলেন। দায়োমিদাস বেদনায় অস্থির হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করলেন। বীরদের মধ্যে একা ওদেসিজ রইলেন।
একা ওদেসিজের পক্ষে এত গুলি শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করা খুব শক্তকথা। হরিণকে শিকারী কুকুরেরা যেমন করে ঘিরে ফেলে, ত্রয় সৈন্যরাও তেমনি করে ওদেসিজকে ঘিরে ফেলল। যুঝতে যুঝতে তিনিও জখম হলেন। ঊরু হতে দর দর করে রক্ত পড়তে লাগলো। বহুদূরে বড় আজাক ও মেনেলাস ছিলেন–ওদেসিজ চীৎকার করে ডেকে বললেন–একবার এদিকে এস, একা আর পারছি নে, আমার শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। মেনেলাস আর আজাক তীরবেগে ছুটে এসে ওদেসিজের লুণ্ঠিত দেহ কাঁধে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র হতে দৌড়ে পালিয়ে গেলেন। পরাজিত গ্রিক সৈন্যশ্রেণীও ক্রমশ হটে আসছিল–শেষে যে যেমন পারল, যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে সমুদ্রকূলে শিরিরের দিকে ছুটতে লাগল।
তোমাদের মনে আছে, আগোমেমনন কর্তৃক আপমানিত হয়ে বীর এচিলীস ভয়ানক মনঃকষ্টে যুদ্ধ ক্ষান্ত দিয়ে জাহাজে বসেছিলেন। জাহাজের মাস্তুলের উপর বসে রোজই তিনি যুদ্ধ দেখতেন। আজও দেখছিলেন। গ্রিক সৈন্য প্রাণ ভয়ে ত্রয় সৈন্য শ্রেণীর সম্মুখ হতে পলায়ন করছে, সমস্ত বীর আহত হয়ে এক এক করে যুদ্ধময়দান ত্যাগ করছে–এ সবই আজ তিনি দেখছেন। জন্মভূমির এই দারুণ অপমানে মন তাঁর ভেঙ্গে যাচ্ছিল। এগামেমননের দুর্ব্যবহারের কথা মনে হয়ে তার মনে আরো দুঃখ হচ্ছিল। তিনি আপন মনে বলতে লাগলেন–এগামেমনন, তোমার অহঙ্কারের জন্যেই গ্রিকবাসীদের আজ এই অপমান সহ্য করতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই খোদার অভিশাপ তোমাদের উপর পড়েছে, নইলে যা কখনও হয় নি তাই আজ হল। এ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে গ্রিক সৈন্য পিঠ দেখায় নি। যাক আমার কী? তোমরা তো আমায় বাদ দিয়েছ, আমি তোমাদের কেউ নই।
কিন্তু তবুও তার মন মানল না। সৈন্যদের অবস্থা জানবার জন্যে বন্ধু আজিজকে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন–কে কেমন আছে, যুদ্ধের অবস্থা কিরূপ ভালো করে শুনে এস।
আজিজ এসে দেখলেন–নেস্তর পেঁয়াজ গোস্ত খাচ্ছেন। তার পার্শ্বে গ্রিক সৈন্যদের চিকিৎসক আহত হয়ে পড়ে আছেন। নেস্তর আজিজকে জিজ্ঞাসা করলেন, কী খবর?
আজিজ বললেন–আপনাদের অবস্থা জানবার জন্যে এচিলীস আমাকে পাঠিয়ে দিলেন।
নেস্তের বললেন–আমরা মরি আর বাঁচি তাতে এচিলীসের কী? এচিলীস আপন মনে রাগ করে বসে আছেন। আমাদের জন্যে কি তার মমতা আছে?–কথাগুলি নেস্তর খুব দুঃখের সঙ্গেই বললেন।
নেস্তর আবার বললেন–ইদীয়মেনাস, ওদেসিজ, এগামেমনন, সবাই আহত হয়েছে। চিকিৎসক স্বয়ং তীরের আঘাতে মৃতপ্রায়। এখন বল, কী করি? ত্ৰয় সৈন্য ক্রমশ তাড়া করে জাহাজের দিকে আসছে। এখনও গড় পার হয় নি–সে চেষ্টাও তারা করবে। তুমি দৌড়ে গিয়ে এচিলীসকে আমাদের শোচনীয় অবস্থার কথা বল। তিনি যদি যুদ্ধে না নামেন, তবে অন্তত তার লোহার পোশাকটি যেন দেন। তুমি সেই পোশাক পরে যদি হয় সৈন্যের সামনে দাঁড়াও তাহলে তারা ভয়ে পালাবে, গ্রিক সৈন্যদের বুকের যথেষ্ট বল আসবে।
আজিজ দেরি না করে সকল কথা জানাবার জন্যে বন্ধুর জাহাজের দিকে গেলেন।
এদিকে গ্রিকদের তৈরি গড়ের ধারে সারি সারি ত্রয় সৈন্য দাঁড়াল, গড় পার হবার চেষ্টা তারা করছিল। হেকতর সৈন্যদেরকে বললেন–বীরগণ, একদিন তো মরতে হবেই, আজ মানুষের মতো মর। অসম্মানের জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী?
অবিলম্বে ত্রয় সৈন্য লাফিয়ে সাঁতরিয়ে গড় পার হতে লাগলো। গড়ের এ ধারে দাঁড়িয়ে গ্রীক সৈন্যেরা অনবরত তীর নিক্ষেপ করছিলো, কিন্তু তাতে কোনো ফল হল না। ত্রয় সৈন্য
অসীম উৎসাহে গড় পার হয়ে একেবারে জাহাজ শ্রেণীর পাশে প্রাচীরের গায়ের কাছে এসে উপস্থিত হল। হেক্তর হুঙ্কার দিয়ে বললেন–ভাঙ্গ প্রাচীর, লাগাও আগুন, মার গ্রিক।
গ্রিক-সৈন্য আরও হটে যেতে বাধ্য হল! প্রাচীরের ওধারে তারা অনবরত কুড়োল দিয়ে শত্রুসৈন্যদের মাথা কাটতে আরম্ভ করলো। কিন্তু তবুও তাদেরকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না।
ক্রয় সৈন্য প্রাচীর ভেঙ্গে এইবার একেবারে জাহাজের নিকেটে এসে উপস্থিত হল। গ্রিকেরা শৃগালের মতো দৌড়ে একেবারে জাহাজে উঠে পড়লো।
হের উচ্চৈঃস্বরে গ্রিকদিগকে বললে–হে শৃগালের দল, পৃথিবীর আলো ছেড়ে এইবার গর্তের মধ্যে পালাচ্ছ। তার পরে নিজের সৈন্যদলকে বল্লেন–তোমরা ক্ষান্ত হয়ো না। গর্ত হতে তাদের লেজ ধরে টেনে বের কর, জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারতে হবে।
হেক্টর ভীষণ আগুন তৈরি করবার জন্যে হুকুম দিলেন।
এচিলীস এখনও নিশ্চেষ্ট ছিলেন। তিনি দেখতে লাগলেন, জাহাজে আগুন ধরবার জন্যে হেক্ক্তর সৈন্যদের হুকুম দিচ্ছেন।
এই সময় আজিজ এচিলীসকে হাত জোড় করে বল্লেন–বীরবর, এখনও কি রাগ মেটে নি? সবই যে ধ্বংস হয়ে গেল!
এচিলীস বল্লেন–হোক সব ধ্বংস তাতে আমার কী? তুমি নিশ্চিত থাক আমার জাহাজের কাছে কেউ আসবে না, আমার নির্বিবাদে পাল তুলে বাড়ি ফিরে যেতে পারব।
আজিজ–তুমি নিজে না কর, তোমার পোশাকটি আমায় দাও।আমি একবার দেখি।
এচিলীস–এই দুঃখের ভিতরেও আমাকে হাসালে! আচ্ছা, যাও আমার পোশাক নিয়ে। যদি পার, তবে ত্রয় সৈন্যগণকে তাড়িয়ে দাও; কিন্তু খবরদার নিচে নেমে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করো না।
এদিকে বীরবর আজাক শেষ পর্যন্ত হয় সৈন্যগণকে বাধা দিচ্ছিলেন কিন্তু আর সম্ভব হচ্ছিল না, তার শিথিল মুষ্টি হতে তলোয়ার খসে পড়ছিল।
এমন সময় আজিজ এচিলীসের লোহার পোশাকটি পরে সেখানে উপস্থিত হলেন। এর মধ্যে সৈন্যরা একখানা জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আজিজের পোশাক হতে সূর্যের রশ্মি বের হচ্ছিল, ত্রয় বাসীরা সহসা থমকে দাঁড়ালো। গ্রিক সৈন্যরাও বিপুল সাহসে এগিয়ে গেল। আজিজ অসি চালনে শত্রুর আক্রমণ ব্যর্থ করে দিতে লাগলেন–বন্ধুর পোশাক পরে আজিজের গায়ে কোথা হতে যেন দৈত্যের বল এলো। হের শঙ্কিত হলেন; কারণ তাঁর বিশ্বাস, এচিলীসের সামনে টিকে থাকা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। মার মার কাট কাট শব্দে গ্রিক বীরেরা ত্রয় সৈন্যগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ত্রয় সৈন্যগণ তেজ-বীরত্বে গড় ও পাঁচিল পার হয়ে এসেছিল, এইবার কাপুরুষের মতো দ্রুত পেছনে হটতে লাগল। হেক্তর এক প্রাচীরের ওধারে যেয়ে গড়ের ভিতর নেমে পড়লেন। এচিলীসের বন্ধু যাকে সামনে পাচ্ছিলেন তাকেই যমের বাড়ি পাঠাচ্ছিলেন। হেরকে পালাতে দেখে তার দিকে ছুটলেন, কিন্তু তাকে ধরা গেল না। রক্ত আর মরা মানুষের স্থূপে আজিজের পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। ঝড়ের বাতাসের মতো গ্রিক সৈন্য ত্রয়-সৈন্যশ্রেণীর উপর যেয়ে পড়তে লাগলো। বড় গাছের উপর আঘাত করলে যেমন শব্দ হয় অথবা পাথরের উপর শাবলের কোপ দিলে যেমন আওয়াজ শোনা যায়, শত্রুশ্রেণীর লোহার আবরণের উপর তেমনি শব্দ করে গ্রিকেরা অস্ত্র চালাতে লাগলো। ত্রয় সৈন্যগণ সে তেজ সহ্য করতে পারল না–তাদের অসংখ্য সিপাই মারা গেল।
০৭. আজিজ যুদ্ধ করতে করতে
আজিজ যুদ্ধ করতে করতে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিলেন, ত্রয়বাসীরা মৃত সৈন্যদের দেহ উদ্ধার করবার জন্যে যথেষ্ট চেষ্টা করছিল, কিন্তু আজিজের বিক্রমের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ান তাদের পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল।
ক্রমে আজিজ ত্রয় নগরের সিংহ দুয়ারে এসে উপস্থিত হলেন, পেছনে সংখ্যাতীত গ্রিক সৈন্য বিজয় চিৎকারে আকাশ কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
সহসা আজিজ শুনতে পেলেন, কোণে একটি গায়েবী আওয়াজ, আজিজ, জয় নগরে তুমি প্রবেশ করতে পারবে না। আজিজ, থমকে দাঁড়িয়ে ভাবলেন–এ কার শব্দ? এ যেন আসমান থেকে আসছে।
হেক্তর তার রথের পার্শ্বে দাঁড়িয়েছিলেন। কে যেন তার কানেও বলে গেল,–হেক্তর দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও না–এ-যে আজিজ এচিলীসের পোশাক পরে তোমাদেরকে ছলনা করছে, অবসন্ন আজিজের সঙ্গে লড়াই কর–সে তোমার হাতেই মরবে।
হের গায়েবি শব্দে চমকে উঠলেন। সারথিকে বললেন–চালাও রথ। রথ আজিজের সামনে আসা মাত্র আজিজ সারথির মাথায় এমন এক আঘাত করলেন যে বেচারা সেই আঘাতে মাটিতে পড়ে গেল। হেক্তর তাঁর প্রিয় সারথির দেহ রক্ষা করবার জন্যে এক লম্ফে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে তলোয়ার নিয়ে আজিজের সামনে খাড়া হলেন–তার পর দুই বীরে লড়াই আরম্ভ হল। হেক্তর মেঘের মতো গর্জন করে সিংহের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আজিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। আজিজও সামান্য নন। হেক্তরের সমস্ত বীরত্ব আজিজের সামনে ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু তা হলে কি হয়, হেরের হাতেই আজিজের মরণ লেখা ছিল। হঠাৎ আজিজের তল পেটে হেরের তলোয়ার বসে গেল। আজিজ যন্ত্রণায় চিৎকার করে মাটিতে শুয়ে পড়লেন। আজ এচিলীসের মাথার টুপি বীরদেহের পোশাক ধূলামাটিতে কলঙ্কিত হল–যে পোশাকের অপমান আজ পর্যন্ত কোথায়ও হয় নি।
হের আজিজের বুকের উপর বসে বলতে লাগলেন–আজিজ, কোথায় এখন বীরত্ব? তুমি জয় নগর জয় করতে চেয়েছিলে? ত্রয়-কুমারীকে গ্রিক যুবকদের দাসী করতে চেয়েছিলে? কোন্ জয় কুমারীকে পাবার আশা করেছিলে–এখন যে কাকে-চিলের খোরাক হলে?
