“নারীকে যখন পুরুষের সহিত বসবাস করিতে হয় তখন তাহাকে অনেক পরিমাণে পুরুষে সমকক্ষ করিত হইবে, নচেৎ নারীর ভাগ্য ফিরিবে না।”
“পুরুষ সারাজীবন পাপ করিয়া বৃদ্ধকালে দেশমান্য ঋষি হইতে পারেন–আর নারী যদি একটু পথভ্রষ্টই হয় তবেই তাহার সর্বনাশ। বিধাতার দুয়ার তাহার সম্মুখে রুদ্ধ। কী অন্যায়–কী বেদনা! নারী কি মানুষ নহে? পাপী নারীর কথা কেহ আলোচনা করিতেও লজ্জা বোধ করেন। পুরুষ তাহার পাপী লম্পট পিতার চরণধূলি মাথায় লইয়া স্বর্গে যাইবার। ব্যবস্থা করে! কিন্তু অনুতপ্তা পতিতা নারীকে কেহ স্থান দেয় না। এই সব অত্যাচারিত বালিকা ও নারীর জীবনের মূল্য কে দিবে? একটি জীবনের দুঃখের দাম তো সমস্ত বিশ্ব দিলেও শুধবার নয়।”
“আমরা আমাদের নারী-আশ্রমে কী করিতে চাই? আমরা সর্ব প্রথম নারীকে জ্ঞান দিতে চাই। যাহার মধ্যে জ্ঞান আছে সে যে অবস্থায়ই পড়ুক না কেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে। বিশ্বের সম্মুখে নিজের মর্যাদাকে সে গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হইবে। জ্ঞানী মরিবার নয়–সে মাথা নত করিবার নয়। মনে হয় পুরুষ অপেক্ষা নারীর অধিক শিক্ষা আবশ্যক। শিক্ষিতা মাতৃদলের মহিমায় অতি অল্পসময়ে যে কোনো জাতি উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হইতে পারে। বঙ্গদেশের সমস্ত পুরুষের বিদ্যালয় ও কলেজের পুরুষ ছাত্রদের পরিবর্তে যদি মহিলাদিগকে উচ্চ শিক্ষিতা করা যাইত, তবে বাঙালি অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হইতে পারিত। কতকগুলি শব্দ বা অভিধান মানুষ গঠন করে না। ভাবই শক্তির নিঝর। শিক্ষিতা নারী গৃহের কাজ করিতে করিতে সন্তানকে অতি শিশু বয়সেই মহৎ, গরীয়ান ও শক্তিমান করিয়া তুলিতে পারিতেন।”
“বহু রমণী সমাজ-অত্যাচারে গৃহ ছাড়া হয়। জগতের কোথায়ও তাহাদের স্থান হয়। লম্পট ও বদমাইস পুরুষদের জন্য অট্টালিকা।–শিক্ষিত ও বড় লোকের শ্রদ্ধা, উচ্চ আসন এবং উপাসনা মন্দির পর্যন্ত অপেক্ষা করে।
আহা! নারী বলিয়াই কি নারীকে পশু অপেক্ষা ঘৃণিত অবস্থায় রাখিতে হইবে? আমাদের এই শিল্পাগারে সকল শ্রেণীর ও জতির রমণীদের আশ্রয়স্থল হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষার সহিত নানাবিধ শিল্পকার্য শিক্ষা দিয়া আত্মনির্ভরশীল করিয়া দেওয়া হইবে। দর্জির কাজ, মিস্ত্রীর কাজ, পুস্তক বাঁধাই, বস্ত্রবয়ন, আরও বিবেচনা মতো অন্যান্য বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইলে তাহাদিকে অসহায় অবস্থায় কাল কাটাইতে হইবে না–পেটের জন্য রূপ বিক্রয় করিতে হইবে না। মূর্খতা, দারিদ্র ও অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা রমণীর জীবন দুঃখময় করিয়া তুলিয়াছে। তাহারা পুরুষের হাতের খেলনা–ইচ্ছা হইলে পুরুষ কাছে স্থান দেয়, অথবা ফেলিয়া দেয়। মানুষের এ-অধোগতি বাস্তবিকই অসহ্য। আমি এই মহাকার্যে আমার বাৎসরিক ১২,০০০ টাকা আয়ের সম্পত্তি দান করিলাম।”
