.
বিংশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম বলিলেন–প্রিয় হালিমা, গৃহস্থালী সম্বন্ধে বলেছি আরও কিছু বলতে চাই। হালিমা কহিলেন-বলুন, আমি মন দিয়ে শুনছি।
কুলসুম বলিলেন–দোকান থেকে বাকি করে জিনিস আনলে সংসারে শ্রী থাকে না। মহাজনদের কাছে যেমন কৃষক সম্প্রদায় নিজেদের স্বাধীনতা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিক্রয় করে। ফেলে, যে সমস্ত ভদ্রলোক দোকান হতে বাকি নেওয়া আরম্ভ করে, তারাও প্রকারান্তরে দোকানদারদের খরিদ গোলাম হয়ে পড়েন।
স্বামীকে দোকানদারের গোলাম হতে একদম নিষেধ করবে। তাকে স্বাধীন উৎফুল্ল দেখাতেই নারীর ইচ্ছা হওয়া দরকার। ঋণদানে জড়িত চিন্তাক্লিষ্ট স্বামীর মলিন মুখ দেখে নারীর রাত্রে ঘুম না হওয়া উচিত। যেদিন থেকে সংসারে টাকা হাওলাত এবং দোকান হতে বাকি জিনিসপত্র আনা শুরু হয়েছে, সেই দিন হতে পরিবারে উন্নতির পথে একটা ভয়ানক বাধা এসেছে, এটা বিশ্বাস করো। না খেয়ে শুয়ে থাকো, বিনা তেলে তরকারি খেও, ছেঁড়া কাপড় পরো। তবু কাপড়ের বা মুদীর দোকান থেকে কোনো বাকি জিনিস এনে শরীরের শোভা বর্ধন করে বা রসনাকে তৃপ্ত করে দরকার নেই।
বাজে কাজের জন্য স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া না করে এই সব ভুল কাজের জন্য ঝগড়া করা ভালো। বাকি করে হাতি কেনা অনেক পুরুষ মানুষের অভ্যাস। সর্বদা বাকি জিনিস কিনতে নিষেধ করবে।
ঋণগ্রস্ত লোক বা ভয়-ভীতি বিপন্ন স্বামীর পত্নী হওয়া কি অসম্মানের বিষয় নয়?
সংসারে অপব্যয় একদম নিষেধ, আবার পয়সা একদিক দিয়ে বাঁচিয়ে অন্যদিকে বৃথা খরচ করাও মূর্খতা। অতিথি-কুটুম্বের জন্যে সর্বদা আলাদা করে কয়েকটি টাকা রেখে দিলে ভালো হয়। অনেক পরিবার অতিথি-কুটুম্ব দেখে ভীত হয়; এটা যারপর নাই লজ্জা ও ঘৃণার কথা। অতিথি-কুটুম্বের সমাদর করা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।
বেশি করে লেপ ও বিছানা তৈরি করে রেখে দিতে হয়। করছি করবো বলে অপেক্ষা করলে কোনোকালে হবে কিনা সন্দেহ। শীতের সময় মানুষকে লেপ-কাঁথা না দিতে পারলে, বড়ই দুঃখের বিষয়।
আজকাল কতকগুলি লোকের ধারণা হয়েছে, ইংরেজি ফ্যাসনে ঘরে ডিস ও পেয়ালা, রাখলেই ভদ্রলোক হওয়া যায়। এই সমস্ত জিনিসে মানুষ ভদ্র হয় না। মানুষ ভদ্র হয় জ্ঞানে, চরিত্রে ও মনুষ্যত্বে। মানুষের বাপ যেই থাক, সে বর্তমানে যে ব্যবসাই করুক–দেখবার দরকার নেই। দেখতে হবে তার আত্মা, তার রুচি, কথা ও ব্যবহার।
চীনে মাটির বাসন না কেনাই ভালো। একে এগুলি বিদেশী জিনিস, তার উপর ঠোকা লাগলেই ভাঙ্গে। এসব জিনিস না দেখে যে সমস্ত বোকা নারীর দল নাক ছিটকায়, তাদের কথায় ভ্রূক্ষেপ করবার দরকার নেই। শুনছি, আজকাল দেশী চীনে বাসনের কারখানা হয়েছে। দেশী চীনে বাসন ঘরে ২/১ খান রাখা হয়।