আজিজ রুদ্ধ-কণ্ঠে বললেন–হেকতর এখন আমার অন্তিম কাল, যা বলবার বলে যাও’; কিন্তু মনে রোখো শীঘ্রই এর প্রতিফল পাবে। আমার বন্ধু এচিলীসের হাতে তোমার পরাজয় ও মরণ বাধা রয়েছে। ঠিক এই জায়গাতেই তোমার বীর-দেহের অসম্মান হবে। এই কথা বলতে বলতে অজিজ চিরন্দ্রিায় ঘুমিয়ে পড়লেন–যেন এক গোছা সদ্য-ফোঁটা ফুল গাছ থেকে কে ছিঁড়ে ফেলে দিলো। আজিজ সবে মাত্র যৌবন সীমায় পা দিয়েছিলেন।
হেক্তর কুকুরের খোরাকীর জন্য অজিজের মৃতদেহকে গাড়িতে উঠিয়ে নিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় ভীমবেগে মেনেলাস এসে মৃত আজিজের দেহের পাশে দাঁড়ালেন; বললেন–খবরদার, এ দেহ কেউ ছুঁতে পারবে না। গ্রিক বীরের দেহ শৃগাল কুকুরের খোরাক নয়।
হেকতরকে সরিয়ে দিয়ে গদাধর নামে এক ত্রয় পালোয়ান সামনে এসে বললে–দুষ্ট মেনেলাস, তুই না আমার ভাইকে মেরে ফেলেছিলি? আজ তার উচিত প্রতিফল পাবি–এই বলেই সেই লোকটি মেনেলাসকে আক্রমণ করলে।
মেনেলাস লোকটির ব্যবহারে নিতান্ত বিরক্ত হয়েছিলেন, এহেন ঘৃণিত আক্রমণে এরূপ ক্রুদ্ধ হলেন তা আর কি বলবো।
গদাধরের আক্রমণে মেনেলাসের কিছুই হল না। গদাধর ভেবেছিল, মেনেলাসের মাথাটা কেটে নিয়ে মায়ের কাছে যাবে, তাতে মায়ের শোক অনেকটা কমতে পারে। দুদিন আগেই তার বড় ভাইকে মেনেলাস যুদ্ধক্ষেত্রে মেরে ফেলেছেন। গদাধর বিরক্ত হয়ে মেনেলাসকে আবার আঘাত করলে। মেনেলাস ভাবলেন, এই হতভাগাটিকে আর প্রশ্রয় দেওয়া ঠিক নয়। তলোয়ারখানি উঁচু করে অতি ক্ষিপ্রহস্তে গদাধরের মুখের মধ্যে চালিয়ে দিলেন। আর কি রক্ষা আছে? গদাধর মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল, হুঁ-হুঁ করে তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। দুই এক মিনিটে তার দেহ হতে প্রাণ চলে গেল। কিন্তু এতে মেনেলাসের আনন্দ করবার কিছুই ছিল না, আজিজের মৃত্যুতে তার মন দুঃখে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। অতঃপর আজিজকে তিনি ঘাড়ে করে তুলে নিচ্ছিলেন, এমন সময় বিশ জন ত্রয় সৈন্য তাকে ঘিরে ফেলে। মেনেলাস ভাবলেন, আজিজের দেহ উদ্ধার করতে পারবো না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের প্রাণও যাবে।
আজিজের দেহ ফেলে নিতান্ত অনিচ্ছায় মেনেলাস নিজের দলের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করলেন। পথে বীরবর আজাককে দেখতে পেয়ে আজিজের মরণ সংবাদ দিলেন।
এদিকে হেক্তর আজিজের দেহ হতে লোহার পোশাক খুলে ফেল্লেন। কতকগুলি গ্রিক সৈন্য এসে নূতন করে তাঁকে আক্রমণ করলে। হেক্তর মরা আজিজকে ফেলে পালিয়ে যাচ্ছিলেন এমন সময় তার সঙ্গীরা তাঁকে কাপুরুষ ও ভীরু বলে গালি দিল। তাড়াতাড়ি নিজের পোশাকটি ফেলে এচিলীসের পোশাক–যেটি তিনি এখনি আজিজের গা থেকে খসিয়ে নিয়েছেন, সেইটি পরে নিয়ে ফিলে দাঁড়ালেন। এই পোশাকটি ভারি মূল্যবান, এচিলীসের বাবা বিয়ের দিন তাঁর পরী-শ্বশুরের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এই পোশাক গায়ে দিলে দেহে হাজার হস্তীর শক্তি আসে, সামনে কোনো শত্রু দাঁড়াতে পারে না।
যাই হোক, হেক্তর ফিরে দাঁড়ায়ে আবার আজিজের মরা শরীরটির কাছে গেলেন, গ্রিক সৈন্যও হেকতরে সেখানে একটা ভয়ানক যুদ্ধ লাগলো। বীরগণ একবার সামনের দিকে এগিয়ে একবার পেছন দিকে পিছিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন।
এচিলীস জাহাজের উপর থেকে আবার এই যুদ্ধটি দেখছিলেন। তিরি শঙ্কিত হয়ে মৃদুস্বরে বলতে লাগলেন–খোদা, আমার প্রিয় বন্ধু আজিজের কোনো বিপদ হল না তো? আমি যে তাকে জাহাজ ছেড়ে মাটিতে নামতে নিষেধ করেছিলাম। যদি সে আমার কথা না শুনে থাকে, তা হলে সর্বনাশ হয়েছে।
এমন সময় জনৈক সৈন্য কাঁদতে কাঁদতে এসে এচিলীসকে বলে–হে বীর আপনার বন্ধু আজিজের পতন হয়েছে, গ্রিক সৈন্যের অবস্থা শোচনীয়, বিপক্ষের সামনে তারা কিছুতেই টিকতে পাচ্ছে না। আপনার পোশাকও শত্রু-সৈন্যের হাতে পড়েছে। বহু চেষ্টা করেও সেটির উদ্ধার করতে পারা যায় নি।
এচিলীস উচ্চৈঃস্বরে হায় হায় করে কাঁদতে লাগলেন। পাছে এচিলীস অতি দুঃখে আত্মহত্যা করেন, এই ভয়ে সৈন্যটি এটিলীসের হাত জড়িয়ে ধরলো। সন্তানের গভীর শোকে বিচলিত হয়ে সহসা এচিলীসের পরী-মাতা তিতিশা সেখানে এসে উপস্থিত হলেন! মা শূন্যে বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে বল্লেন-বাপ, কাঁদছো কেন? এই পরাজয় গ্রিকদের অহঙ্কারের ফল–এ যে তোমারই অভিশাপ। তোমার সঙ্গে তারা কি ব্যবহার করেছে, তা। কি আমার মনে নেই?
এচিলীস মাকে দেখে কিছু শান্ত হলেন। বললেন–মা, তোমার কথা ঠিক; কিন্তু আমি যে আমার প্রাণের বন্ধুটিকে হারিয়েছি, সঙ্গে তোমার দেওয়া পোশাকটিও শত্রু-হস্তে পড়েছে। মা আয়ু ফুরিয়ে এসেছে, আমি যেমন আমার বন্ধুর জন্যে শোক করছি, শীঘ্রই আমার জন্যেও তোমাকে তেমনি করে শোক করতে হবে। যে অসম্মান আমার বন্ধুর প্রতি হেক্তর করেছে, তার প্রতিশোধ যদি না নিতে পারি, তা হলে আর বাড়ি ফিরে যেতে চাই নে।
মা বললেন-বাপ, তোমার অদৃষ্টে লেখা আছে যে তুমি যদি হেরকে হত্যা কর তাহলে তোমাকে মরতে হবে।
এচিলীস বললেন–মা, আমার বাঁচবার সাধ নেই, আমার বন্ধুকে নিয়ে তারা শৃগাল ককুরের আহার যোগাবে, আর আমি এখানে বসে থাকব? এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে যেয়ে এখনই আমাকে মরতে হয়, কোনো ক্ষতি নেই।
মা বললেন–তা হলে আজিকে তুমি অপেক্ষা কর। তোমার লোহার পোশাক এখন হেক্টরের গায়ে। আমি যাচ্ছি, কাল তোমার জন্য ন্তুন পোশাক আনবো, তাই পরে যুদ্ধ করবে–এই কথাগুলি বলে এচিলীসের পরী-মা বাতাসের সঙ্গে মিশে গেলেন।
বড় আজাক এখন আজিজের মৃতদেহের জন্যে যুদ্ধ করছিলেন। হেক্তর মৃতদেহটি পায়ের তলায় চেপে ধরে ত্ৰয় সৈন্যদিগতে অগ্রসর হতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। শকুনের দল যেমন করে মরা দেহের চার পাশে হামলা করে ঘিরে আসে, গ্রিক সৈন্যরাও তেমনি করে অজিজের মৃতদেহের চার পার্শ্বে ঘুরছিল।
সে সৈনিকটি এচিলীসেকে বললে–বীরবর, আপনি থাকতে গ্রিক সৈন্যেরা এমন করে অপ্রস্তুত হচ্ছে?