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
ইহার পর এক বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে। নৈহাটির সন্নিকট মহেন্দ্র নগরের থানা নদীর ধারে অবস্থিত। রাত্রিকালে থানার বারান্দা হইতে মিলের অসংখ্য প্রদীপশ্রেণী দৃষ্ট হয়।
থানার অধীন গ্রামগুলিতে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। স্থানে স্থানে দুই এক ঘর দরিদ্র মুসলমান পরিবার বাস করে। তাহারা অনিচ্ছায় অনেকটা হিন্দু ভাবাপন্ন।
থানার পার্শ্ব দিয়া পূর্ব-পশ্চিম অভিমুখে একটি প্রকাণ্ড রাস্তা। রাস্তার পার্শ্বেই বাজার। বাজারে হিন্দু-মুসলমান দুই শ্রেণীর লোকই সমাগত হয়। খোরশেদ আজ ছয় মাস হইতে এখানকার দারোগা। বড় দারোগা যিনি তিনিও মুসলমান।
সেদিন শনিবার বৈকাল বেলা খোরশেদ ও বড় দারোগা সাহেব থানার বারন্দায় বসিয়া আলাপ করিতেছিলেন, এমন সময় চারিজন চৌকিদার একটি মৃতদেহ লইয়া তাহাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল।
মৃতদেহের মাথায় একটা রক্ত সিক্ত টুপি লাঠির আঘাতে মাথাখানি দুই ভাগ হইয়া গিয়াছিল।
খোরশেদ ভীত ও বিস্ময়ে কুরসি ছাড়িয়া দুই পদ পেছন হাটিয়া কহিল–“কী ভয়ানক!–কে মুসলমানের রক্ত এমনভাবে ফেলতে সাহস করেছে?” তারপর হাঁকিয়া কহিল–“চৌকিদার ব্যাপার কী? বল।”
বড় দারোগা আবুল হোসেন মিঞা বলিলেন–খুবই দুঃখের বিষয়, তবে বিস্মিত হলে চলবে না। সবে দারোগা হয়েছেন, কিছুদিন খুন-জখম দেখে একটু বিস্মিত হবেনই। হৃদয় শক্ত হলে আর এ বিস্ময় থাকবে না।
খোরশেদ। দারোগা সাহেব, মুসলমানের উপর জুলুম দেখলে চিরকালই যেন আঘাত পাই। মুসলমানকে নিষ্পেষিত হতে দেখে মন শক্ত করে রাখব? অসম্ভব।
আবুল হোসেন। মুসলমানের দুর্দশা দেখে মন শক্ত করে রাখতে বলছি না। মুসলমান হয়ে তা কি বলতে পারি? কিন্তু সে যদি অন্যায় কাজ করে–পরের মাথা ভাঙ্গতে গিয়ে নিজের মাথায় আঘাত পায়?
খোরশেদ। মুসলমান অন্যায় করলেও সে মুসলমান। সে যদি চুরি করে তা হলেও আমি ক্রুদ্ধ হই না। সে যদি বিধর্মীকে হত্যা করে তাকে আমি ধন্যবাদ দেই। হিন্দুকে জব্দ করাই মুসলমানের ধর্ম। শয়তান-প্রতিম কলিকাতার মুসলমান গুণ্ডাকে আমি ভালবাসি। হিন্দু ঋষি হলেও আমার শ্রদ্ধালাভ করবে না।
আবুল হোসেন। এ সব আলোচনা এখন থাক। আপনাকে এখনই ঘটনা স্থলে যেতে হবে। চৌকিদার, তোমাদের এজাহার বল।
চৌকিদার ফেলারাম মুচি বলিল–বাবু, হুজুর! এই যে মড়া দেখতে পাচ্ছেন, এ মড়া হচ্ছে আজিজ মিঞার। গত রাত্রে কে বা কারা আজিজকে হত্যা করে গিয়েছে তার ঠিকানা নেই।