এবাদ চাহিয়া দেখিল, কথা কহিল না।
তার পর আর একটি ঘর, সাদা ফরাস পাতা। জাপানি মেয়েরা ধধবে আলোর মাঝে গা এলিয়া মানুষের মন চুরি করবার ফন্দিতে ব্যস্ত ছিল। তারপর একটা ঘর। সেখানে কেই নাই। দূর হতে বীণার ঝঙ্কার মানুষের তরল মনকে আরও তরল করে সুন্দরীদের আলতা পরা পায়ের তলে ফেলিয়া যাইতেছিল।
এবাদ কথা বলিল না। তার পর আর একখানা ঘর। বাজারের পাশেই খোলা জানালা দিয়ে শহরের জাপানি জনতা দেখা যাচ্ছিল।
ঘরখানি ফুল আর পাতায় ভরা, কৃত্রিম ঝরনা আর গোলাপ পুষ্পে সাজান। কয়েকখানি আসন আর দুইখানা কাউচ। যুবতী তার একখানিতে এবাদকে বসিতে বললেন–এবাদ হ্যাঁট রেখে একখানা চেয়ারে বসে জনতার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এবাদকে বন্দি করিয়া হেনা হন ঘর বন্ধ করিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন। ধীরে ধীরে গভীর নিবিড় আঁধারে ঘরখানি ভরিয়া উঠিল।
.
নবম পরিচ্ছেদ
রাত্রি ন’টার সময় একটি যুবক এসে সুরীকে জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কেমন আছেন?”
সুরী চেয়ারে বসে একখানা পত্রিকা পড়িতেছিল–কভার খুলিয়া সে পড়িয়া দেখিল একটা কবিতা। বারে বারে সে পড়িল–
ধরণীর একপ্রান্তে আছে সে দাঁড়ায়ে
ওষ্ঠে হাসি রক্ত দীপ্তি, কটাক্ষে মাখায়ে,
আছিল সে একদিন কোমল মধুর
মাতৃত্ব মহিমা আর গন্ধে ভরপুর।
বিধাতার হাসি নিয়ে একদা ঊষায়
জন্মেছিল মার কোলে মৌন বরষায়।
ফিরে এস, ফিরে এস, হে সুন্দর! হে মধু!
বিকাইতে পথে পথে জন্মেছিলে তুমি শুধু?
উঠিবে না? চাহিবে না? গাহিবে না গান?
আঁধারেই রয়ে যাবে? জানিব না প্রাণ?
এ জনম মিছে বলল, হে মাতঃ পাষাণী
বিধাতার একরূপে দিলে এত গ্লানি?
ছুঁড়ে ফেল দূর কর, ভোগের বাঁধন,
হলাহলে ভরে দিলে সারাটা জীবন?
ছোট বড় সব সুখ জীবনের মাঝে।
বিস্মৃতি হারায়ে ফেলে আপনার মাঝে
দৃষ্টি যবে ভেঙ্গে যাবে, আসিবে মরণ
শেষ হবে সব খেলা সকল স্বপন।
উঠিবে কি ডাকি বল সেই শেষ দিন
স্মরণে একটু সুখ, ওরে দীনহীন!
আসিবে কি স্মৃতিপথে একটু ভাসিয়া!
জীবনের গত লঘু-সুখ হাসি-ছায়া
মদিরা অলস চোখে, হে দুঃখিনী বালা
তুলিয়াছ দীন প্রাণে সীমাহীন জ্বালা।
মূর্খতা আঁধার আর অধীনতা ভার
রমণীরে করিয়াছে পাষাণী অসাড়।
সুরীর কণ্ঠস্বর বাধিয়া আসিতেছিল। একটা অজানা গভীর ব্যথা তাহার কণ্ঠ ফাটিয়া বাহির হইতেছিল। এমন সময় একটি যুবক জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কেমন আছেন?”
সুরী কি কহিতেছিল–এমন সময় মোহিনী সুরীর প্রকোষ্ঠের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল। সুরী কথা বলিল না। অতঃপর সে দেখিল–একটি অষ্টাদশবর্ষীয় যুবক তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। সুরীর অঙ্গ দিয়া একটি স্পন্দন বহিয়া গেল। যুবকের দিকে চাহিয়া সে বলিল–“আপনি কী চান? আপনি জানেন, এ কাঁদের বাড়ি?”