এচিলীস বললেন–তা আমি কী করবো, আমি যে এখন নিরস্ত্র, আমার অস্ত্র নেই, পোশাক নেই কী দিয়ে যুদ্ধ করবো? আজিজের ঢালখানি পেলেও একবার এগিয়ে দেখা যেতো, কিন্তু সেখানি সে নিজেই ব্যবহার করছে।
সৈনিক বললে–যুদ্ধ না করেন এগিয়ে দাঁড়ান; আপনাকে দেখলে সৈন্যদের মনে উৎসাহ আসবে, ত্রয় সৈন্যরাও ভয় পাবে।
এচিলীস গড় পার হয়ে খোলা যুদ্ধক্ষেত্রের পার্শ্বে যেয়ে দাঁড়ালেন। তিনবার আকাশ কাঁপিয়ে তিনি গর্জন করলেন, সে বজ্র গর্জনে আকাশ কেঁপে উঠল। ত্রয় সৈন্যরাও ভয়ে আজিজের দেহ ফেলে সরে দাঁড়াল, সুযোগ পেয়ে আজিজকে একখানা ঢালের উপর তুলে দ্রুত পিছিয়ে এলো।
সূর্য তখন অস্তমিত হচ্ছিল। আজিজকে দেখে এচিলীস কাঁদতে লাগলেন। প্রতিজ্ঞা করে বললেন–যাবৎ না এ মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারি, তাবৎ আমি আমার বন্ধুকে মাটি দেবো না।
ত্রয়বাসীরা সে রাত্রে যুদ্ধক্ষেত্রেই থাকবে, না নগরে ফিরে যাবে ভাবতে লাগলো। হেক্তর বললেন–নগরে ফিরে আর কাজ নেই। অতি প্রত্যুষেই শত্রুকে আক্রমণ করতে হবে।
তখনও রাত্রি ছিল, এচিলীস বাইরে এসে মায়ের অপেক্ষায় সমুদ্রের দিকে চেয়েছিল। হঠাৎ মা পুত্রের জন্য একটি পোশাক ও একখানা নূতন ঢাল নিয়ে তার চোখের সামনে ভেসে উঠলেন। এচিলীস মাকে সালাম করে বিপুল আনন্দে ঢাল ও পোশাক তুলে নিয়ে বললেন–মা, তোমার ছেলেকে দোয়া কর, আজ হয় মৃত্যু নয় জয়।
পোশাকটি রাত্রির মধ্যেই তৈরি হয়েছিল। ঢালে আকাশ, চাঁদ, সূর্য ও তারামণ্ডলীর চিত্র আঁকা ছিল।
পোশাকে দুটি নগরের চিত্র এঁকে দেওয়া হয়েছিল। এক নগরের অধিবাসীরা বিবাহ উৎসবের মত্ত! তারা কনেকে মাথায় করে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। উচ্চৈঃস্বরে সকলে কনের রূপ, গুণ ও গান করছিল। যুবকেরা বাঁশির তালে তালে পা ফেলছিল। রাস্তার ধারে রমণীরা সেই বিবাহ উৎসবে বাঁশির তালে তালে পা ফেলছিল। রাস্তার ধারে রমণীরা সেই বিবাহ উৎসব দেখছিল!
দ্বিতীয় নগরে লড়াই বেধেছে।
পোশাকে একটা বিস্তীর্ণ মাঠের ছবিও ছিল। কৃষকেরা জমি চাষ করছে; মোড় ঘোরাবার সময় মেয়েরা তাদের হাতে এক পেয়ালা করে মিষ্টি শরবত দিচ্ছিল। চাষ করবার সময় লাঙ্গলের যেমন করে মাটি দু-ধারে গড়িয়ে পড়ে ছবিতেও ঠিক তেমনি করে পড়ছিল, এমন চমৎকার ভাবে সে ছবি আঁকা।
পোশাকে শস্যে-ভরা ক্ষেতের চিত্রও ছিল। বাতাসে দোল খেয়ে শস্যের মাথাগুলি হেলে হেলে পড়ছে। লোকে গান করে করে শস্যের আঁটি বাঁধছিল, আর ছোট ছোট ছেলেরা সেগুলি মাথায় নিয়ে গাড়িতে তুলে দিচ্ছিলো। দূরে তাদের রাজা বসেছিলেন, আনন্দে তার মুখে হাসি ধরে না–রাজ্য তার শস্য-সম্পদে পরিপূর্ণ।
কতকগুলি লোক একটা ষাড় জবাই করছিল; রমণীরা শ্রমক্লান্ত যুবকের জন্যে রান্না করবে।
একটা লতাপাতা ও ফুলে ভরা উদ্যানের ছবিও ছিল! বাগানের পথে যুবক ও মেয়েরা গান করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হৃদয় তাদের শুদ্ধ ও পবিত্র-আনন্দে ভরপুর।
একস্থানে এক পাল গাভীর চিত্র ছিল। গাভীদের সুন্দর দীর্ঘ শিংগুলি কত শুভ্র। দূরে একটা রক্তচক্ষু ক্রুদ্ধ সিংহ এক ষাড় ধরেছে; ষাঁড়ের গলা দিয়ে অজস্র-ধারায় রক্ত পড়ছে, সিংহ সেই রক্ত খাবে। বড় বড় শিকারী কুকুর সিংহকে আক্রমণ করবার জন্যে ঘিরে দাঁড়িয়েছে, কিন্তু তাদের সাহসে কুলোচ্ছে না। একটা পাহাড়ের ধারে এক পাল মেষ চর ছিল। দূরে একটা ধবধবে ঘর। সেখানে কুমারীরা বাঁশি বাজিয়ে গান করছিল।
০৮. এচিলীসের মা, তিতিশা
এচিলীসের মা, তিতিশার দেওয়া অস্ত্রগুলি প্রভাতের অরুণ কিরণে ঝক ঝক করছিল। তিতিশার পরী সহচরীরা তা দেখে শিউরে উঠলেন।এচিলীসের মন কিন্তু আনন্দে নৃত্য করতে লাগলো, কারণ সেইসব তীক্ষ্ণধার অস্ত্র দিয়েই সৈন্যদের মাথা কাটা হবে। ত্রয়বাসীরা অন্যায় ও পাপ করেছে, সুতরাং তাদের শাস্তি দিতে এচিলীসের মনে কোনো দুঃখ হচ্ছিল না। কি জন্যে যে এই যুদ্ধ বেধেছে তা তো তোমরা জান।
তিতিশা আজিজের মৃতদেহের পাশে বসে ক্ষত স্থানগুলিতে আরক লাগাতে লাগলেন, যাতে ক্ষতগুলি পচে না ওঠে। এচিলীস বাইরে যেয়ে সকলকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন।
গ্রিক সৈন্যরা আনন্দ-উৎফুল্ল মনে বেরিয়ে এলো। আজ মহাবীর এচিলীস যুদ্ধে যাবেন–আর ভয় নেই। আজ গ্রিক সৈন্যের জয়!
ওদেসিজ ও দায়য়ামীদাস খোঁড়াতে খোঁড়াতে (কারণ এখনো তাদের আহত স্থানগুলিতে বেদনা ছিল) বীরবর এচিলীসের কাছে এসে দাঁড়ালেন। এগামেমননও নতমাথায় তাঁদের পেছনে পেছনে এচিলীসের কাছে এলেন। মন তার চিন্তায় ও বেদনার
ভারে অবসন্ন। এগামেমননকে দেখে এচিলীস হাত বাড়িয়ে তার সঙ্গে মোসাফা করলেন। . অতঃপর সকলকে শুনিয়ে বললেন–বন্ধু এগামেমনন, আমার প্রিয় গ্রিক বীরগণ, কি কুক্ষণে বালিকা ব্রীসাসকে নিয়ে আমাদের ঝগড়া বেধেছিল, তার ফলে আজ শত শত গ্রিক প্রাণ দিয়েছে। যদি আমি এমন করে রাগ করে বসে না থাকতাম, তা হলে শত্রু সৈন্যের এতটা বাড়াবাড়ি সম্ভব হতো না। আজ দেশের জন্যে, গ্রিক জাতির সম্মান ও মঙ্গলের জন্যে, আমার মনের সমস্ত গ্রনি দূর করে এগামেমননকে বন্ধু বলে গ্রহণ করছি।
এগামেমনন এচিলীসকে বললেন–যেদিন থেকে তোমার সঙ্গে ঝগড়া করেছি, সেদিন থেকে আমার মনস্তাপের সীমা নেই। তোমার ব্রীসাসকে তুমি নাও, আর আমার যদি কোনো অপরাধ থাকে, ক্ষমা কর।
অতঃপর দুই বন্ধুতে কোলাকুলি হল বালিকা ব্রীসাস এতদিন পর এচিলীসের ঘরে ঢুকে আজিজের দেহের পার্শ্বে বসে অশ্রু বিসর্জন করতে লাগলেন। প্রতি ঊষাকালে আজিজ এচিলীসের সঙ্গে নাস্তা করেছেন, একসঙ্গে বেড়িয়েছেন, একসঙ্গে থেকেছেন। তাঁর পতনে যে ব্রীসাসের মনে খেদ হবে সে আর আশ্চর্য কী! আজিজ বড় ভালো লোক–বেঁচে থাকতে তিনি ব্রীসাসকে বড়ই ভালবাসতেন। ব্রীসাসের সঙ্গে তার সখীরাও চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
কিছু নাস্তা করেই গ্রিক বীরেরা যুদ্ধ ময়দানে নামলেন। আজকের যুদ্ধের বর্ণনা দিতে লেখনী অসমর্থ, এমন ভীষণ যুদ্ধ কোনো দিন হয় নি, হবেও না।
রাজা প্রিয়ামের এক ছেলে সৈন্যদের সম্মুখবর্তী হয়ে এচিলীসকে আক্রমণ করল। যার সামনে পাহাড় পর্যন্ত কাঁপে, তার সামনে এই ক্ষুদ্র ছেলের দাঁড়ানোটাই আশ্চর্যজনক। একটু আস্ফালন করেই সে পালিয়ে গেল।
যে এচিলীসের সামনে পড়েছিল–সে-ই প্রাণ হারাচ্ছিল। অনবরত দুই হাত দিয়ে। শত্রু-সৈন্য কেটে কেটে এচিলীস ত্রয় নগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। রাজা প্রিয়ামের আর এক ছেলে এচিলীসের সম্মুখে পড়তেই সে প্রাণ হারালো। একবার এই সময়ে হেক্তর এচিলীসের সামনে পড়েছিলেন, পাশ কাটিয়ে সরে গেলেন। এচিলীসও গ্রাহ্য করলেন না–এত শীঘ্র তিনি হেক্তরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক না।
জয় সৈন্যেরা হটতে হটতে নগরের নদীর কাছে এসে সারি দিয়ে দাঁড়ালো। এচিলীস ক্রমেই তাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ভয়ে ভয়ে কোনো কোনো সৈন্য নদীর মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়লো, কেউ বা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেবার জন্যে এদিক ওদিক ছুটতে লাগলো। তাদের অনেকে মনে করে ছিল ক্লান্ত এচিলীস নগরের এত নিকটে আসতে কখনও সাহস পাবেন না। কিন্তু যখন তিনি একেবারেই নিকটে এসে উপস্থিত হলেন, তখন নগরের খোলা দুয়ার দিয়ে তারা ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো।
মহাবল নামে এক ত্রয় বীর বুক ফুরিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইতঃপূর্বে প্রায় সকলে এচিলীসের সুন্মুখ হতে সরে পড়েছিল–মহাবলকে সম্মুখে পেয়ে এচিলীস তার দিকেই দীর্ঘ বর্শা নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু মহাবলের ভাগ্যবলেই বর্শা তার গায়ে লাগলো না–নিকটে পাহাড়ের গায়ে লেগে প্রায় তিন হাত পর্যন্ত পাথরের মধ্যে বসে গেল, পাথর হতে বর্শা খুলে এচিলীস মহাবলের দিকে ধাবিত হলেন।
রাজপ্রাসাদের ছাদের উপর বসে রাজা প্রিয়াম ও রানী আজকার এই ভীষণ যুদ্ধ দেখছিলেন–তাঁরা বুঝেছিলেন, এতকাল পরে কে আজ যুদ্ধে নেমেছে, কার সম্মুখ থেকে ত্রয় সৈন্যদল শৃগালের মতো পালাচ্ছে।
রাজার বড় ছেলে হেক্তর তখনও নগরের বাইরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। রাজা তা দেখে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর দুই ছেলেকে ফিরে আসতে না দেখে তিনি বিশেষ সন্দিগ্ধ ও চঞ্চল হয়ে উঠলেন। রাজা উচ্চৈঃস্বরে হেরকে লক্ষ্য করে বললেন–হেকতর আর বাইরে থেকো না ভিতরে ঢুকে পড়ো। এচিলীস যুদ্ধে নেমেছে, আজ আর রক্ষা নেই। তোমার আর দুই ভাই কই? তারা বোধ হয় জন্মের মতো আমাকে ত্যাগ করেছে।
হেক্তর তবুও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন–বৃদ্ধ রাজা আবার বললেন হের তুমি আমার বড় ছেলে, তোমার পতন আমি দেখতে পারবো না। বুড়ো বাপের প্রতি কি তোমার দয়া নেই? তুমি মরলে আমাদেরও প্রাণ থাকবে না? শত্রু সৈন্যকে আর কেউ বাধা দিতে পারবে না। তার পর নিজে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলেন–হায় অদৃষ্ট! নিজের চোখে সন্তানদের মৃত্যু দেখতে হল, আমার মেয়েদেরকে শত্রুরা দাসী করে বেঁধে নিয়ে যাবে, আমাকে হত্যা করে শত্রুরা কুকুরকে খেতে দেবে।
দুই ছেলের অদর্শনে রানীও কাঁদছিলেন। তিনিও বুক চাপড়ে বললেন, ওরে হেকতর, বাবা আমার, তোকে যে এই বুকে ধরে মানুষ করেছি, জননীর আজ্ঞা অবহেলা করবি? তোর শিশু পুত্রের কথাও কি মনে হচ্ছে না, তোর পত্নীও কি তোর কেউ নয়?
