এবাদ কি উত্তর দিবেন ভাবিয়া পাইতেছিলেন না। পাছে অদ্রার পরিচয় দেওয়া হয় এই ভয়ে তিনি কহিলেন–“নিশ্চয়ই আমি জাপানি মহিলাদের সৌন্দর্যকে প্রশংসা না করিয়া পারি না। তাহার দেখিতে চমৎকার!”
যুবতী সহসা এবাদের মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিলেন–“আপনার সৌন্দর্য জ্ঞান আছে। ইউরোপীয়ান মহিলারা আমাদের দেশের মহিলাদের কাছে সৌন্দর্য হিসাবে কত ছোট তা আপনি বেশ বুঝিতে পারেন?”
এবাদের চরিত্র কোনো কালে কলুষিত নহে। তিনি কোনোও দিন তাহার মনে কোনো তরল ভাবের প্রশ্রয় দেন নাই। পাপের বিরুদ্ধে হৃদয়ে তাঁর কোনোও দারুণ ঘৃণাও ছিল না তবে ইচ্ছা করিয়া পাপে প্রবৃত্ত হইতেন না।
এই দূর জাপানে আসিয়া তিনি কোনো দিন রমণীর কথা চিন্তা করেন নাই। রমণীর সৌন্দর্য তাঁহাকে কল্পনাময় করিতে পারিত না। তিনি একটা কলের মতো। মন্দই হোক আর ভালোই হোক কোনোও প্রকার চিন্তা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিত না। তার ও চিন্তার অংশটা একেবারে মৃত।
.
অষ্টম পরিচ্ছেদ
মিস্ ফিনি উচ্চবংশদ্ভুতা। যে দিন সিঙ্গাপুর হইতে বাড়ি আসিতেছিল সেইদিন সে দেখিল একটা ভারতবর্ষীয় যুবক জাপানে যাইতেছেন। মিস্ ফিনির চোখে এমন সুন্দর যুবক আর কখনও পড়ে নাই। জাপানের অসংখ্য নাসিকা শূন্য পুরুষগুলোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া সে ভুলিয়া গিয়াছিল। সভ্য দেশ ফ্রান্সে বহুদিন ছিল বলিয়া বোধ হয় তার মনের এই পরিবর্তন। সর্বদা মি. এবাদের সঙ্গে মিশিলেও জাপানি লজ্জাহীনতা লইয়া অপেক্ষাকৃত সভ্য ফিনি কখনও এবাদের কাছে তাহার প্রাণের দারুণ তৃষ্ণার কথা মুখ ফুটিয়া বলে নাই। সাধারণ জাপানি নাচগৃহে, সমুদ্রপার্শ্বস্থ রাস্তায়, রাজধানীর সাধারণ উদ্যানে মিস্ ফিনি বহুবার এবাদের সহিত বেড়াইয়াছে। কিন্তু কখনও সে বলে নাই।–“মিস্টার এবাদ, আমি আপনাকে ভালবাসি।” মিস ফিনি যদি তাহার এই আকাঙ্ক্ষার কথা এবাদকে বলিত তাহা হইলে সম্ভবত তাহার প্রস্তাব ব্যর্থ হইত না। কতদিন সন্ধ্যার ঈষৎ আঁধারে সমুদ্র পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সে ইচ্ছা করিয়া তাহার মদিরাসক্ত রক্তবর্ণ ওষ্ঠ দু’খানি এবাদের কাছে ধরিয়া বলিয়াছে–ঐ সমুদ্রের নীলজল কত উল্লাস ও আনন্দ ভরা। কিন্তু একটি বারও ভয়েই হউক বা সঙ্কোচেই হউক মি. এবাদ তার অতি সুন্দর মুখোনি একটুখানি বাড়াইয়া দিয়া একটা দারুণ তৃষিত হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন নাই।
একদিন জাহাজে চড়িয়া সমুদ্র-বিহারের জন্য সে এবাদকে লইয়া বাহির হইয়াছিল। জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়াইয়া সে এবাদের সহিত কত রহস্য করিয়াছে, হেলিয়া হাসিয়া সে কত রকমে এবাদকে তাহার অকৃত্রিম ভালবাসার পরিচয় দিতে চাহিয়াছে। কিন্তু মূর্খ এবাদ তাহার কিছুই বুঝে নাই।