যুবক কথা বলিল না। সে মৌন হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিল।
সুরী আবার কহিল–“আপনার এই দিব্য মূর্তি! দেবতার মহিমা ও গৌরব আপনার দেহ দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে, আর আপনার এই প্রবৃত্তি! কোনো পিতা-মাতার বুকে আগুন জ্বালবার জন্য আপনি এসেছেন?”
যুবক কথা বলিল না।
সুরী আবার কহিল–“সারা জীবনটা মরুভূমি করে তুলবার ব্যবস্থা কে দিয়েছে? কোনো পিশাচ সে? এই স্বর্গীয় জীবনের প্রতি আপনার একটু মায়া নাই। এই পথে যে হাঁটে তার জীবনে অপরিসীম দুঃখ। সারাজীবন আপনার বুকের ভিতর আগুন জ্বলবে। যান যান, ফিরে যান। নিজে অস্পৃশ্য বলে ভগবানের ও মানুষের কাছে আপনাকে অস্পৃশ্য করতে চাই না। আপনি ছেলে মানুষ, কিছু বোঝেন না। মা-বাপের বুকে ছুরি দেবেন না। মা-বাপ আপনার কাছ থেকে অনেকখানি আশা করে। যুবকের আঁখিতে ঈশ্বরের জ্যোতি প্রতিভাত হতে থাকে। আপনি সে আলোককে শয়তানের আঁধার দিয়ে ঢেকে ফেলবেন না। এখানে সুখ নাই। আপনার ভিতরে এর পরে যে পাপের আগুন জ্বলে উঠবে, তা সমস্ত সাগরের জল দিয়ে নিভাতে পারবেন না।”
যুবক ভাবিতেছিল, সে কথা কহিতে পারিতেছিল না। চরণ তাহার উঠিতে ছিল না।
সুরী আবার কহিল–“যুবক, কে তোমাকে এই পথের পথিক করিয়াছে? তাহাকে যাইয়া হত্যা কর। সে তোমার সারা জীবনের শত্রু।”
যুবক সহসা কাঁদিয়া ফেলিল। সে বলিল–“আপনি কে তা জানি না। আমার জ্ঞানলাভ হইয়াছে, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি চলিলাম।” আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম–কোনো নরপিশাচ আমাকে আর পথভ্রষ্ট করিতে পারিবে না। আমি কে তাহা বলিব না। –আপনি আমার যে উপকার করিলেন, তজ্জন্য ভগবানের কাছে সারাজীবন আপনার মঙ্গল প্রার্থনা করবো।”
যুবক দ্রুতপদে সে স্থান পরিত্যাগ করিল। বহুলোকের উপদেশ সে পাইয়াছে। কিন্তু কিছু সে গ্রাহ্য করে নাই। আজ যেন কে তার ভিতরে একটা ভীষণ তেজ সৃষ্টি করিয়া দিল। সে রাস্তায় যাইয়া এই অস্পৃশ্য বালিকার উদ্দেশ্যে শতবার নমস্কার করিল।
.
দশম পরিচ্ছেদ
শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত। দিবালোকে দৃষ্টি চলিতেছিল না। জীবনের আড়ষ্টতা ও অন্ধকার বিশ্বজোড়া মৌন কুহেলির পার্শ্বে স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছিল–এই বিস্তীর্ণ ধরা–কত মানুষ! কোথায়–কত মানুষ কল্পনা ও দুঃখ লইয়া পড়িয়া আছে। পাপ ও বেদনার ভিতর কত মানুষ সান্ত্বনা খুঁজিতেছে।
সুরীর মায়ের বড় অসুখ। সে আর বাঁচিবে না। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, তাহার মাকে হাসপাতালে পাঠানো আবশ্যক; বাড়িতে তার উপযুক্ত সেবা হইতেছে না। টাকার জোরে ডাক্তার বাবু, সুরী ও সুরীর মাকে চিরকালই তার মস্ত মুরুব্বী বলিয়া মনে করিতেন।