হের তলোয়ারের উঁটি ধরে নগরের প্রবেশদ্বারের কাছে প্রাচীরে হেলান দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাহাড়ের ধারে ক্ষুধিত অজগর পথিককে গেলবার জন্যে যেমন তার বিষজিহ্বা বের করে অপেক্ষা করতে থাকে, সাপের নাক দিয়ে যেমন মুহুর্মুহু বিষ নিশ্বাস বের হতে থাকে, হেরের নাক দিয়েও তেমনি করে আক্রোশের আলো বের হচ্ছিল।
হেক্তর আপন মনে বলতে লাগলেন–সন্তান স্নেহে মা-বাপ আজ অন্ধ হয়েছেন। কাপুরুষের মতো এচিলীসের সম্মুখ হতে কেমন করে সরে যাব? এর মতো লজ্জা জীবনে আর আমার নেই–মৃত্যুই শ্রেয়। মা-বাপের স্নেহ,পত্নীর ভালবাসা, লাঞ্ছিত জীবনের কালো কলঙ্ক রেখাগুলি শোধরাতে পারে না। . হেকতর এমন করে ভাবছেন, এমন সময় মহাবীর এচিলীস ঝলসিত তলোয়ার ঘুরাতে ঘুরাতে দৈত্যের বিক্রমে তাঁরে কাছে উপস্থিত হলেন। হেক্তর আগে যাই ভাবুক না, এচিলীসের সেই সংহারী মূর্তি দেখে চমকে উঠলেন। দারুণ ভয় এসে মুহূর্তের মধ্যে তার বুক চেপে ধরলো। তিনি আর দাঁড়াতে পারলেন না। বালক যেমন করে ভয়ে ছুটে পালায়, হেকতর তেমন করে দৌড় দিলেন। এচিলীসও তার পিছনে পিছনে ছুটলেন।
নগরের চতুর্দিককার দেওয়াল বেয়ে এচিলীস প্রাণপণে ছুটতে লাগলেন। একবার দু’বার তিনবার তারা নগরে ঘুরে এলেন। দৌড়ান ব্যাপারেও এচিলীস ভায়ানক পটু। যেখানে ত্রয় মেয়েরা স্নান করতেন আর কাপড় ধুতেন সেই জায়গায় এচিলীস হেরের নাগাল ধরে ফেললেন।
অগত্যা হের ফিরে দাঁড়ালেন। বর্শাখানি ছুঁড়ে এচিলীসকে মারলেন, কিন্তু এচিলীসের ঢালের সঙ্গে লেগে সেখানি দুই ভাগ হয়ে ভেঙ্গে গেল। হের চিৎকার করে বললেন–ওগো, কে আছ এখানে? একখানি নূতন বর্শা দাও। কিন্তু কে তাকে বর্শা দেবে? কেউ সেখানে ছিল না।
এচিলীস তলোয়ার তুলে হেকতরের গলার হাড়ের কাছে এক আঘাত করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভায়ানক চিৎকার করে হেত্তর মাটিতে পড়ে গেলেন। আহা, সে কী শোচনীয় দৃশ্য! ত্রয়বাসীদের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর আজ ধরাশায়ী হলেন–এতকালের মহাবৃক্ষ আজ শিকড়শুদ্ধ উপড়ে গেল! কী পরিতাপ!
হেকতর করুণকণ্ঠে বললেন–বীর এচিলীস! আমি চলোম, আমার সকল গর্ব তোমার হাতে আজ চূর্ণ হয়ে গেল। খোদাতালা তোমার হাতে আমার মরণ লিখেছিলেন। দয়া করে আমার মৃতদেহের উপর অত্যাচার করো না–আমাকে মাটি দেবার ব্যবস্থা করো; আমরা আত্মীয়-স্বজনকে আমার দেহটি দিও।
এচিলীস বললেন–অপদার্থ, যে কিছুক্ষণ আগে আমার পরম বন্ধু আজিজের মরা দেহ নিয়ে এত লড়াই করেছে, সে এই অনুগ্রহ চায় কোন লজ্জায়? তোমার দেহ শৃগাল কুকুরকেই দেওয়া হবে। তোমার মৃতদেহের প্রতি কোন সম্মান দেখানো হবে না, কারণ তুমি ও তোমার দেশের লোক বড়ই হীন। হেক্তর করুণ কণ্ঠে বললেন–তোমার নিষ্ঠুর সংকল্পের কোনো নড়চড় হবে না, কিন্তু মনে রেখো, আমার ভাই পেরিস এই হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
এই কথা বলেই হেরের মৃত্যু হল।
এচিলীস আপন মনে বললেন–কপালে যদি থাকে তবে তাই হবে।
এচিলীসের মনে হল–বন্ধু আজিজের দেহ এখনও গোর দেওয় হয় নি, তিনি সৈন্যগণকে সে দিনকার মতো ফিরতে বললেন।
হেরের দেহ এচিলীসের রথের চাকার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। এতকালের গর্বোন্নত মাথা ধুলোবালির সঙ্গে আছাড় খেয়ে খেয়ে রথের চাকার সঙ্গে গড়িয়ে গড়িয়ে চললো।
হেকতরের মা সে দৃশ্য দেখে হায় হায় করে উঠলেন–বুকে দুই হাত দিয়ে ছাদের উপর বেহুশ হয়ে পড়ে গেলেন।
হতভাগিনী হেকতর-পত্নী আমেকি তখনও তাঁর এই কপালভাঙ্গার সংবাদ পান নি। তিনি সখীদেরকে নিয়ে তাতে বসে কাপড় বুনছিলেন, হঠাৎ বাইরে চিৎকার শুনে চমকে উঠলেন। বললেন–তোমরা কাজ বন্ধ কর, দেখি কী হল–আমার বুক কেন এমন করে করে কেঁপে উঠছে? আমার স্বামী হেরের তো অমঙ্গল হয় নি?
তাড়াতাড়ি ছাদের উপর উঠে দূরে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে তাকিয়ে তিনি যা দেখলেন, তাতে তার মাথা ঘুরে গেল। এচিলীস তার রথের চাকার সঙ্গে স্বামীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। হেতর-পত্নী স্বামীর বোনের কোলের ওপর তখুনি বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।
অনেক চেষ্টার পর যখন হুঁশ হল তখন কপাল মাটির উপর রেখে তিনি বলতে লাগলেন–ওগো স্বামী, এ হতভাগিনী যে এ দৃশ্য দেখতে পারে না; হায়, তোমার কপালে এত অসম্মান লেখা ছিল! সারা সংসার জ্বালিয়ে দিয়েও তো এ অপমানের প্রতিশোধ হবে না, আমার হৃদয় জ্বালা জুড়োবে না। তোমার শিশু যে আমার সঙ্গেই ভিখারি হল; যে ছিল রাজার ছেলে, সে মানুষের খাবার সময় তাকিয়ে থাকবে, তারা হয়তো স্নেহ পরবশ হয়ে এক টুকরো দেবে; কেউ হয়তো চোখ গরম করে খোকার দিকে চাইবে, যাদু আমার কেঁদে ফিরে আসবে! হায়, সে ব্যথা যে আমার সইবে না। ওগো স্বামী, আমার কী হবে? এ শহরের ধ্বংস সুনিশ্চিত–তুমি যখন গেলে, তখন এ শহরের মান-ইজ্জত কে রাখবে? শত্রুরা কুমারীদেরকে দাসী করে বেঁধে নিয়ে যাবে–আমি যে এয় রাজার পুত্রবধূ। আমাকেও হয়তো শেষকালে কোনো গ্রিক সওদাগরের বাড়ি পানি গরম করতে হবে। হায়, তাতেও দুঃখ ছিল না, কিন্তু আমার এ শিশুর কী হবে?
মাথায় আঘাত করে করে হেত্তর-পত্নী আমেকি এমন করে কাঁদতে লাগলেন–তাঁর সখীরাও কাঁদতে লাগলেন।
এদিকে এচিলীস বাসায় ফিরে বন্ধু আজিজের মৃতদেহের কবর দিলেন, তার পরে সকলে মিলে জয়ের উৎসব করলেন–দৌড়া-দৌড়ি, কুস্তি, দাঁড়টানা, লাফানো প্রভৃতি নানা প্রকারের উৎসব হল। খেলা শেষ হলে সকলে বিশ্রামের জন্য গেলেন। সকলে আনন্দ করলেও এচিলীসের কোনো আনন্দের কারণ ছিল না, সারা রাত্রি তার ঘুম হল না, বন্ধু আজিজের বিরহ-ব্যথা তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল।
পরের দিন সকালবেলা প্রতিশোধের জ্বালা জুড়োবার জন্যে এচিলীস হেক্তরের মৃতদেহ রথের সঙ্গে জুড়ে বন্ধুর কবরের চারিদিকে ঘুরাতে লাগলেন। একদিন দুদিন তিনি।
এমনি করলেন, তবুও তাঁর তৃপ্তি হল না। পাছে ছেলের এই ব্যবহারে খোদা অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিতিশা ছেলেকে এই কাজ করতে নিষেধ করলেন।
সন্ধ্যাকালে প্রিয়াম ছেলের জন্যে নির্জনে বসে কাঁদছিলেন।
হঠাৎ তার কি মনে হল তিনি ভূত্যদিগকে রথখানি সাজাতে বললেন। রানীকে বললেন–ঘরে যত রকমের দামি জিনিস আছে সব বের কর। এইসব দিয়ে আমি একবারে গ্রিকদের কাছে যাবো, টাকা দিয়ে বলে কয়ে কোনো রকমে ছেলের দেহ উদ্ধার করতে পারি কি না চেষ্টা করবো।
রানী কেঁদে বললেন-পুত্র গিয়েছে, সব গিয়েছে, শেষকালে তোমাকেও হারাতে হবে। সেই রাক্ষসের মনে কি দয়া আছে? তোমাকে পেলে কিছুতেই তারা ছাড়বে না! আমি যে নারী, নারী হয়ে কেমন করে এত ব্যথা সইব? আমার তিনটি ছেলেকে তারা মেরে ফেলেছে, এবার স্বামীকেও মারবে। জেনে শুনে কে শত্রুর কাছে ধরা দেয়?