কাবুলীদের কাছ থেকে প্রাণ গেলেও ধারে জিনিস কিনতে নেই। দু’টাকার জিনিস এরা। পাঁচ টাকায় বিক্রি করে। অনেক সময় এদের হাতে ভদ্রলোকদের অপমান হয়। এদের সাহসকে কিন্তু খুব ধন্যবাদ দিতে হয়। কোনো দূর দেশ থেকে এসে এরা বাংলার মানুষের গলা চেপে ধরতে ভয় করেন না।
বাড়িতে ফুল কপি, বাঁধা কপি ও গোল আলুর চাষ করতে পারলে ভালো হয়। চাকর রেখে বাগান তৈরি করবার সখ অনেকের হয়ে থাকে, তাতে কিন্তু কোনো লাভ হয় না। নিজের হাতে সব কাজ করতে হবে। ছেলেপেলে এবং স্বামী যদি নিজের হাতে পানি টানে বা কোদাল কোপায়, তাহলে তাদের সমান নষ্ট হবে না। কাপুরুষ ভদ্রলোক যারা, তারাই। হাতে কাজ করতে লজ্জা বোধ করে; ঘুষ খেতে পাপ করতে তাদের লজ্জা হয় না! পবিত্র, পরিচ্ছন্ন, নির্ভীক ও জ্ঞানী আত্মার মূল্যই বেশি।
স্ত্রীলোকদের ঠাণ্ডা লাগান অভ্যাস। শীতে কাঁপবেন তবুও গায়ে কাপড় দেবেন না। পায়ে গায়ে ঠাণ্ডা লাগলে পীড়া হয়। দরিদ্র স্বামী এবং সংসারশুদ্ধ সকল লোককে ব্যস্ত করা বড়ই অন্যায়।
চাকু, কাঁচি ছুরি প্রায়ই হারিয়ে যায়। এগুলি সর্বদা সাবধানে রাখতে হয়। কাজ সেরে যখন তখন বাক্সে বন্ধ করে রাখবে। ছেলেদের হাতে চাকু দেবে না।
ঘরের কাপড়-চোপড় সব সময় গুছিয়ে ঠিকঠাক করে রাখবে। যার যার কাপড় আলাদা করে রাখাই ভালো। কাপড় গামছা খোঁজবার জন্যে যেন সময় নষ্ট না হয়।
দোয়াত-কলম বই-খাতা সব গুছিয়ে রাখবে। ঘরের জিনিসপত্রের ধুলো সব সময় ঝেড়ে ফেলতে হয়।
ছেলেপেলেরা যেন বই-পুস্তক ও কালি কলম নষ্ট করে না ফেলে, সেদিকে নজর রাখবে।
সুঁই ঠিক থাকে না; কাজ হয়ে গেল যেখানে সেখানে ফেলে রাখা হয়। কাজ শেষে যত্ন করে ভালো জায়গায় তুলে রাখাই উচিত। নিত্য নূতন করে সুঁই কিনে সংসারে পয়সা নষ্ট করে লাভ কি? একটি পয়সা বৈধ নয়, একথা কোনো বধূর মুখ থেকে বের হওয়া উচিত নয়। একটা একটা পয়সা দিয়েই তৈরি হয়।
অবস্থা যদি ভালো না হয় তাহলে একবারে বেশি জিনিস কিনবে না। বেশি আনলে, বেশি খরচ হয়।
আহারের জন্য যত সম্ভব ব্যয় করা ভাল, তবু নিজের আয়ের কথাও ভাবতে হবে। হাতে টাকা নেই বা আয় বেশি নয় এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে কম কম খরচ করতে হয়। নইলে উপায় তো নেই। আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় করলে জীবন শেষে শাক-ভাতও জোটে না।
নিজেদের যদি বাড়ি না থাকে তাহলে একটা বাড়ি প্রস্তুত করা ভাল, নইলে স্বামীর অবর্তমানে নিজের ইজ্জত হুরমত থাকে না, অপমানে জীবন যাপন করতে হয়। টাউন অপেক্ষা পল্লীগ্রামে কম খরচ লাগে। টাউনে থেকে দারুণভাবে অনেক বিপন্ন অভাব। পীড়িতা নর-নারী দুষ্ট বদমাইশ হয়, চরিত্র হারায়। পল্লীগ্রামে মানুষের সহানুভূতি বেশি। পাওয়া যায়, অল্প খরচে সংসার চলে।