একবার নাচগৃহে এবাদকে লইয়া ফিনি কত চাপা হাস্যে জানাইতে চেষ্টা করিয়াছে–সে তাহার সোহাগের বস্তু। কিন্তু মুখ ভারতবাসী মোটেই বুঝিতে পারে নাই–জাপানি রমণীর রূপসুধা ভারতবাসীর পক্ষে অনধিগম্য নহে।
একদিন ফিনির পিতা বাড়িতে ছিলেন না। সে সন্ধ্যাকালে গল্প করিতে এবাদের ঘরে আসিয়া বলে–“মি. এবাদ, আজ আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই। বাবা বাড়িতে নাই, আপনার ইচ্ছা কি?” মিস্টার এবাদ বলিলেন–মুসলমানেরা জাপানিদের হাতে খায় না। তাতে তাদের ধর্ম নষ্ট হয়। অতএব ক্ষমা করবেন।”
ফিনির মাঝে মাঝে সন্দেহ হইত হয়তো এই ভারতবাসী নিতান্ত বোকা। কিন্তু এই সান্ত্বনা তাহাকে শান্ত করিতে পারিল না। যেমন করিয়া হউক এই যুবককে আপনার করা চাই।
এবাদের উন্নত ললাট, দীর্ঘ দেহ, স্বর্ণবর্ণের কেশদাম এবং নীল বিস্তৃত আঁখি মিস ফিনিকে দিনে দিনে একেবারে পাগল করিয়া তুলিতেছিল।
শহরের ”হায়ার্টলঙ্গ” পল্লীতে মিস্ ”হেনা হন” একজন বিখ্যাত নাচনওয়ালী, কুমারী মহলে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল।
বৎসরে যেদিন জাপানি মেয়েরা জোনাকী পোক ধরে ভালো স্বামী পাবার জন্য। ”ককং” দেবতার কাছে বলি দেয়, সেই দিন নাচওয়ালী হেনা হনের বাড়িতে শহরের কুমারীদের ভিড়।
সেটা যে একটা সাধারণ নাচওয়ালীর ঘর একথা সেদিন ভদ্র ও অভদ্র ঘরের কোনো কুমারীই মনে করে না। চুপে চুপে হেনা হনকে বলে আসতে হয় কেন যুবকেরে দেখে কোনো যুবতীর মন চুরি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটু বেশি করে টাকা খরচ করলে কুমারীকে আর তার প্রণয়ীর জন্য চিন্তান্বিত হতে হয় না। শিকার ধরবার জন্য হেনা হনকে যদি প্রাণ দিতে হয় তাও সে দিতে পারে–জাপানি কুমারী-মহলের বিশ্বাস এই প্রকার।
ধীরে ধীরে গাড়িখানি একবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াইল। যুবতী এবাদের হাত ধরে। বললেন, “নেমে পড়ুন।”
এবাদ কথা বলিল না। সে শুধু দেখলো এটা মিস্ ফিনির বাড়ি নয়!
একটা দীর্ঘ অন্ধকারময় সিঁড়ি! তার পর একটা খোলা হল। তার পর আবার একটা দীর্ঘ আঁধার ভরা পথ। তার পর একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির দুইধারে ফুলের মতো স্তবকের মতো কতকগুলি মেয়ে! তাদের হাসি বাঁধশূন্য। হাসিয়া হাসিয়া এ ওর গায়ে বরফের জলের মতো গলিয়া কুটি কুটি হইতেছিল। আঁখিতে বিস্মৃতির আনন্দময় হিম-কণা আর মাদকতা ভরা হিল্লোল। সমস্ত সংসারটাকে উড়িয়ে নিয়ে আকাশ দিয়ে তার চলছিল। ফুলবাগানে এলিয়ে পড়া লতার মতো সুখের আবেগমাখা বাতাসের মাঝে তারা খেলছিল।