রাজা বললেন–রানী, তুমি যাই বলো, আমি কিছুতেই এ সংকল্প ত্যাগ করবো না। একটি বার আমার বাছাকে বুকের উপর ধরতে চাই, তাতে যদি প্রাণ যায়, আপত্তি নেই। তুমি সত্বর আমার যাবার বন্দোবস্ত করে দাও। তোমার কোনো ভয় নেই–আমারও কোনো ভয় নেই। কে যেন আমার বুকের ভেতর থেকে বলছে–গ্রিক বীরদের কাছে তোমার সন্তানকে ভিক্ষা চাও। তোমার ওপর তারা দয়া করবে?
অনেক রাত্রে বুড়ো রাজা বহুমূল্য উপহার সামগ্রী নিয়ে রওয়ানা হলেন। যখন ঘরের কাছে এলেন, তখন তিনি দেখলেন, একটা লোক সেখানে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রাজার মনে খুব ভয় হল। ভাবলেন, এ কোনো কঠিন-হৃদয় পাহারাওয়ালা হবে। কী করি? পালিয়ে যাবো না এর হাত ধরে আমার দুঃখের কথা বলবো।
লোকটি রাজাকে ভদ্রভাবে জিজ্ঞাসা করলে–কে এখানে এত রাতে রথ চালাচ্ছেন?
রাজা বললেন, মহাশয়, আমি ত্রয়ের বুড়ো হতভাগা রাজা, আমি সন্তানহারা। কেন এতরাত্রে এখানে এসেছি, তা কী আপনি দয়া করে শুনতে চান?
লোকটি বললে–আপনার মতলব কী তা আমি বুঝতে পেরেছি। আপনার অবস্থা বুঝে আমার খুব দুঃখ হচ্ছে। আমার দ্বারা যদি কোনো উপকার হয়, করতে রাজি আছি।
রাজা বললেন–আপনার দয়ার জন্য আপনাকে ধন্যাবাদ। দয়া করে আমাকে বীর এচিলীসের কাছে নিয়ে চলুন। লোকটি বললে–আপনি দুঃখিত হবেন না। হেক্টরের দেহের ওপর কোনো অত্যাচার হয় নি। এচিলীসের কাছে যেয়ে আপনার প্রার্থনা জানান, তিনি আপনার ন্যায় বুড়ো মানুষের মনে কিছুতেই ব্যথা দেবেন না।
রাজা এই লোকটির সাহায্যে এচিলীসের তাবুর ধারে এলেন। লোকটি বিদায় গ্রহণ করে কোথায় যেন শূন্যে মিলিয়ে গেল।
এচিলীস তখন সবেমাত্র আহার শেষ করে বাইরে বাতাসে এসে বসেছিলেন, এমন সময় বুড়ো রাজা সেখানে উপস্থিত হলেন। রাজা জানু পেতে বসে তাড়াতাড়ি এচিলীসের হাতখানি ধরে (যে বাহু ত্রয়বাসীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে) চুম্বন করলেন। এচিলীস এবং উপস্থিত আর আর সকলেই অপরিচিত বুড়োর ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলেন।
রাজা শোকপূর্ণ কণ্ঠে বললেন–আমি কে, তা কি এখনও বুঝতে পারেন নি? ত্রয়ের যে বীরকে আজ আপনি হত্যা করেছেন, আমি তারই পাগল বাপ। আপনি নিজের বাপের কথা চিন্তা করুন–তা হলে বুঝতে পারবেন, কি ব্যথা আজ আমার প্রাণে লেগেছে। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে, যে আমার ছেলেকে মেরেছে তাঁর দয়া আজ এই গভীর নিশীতে ভিক্ষা করতে এসেছি। যদি আমায় মেরে ফেলতে হয় ফেলুন, কিন্তু আমার ছেলেকে ফেরত দিন। তার মুখোনি শেষ বার দেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নেবো। আমার মনে অপমান-জ্ঞান নেই। আপনি বীর, আমার প্রতি কি আপনি করুণা দেখাবেন না?
যখর রাজা এই সমস্ত কথা বলছিলেন, তখন সহসা বাপের স্মৃতি এচিলীসের মনে জেগে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে রাজার হাত ধরে তাঁকে তুললেন, দুজনার চোখেই তখন পানি।
এচিলীস বললেন–রাজা, কী করে এই গভীর নিশীথে শত্রু-সৈন্যের মাঝখানে আসতে সাহস করলেন? আর কেঁদে কী হবে? যতই কাঁদুন ছেলে আর ফিরে আসবে না। আমি আপনার শোক বুঝতে পাচ্ছি, আমার বাপকেও একদিন আপনার ন্যায় কাঁদতে হবে, কারণ আমি জানি, যুদ্ধে আমাকেও এখানে মরতে হবে। আমার পথ চেয়ে আমার বাপও বসে আছেন। আমার বাপের বহু অর্থ সম্পদ আছে, পরী-রাজার মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন, তাঁর মনে অফুরন্ত আনন্দ ছিল, কিন্তু এবার তার সে সুখে দাগ পড়বে। আমি আমার বাপের একমাত্র ছেলে। একটু নীরব থেকে বললেন–মানুষের ভাগ্যের কী পরিবর্তন–আজ যে রাজা, কাল সে ভিখারি; আজ যাকে হাসতে দেখা যাচ্ছে, কাল হয়তো দেখা যাবে; দুঃখ-বেদনায় তার মুখ কালো হয়ে গেছে–চোখে তার পানি। হায় দুনিয়া,
এখানে যশ-অহঙ্কারের মূল্য কী–আর সুখই বা কোথায়?
অতঃপর এচিলীস বাবুর্চীকে বললেন, বাবুর্চী, রাজার সম্মানের জন্যে একটা বড় মেষ জবাই করো। তিনি আমাদের অতিথি। আর তাঁর বিশ্রামের জন্যে স্থান ঠিক করে দাও একটু গোপন স্থানে দিও, কেউ জানতে না পারে। কাল আঁধার থাকতেই উনি ছেলেকে নিয়ে যাবেন।
রাজা প্রিয়ামকে সান্ত্বনা দিয়ে পুনরায় বললেন–রাজা, আর শোক করবেন না। যখন এখানে এসেছেন তখন আপনাকে কিছু খেতে হবে। এ সংসারে বহু রাজার ছেলে মরেছে, কিন্তু কোনো দিন কেউ না খেয়ে থাকতে পারে নি। এচিলীসের অনুরোধে রাজা চুপ করে রইলেন।
যথাসময়ে এচিলীস রাজার হাত ধরে নিয়ে দস্তরখানায় বসালেন। রাজা এচিলীসের প্রশংসা না করে থাকতে পারলেন না, এচিলীসও রাজাকে বিস্তর প্রশংসা করলেন। ভোজন। ও দেখাশোনায় মানুষের মনে দুর্বলতা আসে–যে শত্রু এমন করে তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে তার প্রতি অকস্মাৎ রাজা প্রসন্ন হয়ে উঠলেন।
তখনও অল্প আঁধার ছিল, ঊষার আলো ভালো করে প্রকাশ হয় নি। এচিলীস ভৃত্য দিয়ে হেরের দেহ রাজার সঙ্গে গ্রিক সীমা পার করে দিলেন।
এদিকে নগর দুয়ারে অসংখ্য লোক জমা হয়েছিল। রাজাকে ফিরতে দেখে দুঃখের মধ্যেও তাদের মনে আনন্দের সঞ্চার হল। হেকতরের মা পত্নী উভয়ে মৃতদেহকে পাগলিনীর ন্যায় বুকে চেপে ধরতে লাগলেন। আত্মীয়স্বজন ও নগরবাসীরা সে দৃশ্য দেখে না কেঁদে থাকতে পারলেন না। অতঃপর নগর-দুয়ার হতে হেরকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল। পত্নী ও মাতার শোকের শেষ নেই। তারা অত্যন্ত অধীর হয়ে পড়লেন। হেকতর শিশু কোলে বসে স্তব্ধ হয়ে মায়ের এই অস্থিরতা লক্ষ্য করছিল।
হেক-পত্নী শোক করে বলতে লাগলেন–হে স্বামী, আমাকে অনাথিনী করে তুমি, কোথায় চলে গেলে? আমার প্রাণের ব্যথা বোঝবার বয়স এখনও য়ে এই শিশুর হয় নি। শীঘ্রই গ্রিক সৈন্য এসে আমাকে তোমার শিশুসহ বন্দিনী করে নিয়ে যাবে, তার পর আমরা। কোনো গণ্য গ্রামবাসীর বাড়িতে যাবো। তোমার শিশুকে হয়তো কোনো গ্রিক এসে হত্যা করে ফেলবে। তুমি যখন গিয়েছে, তখন, কেউ আর এ নগর রক্ষা করতে পারবে না। তোমার জন্যে আজ সমস্ত ত্রয়বাসী দুঃখ করছে, কিন্তু আমার মতো কঠিন দুঃখ আর কেউ পায় নি। হায়, মৃত্যুকালে তোমার চোখের পানে শেষ চাওয়া চাইতে পারি নি, তোমার তৃষিত মুখে একটু পানি দিতে পারি নি! হায়, হতভাগিনী আমি! এই কথা বলেই তিনি মূৰ্ছিতা হয়ে পড়লেন। কোলের শিশু ছিটকে গিয়ে দূরে পড়ে কিছুই বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগলো।
শাশুড়ি পুত্রবধূর হাত ধরে পুত্রকে লক্ষ্য করে বলতে লাগলেন–হে আমার প্রিয়তম সন্তান, সকল ছেলের চেয়ে তুমি যে আমার অধিক আদরের ছিলে–হায়, তোমাকেই যে আমি প্রথমে পেটে ধরেছিলাম। ওরে হের, তুই যেদিন প্রথম জন্মেছিলি, তোর এই মরণ-বিছানায়ও তোকে সেদিনের মতো তেমনি মধুর, তেমনি সুন্দর, তেমনি হাসি-মাখা দেখতে পাচ্ছি।
তার পর সৌন্দর্যের রানী হেলেনও চোখের পানি ফেলে বললেন–প্রিয় ভাই, আমার সকল দেবরদের চেয়ে তুমিই যে আমায় অধিক স্নেহ করতে। তোমার মুখে কখনও একটা কঠিন কথা শোন নি। তোমার বোন বা আমার কোনো দেবর যখন আমাকে একটুখানি অসম্মান দেখিয়েছে, তুমি ক্রুদ্ধ হয়েছ। বড় ভাইয়ের স্নেহ-মায়া দিয়ে তুমি আমাকে রক্ষা করেছ, আজ তুমি চলে গেলে। তুমি ছাড়া হয় নগরে আমাকে আর কেউ ভালবাসার নেই–আমি যে পাপিনী, অভিশপ্তা হতভাগিনী।
০৯. ত্রয়বাসীরা আজ সভা করছেন
কী কর্তব্য, তাই ঠিক করবার জন্যে ত্রয়বাসীরা আজ সভা করছেন।
জনৈক বৃদ্ধ বললেন—হেক্তর যখন মরেছেন তখন আর কোনো আশা দেখি না। এচিলীসকে বাধা দেয় এমন কোনো বীর আমার নজরে পড়ে না। শীঘ্রই ত্রয় নগর ধ্বংস হবে; গ্রিকরা আমাদের সকলকে পুড়িয়ে মারবে। বাঘ-ভালুক, দৈত্য-দানব কেউ এচিলীসের গতিরোধ করতে পারবে না। অনর্থক ধনে-প্রাণে না মরে, হয় এখন আমরা সকলে মিলে গ্রিকদের দয়া ভিক্ষা করি, আর তা যদি না করি তাহলে ত্রয় ছেড়ে পালিয়ে যাই এই আমার যুক্তি।
প্রিয়াম রাজা বললেন–ইথিওপিয়ার রাজা যখন শীঘ্রই আমাদের সাহায্যের জন্যে আসছেন, তখন না পালিয়ে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করো। কষ্ট যথেষ্ট হয়েছে, আরও কিছুদিন কষ্ট করি। নগর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়াটা কি লজ্জার কথা নয়? এর চেয়ে মরণই ভালো।
জ্ঞানী পেলিমীদাস বললেন–রাজা, ইথিওপিয়ার রাজা হয়তো আমাদের সাহায্যের জন্যে আসছেন; তিনি আসবেন সত্যি, কিন্তু এ কথা কি আপনি ভাবছেন না যে, কত বড় পাপের জন্যে আমরা লড়াই করছি? অমার ইচ্ছা, বিলম্ব হলেও রানী হেলেনকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত–শুধু রানীকে নয়, সঙ্গে সঙ্গে ধন-রত্ন দিয়ে এ পাপের কলঙ্ক মুছে ফেলুন। এই কাজ করলে ধন-প্রাণ, মান-মর্যাদা সব রক্ষা হবে।
জ্ঞানী পেলিমীদাসের কথা শুনে সকলেই–এমন কি রাজাও খুশি হলেন।
রূপমুগ্ধ পেরিস পেলিমীদাসকে অপমানের ভাষায় বললেন–বৃদ্ধ পেলিমীদাস, নগরে এবং ছাত্রদের নিকট তোমার বুদ্ধির মূল্য থাকতে পারে, কিন্তু এখানে নয়! রাজপরিবারের ভালোমন্দ তুমি কী বোঝ? তোমার শুষ্ক ধর্মবুদ্ধি মানুষের কোনো উপকারে আসবে না। তুমি নিজে কাপুরুষ, তাই কাপুরুষের মতোই কথা বলছো। যে ক্ষমতাশালী, সে-ই উচ্চ আসন লাভ করবে–যে উপযুক্ত, সেই জগতে উত্তম জিনিসের অধিকারী। হেলেনের ন্যায় পরী লাভ করবার যোগ্যতা আমার ছাড়া এ জগতে আর কারো নেই।
ঘৃণায় পেলিমীদাস বললেন–হতভাগ্য সে, যে পরস্ত্রীকে চুরি করে।
পেরিস সরোষে বললে ভুল করে যদি তার আর কারো সঙ্গে বিয়ে হয়ে থাকে, সে জন্যে কি আমি দায়ী? আসল কথা, তলোয়ার দেখে তুমি ভয় কর। তুমি জ্ঞানী হতে পার, কিন্তু তুমি কাপুরুষ।
পেলিমীদাস বললেন–শয়তান, কাকে তুমি জ্ঞান শিখাও? তোমার সুন্দরী মাকে যদি কেউ আজ চুরি করে, তা হলে এসব তর্ক কোথায় থাকবে? জগতের সকল মানুষের চেয়ে তোমার স্থান নিচে। মানুষের সমাজে তুমি মুখ দেখিও না। তোমার জন্যেই আমাদের দুর্দশা। তোমার জন্যেই ত্রয় নগর ধ্বংস হবে। আল্লাহ যেন আমাকে তোমার মতো মাথা পাগল না করেন, যেমন আছি তেমনি থাকি।
পেরিসের আর কথা বলবার সাহস হল না। মুখে যে তর্কই করুক না কেন, ভিতরে জানতো তারই কুকর্মের জন্যে তার জাতির মাথায় এই বিপদ। হায়! সে যে হেলেনের, জন্যে একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছিলো–সে প্রাণ দিতে পারে, কিন্তু হেলেনকে দিতে পারে না। হেলেনকে পাহারা দেবার জন্যে কিছুদিন হতে নগর প্রাচীরের সর্বত্র পাহারাদার নিযুক্ত হয়েছিলো।
পরের দিন বহু সৈন্য নিয়ে ইথিওপিয়ার রাজা এলেন। রাজা প্রিয়ায় তাকে পেয়ে মনে উৎসাহ ও আনন্দ লাভ করলেন। রাজা তাকে খুব আদর ও সম্মান করে নগরে আনলেন। আর এ পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বললেন। ইথিওপিয়ার রাজা যেমন বললেন–ভাই, বড়াই করে মুখে অনেকে অনেক কথাই বলে, আমি ওসব বড়াই করতে চাই নে, যুদ্ধকালে যা করবার তা করবো–এখন খোদা ভরসা।
আবার বললেন–পথে সোলমী দেশের অধিবাসীরা আমাদেরকে বড় নাকাল করেছে, নইলে এর অনেক আগেই আসতে পারতাম।
বিলম্ব না করে পরের দিনই যেমন তার অসংখ্য সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে নামলেন। সমুদ্রের ঢেউ যেমন করে ভয়ানক শব্দ করে কূলে সে আছাড় খেয়ে-খেয়ে পড়ে, দুই দলের সৈন্যও তেমনি করে এ ওর গায়ে এসে পড়তে লাগলো। এচিলীস দক্ষিণ দিকে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করছিলেন! সাগর-কূলে ঘূর্ণিবায়ু যেমন করে গাছ-গাছড়া উপড়ে শূন্যে তুলে আছাড় মেরে ফেলে এচিলীসও তেমনি করে হয় সৈন্যদেরকে আছাড় মেরে ফেলছিলেন।
রক্ত-স্রোতে ত্রয়ের মাঠ ভেসে গেল। উভয় দলের বহু বীর প্রাণ হারালেন। রাজা মেমন নেস্তরকে দেখে তার উপর বর্শা তুললেন। নেস্তরের ছেলে যদি হঠাৎ সম্মুখে এসে বাপকে রক্ষা না করতো তা হলে নেস্তের আর রক্ষা ছিল না। বাপকে রক্ষা করতে যেয়ে নেস্তরের ছেলে মেমনের এক প্রিয় বন্ধুকে মেরে ফেললেন। মেমন ভয়ানক রেগে এরূপ। জোরের সঙ্গে তার দীর্ঘ ধনুক তুলে নেস্তরের পুত্রের দিকে ছুঁড়লেন যে, তাতেই সে মাটিতে পড়ে মরে গেল।
চোখের সামনে পুত্রকে মরতে দেখে নেস্তর একেবারে উন্মত্ত হয়ে গেলেন, তিনি উচ্চৈঃস্বরে সঙ্গীগণকে ডেকে তার সর্বনাশের কথা বললেন। রাজা মেমন কম বীর নন–হঠাৎ তার সামনে যেতে কেউ সাহস করলে না। কেউ অগ্রসর হচ্ছে না দেখে নেস্তর নিজেই তলোয়ার ঘুরোতে ঘুরোতে রাজা মেমনের সামনে উপস্থিত হলেন। নেস্তর একে বুড়ো তার ওপর রাজা মেমনের সঙ্গে এঁটে ওঠা তার পক্ষে খুব কঠিন। তিনি প্রাণ হারাতেন নিশ্চয়ই, হঠাৎ রাজা তাকে চিনে বললেন–এ কি, বন্ধু নেস্তর যে! হায় কাঁপাল! আপনার ছেলেকে আমি হত্যা করেছি? এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী হতে পারে? আপনি যে আমার পুরাতন বন্ধু! বাস্তবিকই মেমনের রাজা বীর নেস্তরের একজন পুরাতন বন্ধু। মেমন বললেন–এখান থেকে যান আপনি, আপনার সঙ্গে আমি কিছুতেই লড়াই করতে পারবো না!
নেস্তর মাথা নত করে সে স্থান ত্যাগ করলেন। সন্তানের মৃত্যুব্যথা তার বুক ভেঙ্গে দিচ্ছিল। তিনি এচিলীসের কাছে যেয়ে বললেন–মেমন আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছে, এর প্রতিশোধ চাই।
অবিলম্বে এচিলীস মেমনের দিকে ছুটলেন। দুই বীরে ভীষণ যুদ্ধ বেধে গেল। চারদিকের সৈন্যগণ সে ভীষণ লড়াই দেখতে লাগলো।
দুই বীর ভীষণভাবে যুদ্ধ করতে লাগলেন, মরণ-বাচনের কথা তারা ভুলে গেলেন। তলোয়ার নিক্ষেপের তালে তালে তাদের টুপির পালক কেঁপে উঠছিলো। দুজনের মুখেই। ক্রোধের আগুন ঝলকে ঝলকে জ্বলে উঠছিলো। দুজনের শরীরের ক্ষত-পথ দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো, কিন্তু কারও সেদিকে লক্ষ্য নেই। ওপর হতে ফেরেশতারাও এই দুই বীরের যুদ্ধ দেখছিলেন। কে জিতবে, কে হারবে–তা তাঁরাও ঠিক করতে পারছিলেন না। বাপরে। বাপ, সে কী ভয়ানক লড়াই!
হঠাৎ সূর্য অস্ত গেল, সমস্ত পৃথিবী অন্ধকারে ভরে উঠলো–দর্শকগণ ভীত-বিস্মিত হয়ে চোখ বন্ধ করলে, তার পর চোখ খুলে দেখলেন, ইথিওপিয়ার রাজা মাটিতে পড়ে আছে–আঁধার তখন কেটে গেছে, আবার সূর্য দেখা দিয়েছে। হঠাৎ আবার আঁধার হয়ে গেল, আর সেই আঁধারের মধ্যে রাজার দেহকে যেন অদৃশ্য দুটো হাত শূন্যে তুলে নিয়ে গেল। রাজা মেমনের মা ছিলেন পরী, তিনিই ছেলের মৃতদেহকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়েছিলেন এবং শেষে সাগর-কূলে পাহাড়-মূলে অশ্রুসিক্ত চোখে মাটি দিয়েছিলেন। লোকে বলে, রাজার দেহ কতকগুলি কালো রংয়ের পাখি হয়ে উড়ে গিয়েছিল। আজো তারা সাগরের ধারে উড়ে বেড়ায়।
রাজা মেমনের মৃত্যুতে ত্রয় ও ইথিওপিয়ার সৈন্য ভয়ে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে লাগলো–গ্রিক সৈন্য তাদের পশ্চাতে তাড়া করতে লাগলো। এচিলীসও ভীষণ বেগে আগের দিনকার মতো নগর দ্বারের দিকে ছুটতে লাগলেন, হঠাৎ পেরিসের একটা তীর এসে তার বুকে লাগলো, তখনই এচিলীস মাটিতে পড়ে গেলেন।
ত্রয়-সৈন্য হঠাৎ জয়োল্লাস করে ফিরে দাঁড়ালো! আজ এচিলীসের মৃত্যু হয়েছে, এ অসম্ভাবিত ঘটনায় তারা উৎসাহে-আনন্দে নেচে উঠলো। আর কে তাদের সঙ্গে পারবে! এচিলীস ছাড়া আর কে নগর দখল করবে? বাকি গুলোতে শৃগাল, এয়সৈন্য তাদেরকে মোটেই ভয় করে না।
এচিলীসের সঙ্গে বীর ওদেসিজ এবং বড় আজাকও ঘোড়া ছুটিয়ে চলছিলেন–মাথায় তাদের আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, কিন্তু তখন শোক করবার সময় ছিল না। ফড়িংয়ের পালের মতো শত্রু-সৈন্য তাদের দিকে ছুটে আসছে।
বড় আজাক ঘোড়া হতে হঠাৎ লাফিয়ে পড়ে বললেন–ভাই, শত্রু-সৈন্য ভীষণ বেগে অগ্রসর হচ্ছে, এচিলীসের দেহকে পিঠে করে দৌড় দিচ্ছি, তুমি পেছনে পেছনে এস।
এচিলীসের বিরাট দেহ, তার লোহার জামা এবং অস্ত্র সব পিঠে করে বড় আজাক ভীষণ বেগে দৌড়াতে লাগলেন, আর ওদেসিজ পেছনে পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে লাগলেন।
এচিলীসের মৃত্যুতে গ্রিক সৈন্যরা এত দুঃখ করল যে, সে কথা আর বলা যায় না। কোনো বীরের মৃত্যুতে তারা এত দুঃখ করে নি।
এচিলীসকে যথাসময়ে উপযুক্ত সম্মানের সঙ্গে গোর দেওয়া হল। এচিলীসের মা, ব্রীসাস এবং অনেক পরী এসে আঁখিজলে শেষ কাজ সম্পন্ন করলেন। ছেলের যে এমন করে মৃত্যু হবে, তিতিশা পূর্ব হতেই তা জানতেন। এচিলীসের কবর এখনও রয়েছে, সেকান্দার শাহ যখন ভারত আক্রমণ করতে এসেছিলেন, তখন তিনি এচিলীসের কবরের কাছ দিয়ে এসেছিলেন।
এচিলীসের কবর দেওয়া হয়ে গেলে তিতিশা বললেন–সন্তানহারা মার মনে কী আঘাত লাগে তা আজ আমি প্রকাশ করবো না–আজ আমার বীর সন্তানের মৃত্যুতে আনন্দ করবো, সে কাপুরুষের মতো মরে নি–সে মরেছে বীরের মতো।
সেদিনকার মতো যুদ্ধ স্থগিত থাকলো। এচিলীসের বীর-জীবনের প্রশংসা গীত হতে লাগেলো। সৈন্যেরা নানা প্রকার যুদ্ধ ক্রীড়া ও আমোদ উৎসব করতে লাগলেন। বুড়ো নেস্তর বাঁশি বাজিয়ে গান করতে লাগলেন।
“তিতিশার মতো রূপবতী রমণী গ্রিস দেশে আর নেই; অনেক অনেক দিনের কথা, পেলাস তাকে সাগর কূলে পাহাড় গুহায় পেয়েছিলেন; প্রেম ও ভালবাসায় পেলাস তার আঁচল চেপে ধরেছিলেন–তিতিশা পেলাসের হাত থেকে মুক্তি পাবার বৃথা-চেষ্টা করেছিলেন, তার বিয়ের সময় পরী-মানুষ সবাই যোগ দিয়েছিলেন; তিতিশার ন্যায় জ্ঞানবতী ও গুণবতী মহিলা আর নেই–”।
“তার পুত্র এচিলীসের ন্যায় মহাবীর জগতে আর জন্মে নি।”
সৈন্যেরা সকলে সুগন্ধি শরবত খেতে সকলকে অনুরোধ করলে। পরীরা হাত-ধরাধরি করে গান করতে ও বাঁশির তালে তালে পা ফেলে নাচতে লাগলেন।
গান শেষ হল। তিতিশা নেস্তরের মধুর কণ্ঠ ও বাঁশী বাজানোর প্রশংসা করলেন।
এর পর বিস্তীর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে ষাঁড়ের লড়াই হল। তারপর আজাক দায়োমিদাস কুস্তী করলেন। আজাক দায়োমিদাসের মাথা ধরে চিৎ ক র ফেলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু দায়োমিদাস চালাকির সঙ্গে মাথাটি খসিয়ে নিয়ে আজাকের পায়ের মধ্যে পা দিয়ে তাঁকে মাটিতে ফেলে দিলেন। চতুর্দিকে উল্লাস-চিৎকার ও করতালি হতে লাগলো।
এইভাবে সারাদিন আমোদ-উৎসবে কেটে গেল।
১০. দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে
দিন অতীত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আসল কাজের তো কিছুই হল না। একে একে গ্রিসের সকল বীর মারা গেলেন। একদিন ওদেসিজ বালির মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমন সময়ে একজন যুবককে দেখতে পেলেন। নিকটে যেয়ে জিজ্ঞেস করলেন–তুমি কে?
যুবক বললেন–আমি রাজার ছেলে।
ওদেসিজ–এখানে কী কচ্ছ?
যুবক–মনের আনন্দে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
তার পর সে ওদেসিজকে জিজ্ঞেস করলে–তুমি কে?
ওদেসিজ বললেন–আমি ওদেসিজ, তোমাদের শত্রু।
যুবক–এ জগতে আমার শত্রু কেউ নেই। তুমি কী করে আমার শত্রু হলে?
ওদেসিজ আশ্চর্য হয়ে বললেন–আচ্ছা, আচ্ছা, শত্রু নয়–মিত্র।
যুবক–মিত্র? বেশ। তোমরা এখানে কী করছো?
ওদেসিজ–তোমাদের জয় নগর দখল করা আমাদের উদ্দেশ্য?
যুবক–সে হবার যো নেই।
ওদেসিজ–কেন?
যুবক-নগরের মাঝখানে একটা উপাসনার ঘর আছে। সেখানে বছর বছর একটা বড় ষাঁড় কোরবানি হয়ে থাকে। সেই কোরবানির ষাঁড় যেদিন চুরি যাবে সেই দিন ত্রয়নগর বিদেশীদের হাতে পড়বে, এ আমাদের ধর্ম-শাস্ত্রের কথা।
এই কথাগুলো বলতে বলতে পাগল যুবকটি আপন মনে গান করতে করতে চলে গেল! সে ভেবেছিল, নগরের মাঝখান থেকে কোনো কালে কারো সাধ্য হবে না যে ষাঁড়কে চুরি করে; তাই সে শত্রুর কানে দিতে কিছুমাত্র সংকোচ বোধ করে নি। তার মাথাও কিছু খারাপ ছিল।
যাই হোক, তখন ওদেসিজ ফিরলেন। সমস্ত রাত্রি তিনি অনিদ্রায় কাটালেন। পরের দিন যুদ্ধ স্থগিত রইল।
তার পরের দিন সন্ধ্যাকালে নির্জনে দায়োমিদাসকে ডেকে ওদেসিজ সকল কথা খুলে বললেন। দায়োমিদাস বললেন–এ আর কঠিন কাজ কী? সাহস না করলে এ জগতে কোনো কাজই হবে না। সাহস করে আজ সন্ধ্যায় বেরিয়ে পড়ি। যায় প্রাণ যাবে–হয় হেলেনকে উদ্ধার, নতুবা এখানেই মরবো। অন্যায়কে জয়যুক্ত দেখে জীবন-ধারণ করবো না।
ওদেসিজ ভেবে ভেবে ঠিক করতে পারছিলো না যে, কী করে এত বড় একটা ষাঁড় নগরের ভিতর থেকে এত পাহারাওয়ালার চোখের সম্মুখ দিয়ে চুরি করে আনা যেতে পারে! দায়োমিদাসের কথায় তার মনে উৎসাহ এলো।
সত্যই তো, সাহসী যে সে-ই জগতে জয়লাভ করে–কাপুরুষ কোনো কালে বড় কাজ করতে পারে না। ওদেসিজ বললেন–তা হলে এ কথা আর কাউকে বলা হবে না। মনের মতলব অনেককে বললে তর্কের বন্যায় আসল কাজ মোটেই হয় না। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। কিন্তু একটা কৌশল করে ভিতরে প্রবেশ করতে হবে। নগরের বড় পথে যে পাহারাওয়ালা রয়েছে তার চোখে ধূলো দেওয়া চাই। কিছু খেয়ে দুই বন্ধু এক নির্জন স্থানে যেয়ে ফকিরের বেশ পরলেন–মুখে মাখলেন ধুলো, ছাই আর বালি। দায়োমিদাস পরলেন হাজার জায়গায় ছেঁড়া এক আলখেল্লা। তার পর নিতান্ত দরিদ্র ভিক্ষুকের মতো কণ্ঠস্বরকে পরিবর্তন করে নগর দুয়ারে যেয়ে ভিক্ষার জন্যে হাত বাড়িয়ে বাড়িয়ে এগুতে লাগলেন।
কেউ তাদেরকে বাধা দিল না। ভিতরে প্রবেশ করে ওদেসিজ চুপি চুপি বন্ধুকে বললেন–কোন্ গতিকে ভিতরে প্রবেশ করেছি, এখন কী করে সে জায়গায় যাই?
অনেক নর-নারী রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা করছিল, কেউ তাদেরকে গ্রাহ্য করলে না। কেউ হয়তো দয়া করে তাদের হাতে দু-একটা পয়সা দিলে।
অনেক রাত্রি পর্যন্ত তারা ঘুরে ঘুরে বেড়ালেন, শেষে ক্লান্ত হয়ে এক গাছ তলায় বসলেন। সহসা ওদেসিজ দেখতে পেলেন এক নারীকে।
এ নারী আর কেউ নয় হেলেন। যার জন্যে গ্রিক ও ত্রয় বাসীদের মধ্যে ভীষণ আগুন জ্বলে উঠেছে। ওদেসিজ শিউরে উঠলেন। হেলেন উপাসনা করে ঘরে ফিরছিলেন।
কারো কাছেই মিথ্যা বেশ ধরা পড়ে নি, কিন্তু হেলেনের চোখ ওদেসিজকে চিনে ফেললে। হেলেন ওদেসিজকে দেখেই শিউরে উঠলেন। হেলেন নিকটে এস ভীতি-মাখা কণ্ঠে বললেন–ওদেসিজ, কি ভয়ানক কাজই না করছো! এ শত্ৰুপুরীতে কেন এলে? হায়, এ কালমুখীর জন্যে কত গ্রিক বীর এই অচেনা দেশে প্রাণ দিয়েছে। শেষকালে তোমার মৃত্যুও কি দেখতে হবে? ওদেসিজ দেখতে লাগলেন অবাক হয়ে হেলেনকে–হেলেন তেমনি রূপবতী আছেন। দুঃখ ও চিন্তা তার সৌন্দর্যকে একটু নষ্ট করে নি। ওদেসিজের। মুখ দিয়ে কথা বের হল না।
ওদেসিজ মৃদু স্বরে বললেন–হেলেন, তোমাকে উদ্ধার করবার জন্যে বহু বীর প্রাণ দিয়েছে। আমরাও দিতে এসেছি।
হেলেন সজল নয়নে বললেন-হে বীর, এই পাপিনীকে তোমরা ভুলে যেতে পারলে? কে পরের জন্যে প্রাণ দেয়? বিশেষ করে, নারীর জন্যে রাজার কি পত্নীর অভাব?
ওদেসিজ–হেলেন, তুমি যে আমাদের দেশের মেয়ে, গ্রিকবাসীর রক্ত যে তোমার বুকে! মেনেলাসের একমাত্র পত্নী তুমি। আর কোনো পত্নী তার ছিল না, ভবিষ্যতে আর হবেও না।
হেলেন–আমার স্বামী কি আমাকে গ্রহণ করবেন?-আমি যে কুলত্যাগিনী। আমাকে তিনি খুন করে ফেলবেন না?
ওদেসিজ–নারী ভুল করেছিল বলে কি তার ক্ষমা হবে না?
হেলেন–আবার আমি আমার দেশের মুখ দেখবো? আমার স্বামীকে নিয়ে তেমনি করে ঘর কুরবো? স্বামী আমাকে ঘৃণা করবেন না?
ওদেসিজ–চরিত্রহীন পুরুষকে নারী ঘৃণা করে না। ভুলের জন্যে অনুতাপই শ্রেষ্ঠ শাস্তি।
অতঃপর ওদেসিজ তাদের নগর প্রবেশের কারণ বললেন। হেলেন আঁখিজলে ভেসে বললেন, ত্রয় নগর ধ্বংস হোক আমিই তার ব্যবস্থা করে দেবো। এই বলে হেলেন গভীর নিশার কালো বুক উজ্জ্বল করে ছদ্মবেশী দুই বীরকে নিয়ে শহরের মাঝখানে সেই ষাঁড়ের কাছে এলেন, তার পর বললেন, ওদেসিজ, প্রার্থনা করি খোদা তোমাদেরকে রক্ষা করুন, আমার চোখের পানি যেন ফেলতে না হয়; আমি আর দেরি করতে পাচ্ছি নেপাছে কেউ সন্দেহ করে। এই কথা বলে হেলেন সে স্থান ত্যাগ করলেন।
এদিকে ওদেসিজ ও দায়োমিদাস সহসা অতর্কিতভাবে মন্দির রক্ষীকে আক্রমণ করলেন। দুই বীরের আক্রমণ সে সহ্য করতে পারলো না, দু-এক মিনিটের মধ্যেই সে প্রাণ হারালো।
তার পর দুই বীর ষাঁড়ের গলার রশি ধরে পথ চলা আরম্ভ করলেন। রাস্তাগুলো জনমানবশূন্য, যতগুলো পাহারাওয়ালা তাদের সামনে পড়লো, সবগুলোকেই তারা মেরে ফেললেন। সদর দরজার কাছে সবাই ঘুমিয়েছিল, সুতরাং সহজেই তারা বিনা বাধায় নগর পার হয়ে এলেন।
পরের দিন বিপুল আনন্দে গ্রিক সৈন্যরা বিপুল বেগে আবার যুদ্ধক্ষেত্রে এসে দাঁড়ালেন। দুই দলে ভীষণ যুদ্ধ হল কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় ঘিকেরা কোনই সুবিধা করতে পারলে না।
শেষে একদিন সমস্ত গ্রিক সৈন্য ও গ্রিক বীরদিগকে এক সঙ্গে করে ওদেসিজ বললেন, ভাইগণ, যুদ্ধ করতে করতে একেবারে শেষ হয়ে চলোম, কিন্তু তবুও তো আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির কোনো আশা দেখি না। আমি এক মতলব করেছি, কোনো বিশেষ কৌশল করে যদি জয়লাভ করতে পারি, নইলে আর কোনো আশা নেই। সকলে জিজ্ঞাসা করলে, কী মতলব?
ওদেসিজ বললেন, আমাদেরকে প্রকাণ্ড একটা কাঠের ঘোড়া তৈরি করতে হবে–এতবড় ঘোড়া যার পেটের মধ্যে দু’শো সাহসী বীর লুকিয়ে থাকতে পারে। ঘোড়া তৈরি হলে আমাদের দুশো সৈনিক সেই ঘোড়ার পেটের মধ্যে লুকিয়ে থাকবে। আর একটি লোককে হাতপা বেঁধে ঘোড়ার পায়ের কাছে রেখে দিতে হবে। তার পর সমস্ত তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে বাকি সকলে জাহাজ ছেড়ে চলে যাবে। এমন ভাব দেখাতে হবে যেন আমরা ত্রয় অধিকার কবার আশা ত্যাগ করে যাচ্ছি।
তার পর যখন ত্রয়বাসীরা আমাদেরকে পালিয়ে যেতে দেখে উল্লাসে বেরিয়ে আসবে তখন দেখবে এই প্রকাণ্ড ঘোড়াটিকে, কৌতূহলী হয়ে তারা এই আজব জীবটাকে শহরের মধ্যে নিয়ে যাবে।
যে লোকটির হাত-পা বেঁধে ছেড়ে যাওয়া হবে–তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলবে সে একজন বিদেশী, দুষ্ট গ্রিক সৈন্যেরা তাকে কোরবানি দেবার জন্যে হাত-পা বেঁধেছিল; সে কোনো রকমে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিল। ত্রয়বাসীরা নিশ্চয়ই এই কথা শুনে লোকটির বাঁধন খুলে দেবে।
তারপর তারা যখন ঘোড়াটিকে শহরে নিয়ে যাবে, সে সৈনিকটিও সঙ্গে যাবে! সময় বুঝে সৈনিকটা কোনো সঙ্কেত করবে, আর সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়ার পেট চিরে আগুনের বেগে সেই দুশো সৈন্য বের হয়ে পড়বে–শহরের ভিতরে একবার প্রবেশ করতে পারলে কি আর রক্ষা আছে! তার পর ত্রয়বাসী ও তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ লেগে যাবে। এদিকে সেই পরিত্যক্ত সৈনিকটাও পাহাড়ের উপরে একটা ভয়ঙ্কর আগুন তৈরি করবে, যা দেখে যারা জাহাজ নিয়ে সমুদ্রের মাঝে অদৃশ্য হয়েছিল তারা অবিলম্বে ফিরে এসে নগর আক্রমণ করবে, ব্যস! এইরূপে আমারা ত্রয় দখল করবো।
ওদেসিজের এই প্রস্তাব সকলেই পছন্দ করলেন। মিস্ত্রি দিয়ে অবিলম্বে একটা প্রকাণ্ড কাঠের ঘোড়া তৈরি করা হল।
ঘোড়া তৈরি হল দুশো জন সাহসী শক্তিশালী বীর অস্ত্র নিয়ে তার পেটের মধ্যে প্রবেশ করলেন। পেটের মধ্যে দুশো লোক ধরে এমন একটা ঘোড়া যে কতবড় তা বুঝতেই পাচ্ছ। আট দশটা হাতি এক সঙ্গে করলে যত বড় হয় ঠিক তত বড়।
তার পর হৈ-হৈ রৈরৈ করে সমস্ত তাঁবু ও অন্যান্য জিনিসপত্র আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল-একটা লোককে হাত-পা বেঁধে ও শরীরে কাদা মাখিয়ে বালির ওপর ফেলে রাখা হল। এদিকে ত্রয়বাসীরা গ্রিক সৈন্যের ভেতরে এই অদ্ভুত অগ্নিকাণ্ড দেখে ভারি আশ্চর্য হল। তারা আরও দেখলো–গ্রিকেরা পোঁটলা পুঁটলি বেঁধে জাহাজ ছেড়ে ত্রয় নগর ত্যাগ করছে।
এই দেখে তাদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে যেতে লাগলো। দলে দলে তারা পলাতক শত্রুর পলায়ন-যাত্রা দেখবার জন্যে সমুদ্রকূলে এসে দাঁড়ালো।
একটা লোককে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দেখে বিস্ময়ে তারা জিজ্ঞাসা করলে তোমার কী হয়েছে?
লোকটি কেঁদে কেঁদে বললে-শয়তানেরা আমার হাত-পা বেঁধে কোরবানি করতে চেয়েছিল, আমি কোনো রকমে রাত্রির অন্ধকারে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছি। এখন তোমরা আমার হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দাও, ব্যথায় মরে যাচ্ছি। সকলে তাড়াতাড়ি তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলে।
সেই প্রকাও ঘোড়াটি দেখে অবাক হয়ে তারা জিজ্ঞাসা করলে–এটা কী?
লোকটি বললে–এটা হচ্ছে প্রকাণ্ড ঘোড়া। ত্রয় নগর জয় করে জয়ের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ। ওটাকে তারা নগর দুয়ারে খাড়া করে রাখতে চেয়েছিল–এত বড় তাদের দুরাশা!
ত্রয় বাসীরা বললে–বটে! আচ্ছা তা হলে গ্রিকদের পরাজয়ের স্মৃতিস্বরূপ ওটাকে আমরা নগর দুয়ারে রাখবো, অনন্তকাল ধরে তাদের কলঙ্ক এই ঘোড়া বুকে করে রাখবে।
যখন তারা নগর-দুয়ারে পৌঁছল, তখন নগরবাসীরা বললে–গ্রিকদের পালায়নের এই কলঙ্কচিহ্নটি প্রথমে শহরে সকল নর-নারীকে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াও। তার পর ওখানে এনে রাখা যাবে। উত্তম কথা বলে তারা সকলে মিলে প্রকাণ্ড জানোয়ারটিকে টানা আরম্ভ করলে। শহরের প্রায় মাঝখানে তারা ঘোড়াটাকে টেনে আনলে, তখন সকলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
সহসা ঘোড়ার পেটের কাছে একটা শব্দ হল। আর কি রক্ষা আছে? গ্রিকবীরেরা হঠাৎ ঘোড়ার পেটের ভেতর থেকে হুড় হুড় করে বেরিয়ে পড়লো। ত্রয়বাসীরা প্রথমে তো অবাক। শেষ কালে তারা গ্রিকদের চালাকি বুঝতে পারলো, কিন্তু তখন আর উপায় ছিল না।
গ্রিকেরা ভয়ানক রকমে তাদেরকে আক্রমণ করলো। একে ক্লান্ত শরীর, তার ওপর গ্রিকবীরগণের এই অতর্কিত আক্রমণে ত্রয়বাসীরা একেবারে নিরুপায় হয়ে পড়লো। শহরের নারী ও শিশুদের মাঝে একটা ভয়ানক আতঙ্কের সঞ্চার হল–যেদিকে পারলো, পালিয়ে যেতে লাগলো।
এদিকে সেই হাত-পা বাঁধা লোকটি দিলে পাহাড়ের চূড়ায় আগুন ধরিয়ে। দুপুর রোদের খরতাপে আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো।
সমুদ্রের মাঝে জাহাজের উপর গ্রিক সৈন্যগণ এই সঙ্কেতের জন্যেই অপেক্ষা করছিল, সঙ্কেত পেয়েই তারা ছোট ছোট নৌকায় তীরবেগে কূলের দিকে ছুটে এলো।
প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই তারা ত্রয় শহরের প্রবেশ দুয়ার আক্রমণ করলো। ভেতর বাহির দুই দিক থেকেই গ্রিকদের আক্রমণ ভয়ানক রকমে চলতে লাগলো।
পেরিস হেলেনকে ফেলে ঢাল তলোয়ার নিয়ে নিচে নেমে এলো। কিন্তু তখন শহরের সকলেই প্রাণভয়ে পলায়ন শুরু করেছে। সৈন্যরাও অস্ত্র ছেড়ে অলি গলিতে ঢুকে পড়েছে। পেরিসের গায়ের রক্ত হিম হয়ে এসেছে–কী ভীষণ পাপ সে করেছে এই কথা মনে করে তার চোখ ফেটে পানি এলো। হায় কেন সে রূপের নেশায় পাগল হয়েছিলো–হায়, তার পরিণাম কী হল–দেশ, রাজ্য, মান-সম্মান, আত্মীয়-স্বজন, অর্থ-সম্পদ সব ধ্বংস হল।
প্রাসাদ দুয়ারে দাঁড়িয়ে পেরিস এই কথা ভাবছে, এমন সময় একটা তীর এসে তার কলিজায় বিদ্ধ হল। সঙ্গে সঙ্গে গ্রিক সৈন্যেরা রাজার বাড়ির মধ্যে জয়ধ্বনি করতে করতে প্রবেশ করলে।
মেনেলাস যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে হেলেনের সন্ধানে ছুটলেন। হেলেন দারুণ আতঙ্কে ওপরে দাঁড়িয়ে ছিলেন–স্বামীকে দেখেই তিনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন; মেনেলাস ধনুক উঠিয়ে বললেন–এক পা এগুবে না।
হেলেন চুপ করে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন। মেনেলাস ইচ্ছা করেছিলেন–হেলেনকে মেরে ফেলতে, কিন্তু পারলেন না! হাত তার অবশ হয়ে গেল।
হেলেন বললেন–অপরাধীকে ক্ষমা কর। মরতে আমরা দুঃখ নেই, কিন্তু আমি যে। পাপ করেছি তার ক্ষমা চাই। মেনেলাস হাত ধরে পত্নীকে নামিয়ে আনলেন।
.
এইভাবে রানী হেলেন উদ্ধার হল। মেনেলাস স্পার্থা শহরে পত্নীকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন। এর পর বহু বছর তারা সুখে বাস করেছিলেন।
বাড়ির পথে ওদেসিজকে অনেক বিপদে পড়তে হয়েছিল। বহু বৎসর ধরে তিনি পথে পথে ঘুরেছিলেন–কন্যার হত্যার জন্যে এগামেমনকে তাঁর পত্নী বিষ খাইয়েছিলেন, এইসব এবং রানী পানীলোপীর কথা আর এক দিন শুনাবো।