কুলসুম কহিলেন–“থাম থাম ও ছোট মিঞা, আমার চেয়েও ভালো বৌ পাবে!”
“ভাবি, আপনার চুলগুলি জমাট বাঁধা মেঘের মতো। ইচ্ছা করে চুলের দিকে চেয়ে থাকি। আপনার মুখোনি দেখলে মনে হয় চাঁদের কথা।”
কুলসুম লজ্জিত হইতেছিলেন বটে কিন্তু মনে মনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খুশি হইয়া উঠিতেছিলেন। তিনি বিরক্তির ভান করিয়া কহিলেন–“ঠাট্টা করো না। ভাবি বলে কি এত ঠাট্টা ভালো!”
এরশাদ কহিল–“ঠাট্টা! এসব ঠাট্টা। যদি মিছে কথা বলে থাকি তবে জিভ যেন আমার খসে পড়ে।”
.
সপ্তম পরিচ্ছেদ
এবাদ বড় লোকের ছেলে। টাকার অভাব নাই। জাপানের হুইট, হং স্ট্রীটে তাঁর বাসা। একটা ক্ষুদ্র সাজান কামরা।তার এ দূর জাপনে আসার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। প্রথম প্রথম তাঁহার মন আদৌ টিকিত না। Tannery শিখিতে সেখানে গিয়াছিলেন। কাজ অনেক শেখা হইয়াছে। বন্ধুবান্ধব তার অনেক জুটিয়াছে। পুরুষ মেয়ে দু-ই।
পৌষ মাস। সন্ধ্যাবেলা র্যাপার গায়ে দিয়ে তিনি নিজের ছোট কামরায় বসিয়া আছেন, এমন সময় শুনিলেন, কে যেন তার দরজায় মৃদু মৃদু আঘাত করিতেছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুরিয়া ফেলিলেন, একজন যুবতী জাপানি মহিলা তাহাকে নমস্কার করিলেন। যুবতীর পরনে মূল্যবান পোশাক। কোনো উচ্চ-বংশের কন্যা ভাবিয়া এবাদ ব্যস্তসমস্ত হইয়া সম্ভ্রমের সহিত তাহাকে একটা চেয়ারে উপবেশন করিতে বলিলেন। যুবতী বাক্য ব্যয় না করিয়া চেয়ারে উপবেশন কিরলেন।
অতঃপর কয়েক মিনিট উভয়ের মধ্যে, কোনো কথা হইল না। কি বলিয়া কি কথা আরম্ভ করিতে হইবে এবাদ বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। অধিক্ষণ নীরবে বসিয়া থাক অসঙ্গত বিবেচনা করিয়া, এবাদ অত্যন্ত ভদ্রতা ও নম্রতা জানাইয়া যুবতাঁকে বলিলেন–“মহাশয়া! এই দীনের পর্ণকুটীরেতে আসিয়া অধীনকে অত্যন্ত সম্মানিত করিয়াছেন। আপনার এই আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”।
যুবতী ধীরভাবে কহিলেন–“হ্যাঁ, পারেন। নিকটেই আমার বাড়ি। আপনি আমাকে চিনলেও আমি আপনাকে চিনি।”
এবাদ আরও বিনীতভাবে কহিলেন–“আপনাকে আমি জানি না, সে জন্য আমি দুঃখিত। আপনি আমাকে জানেন শুনিয়া যার-পর-নাই আনন্দলাভ করিলাম অতঃপর আপনার আগমনের কারণ জানিতে পারিলে আরও আনন্দ লাভ করিব।”
যুবতী কহিলেন, “আপনার মিস্ ফিনির সহিত পরিচয় আছে কি?”
“হ্যাঁ আছে, তিনি আমার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু।”
“তাহার অত্যন্ত অসুখ। তাঁহার বাঁচিবার আর আশা নাই। একবার তিনি আপনাকে দেখিতে চান।”
এবাদ অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া কহিলেন–“বটে! মিস্ ফিনির অসুখ! এই সংবাদটি দিয়া আপনি আমাকে অত্যন্ত বাধিত করিলেন। অনুগ্রহ পূর্বক আমার সঙ্গে একটু যাবেন কি?”
“হ্যা! সেই উদ্দেশেই আমি এখানে আসিয়াছি। বাহিরে গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। আপনি সতুর বেশ পরিধান করিয়া লউন। আমি বাহিরে অপেক্ষা করিতেছি।”
এই স্থানে মিস ফিনির একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। সিঙ্গাপুর হইতে আসিবার সময় এই মেয়েটির সহিত এবাদের পরিচয় হয়। তিনি জাপানের এক প্রসিদ্ধ ডাক্তারের কন্যা। এই কুমারীর সাহয্যে মিস্টার এবাদের বাসা ঠিক হইয়াছিল। নূতন দেশে আসিয়া প্রথম যে অসুবধা ঘটিয়া থাকে, তার মীমাংসা মিস্ ফিনিই করিয়া দিয়াছিলেন। দিনে দিনে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব জমিয়া উঠিল। মিস্ ফিনি ইউরোপীয়ান পোশাক পরিধান করিতেন।স্বর্ণবর্ণ উজ্জ্বল কেশগুচ্ছ, কোমল গণ্ডের রক্ত বিভা তাঁহাকে এবাদের চোখে বেশ সুন্দর করিয়াই দেখাইয়াছিল।
যে সুন্দরী মহিলা মিস্ ফিনির পীড়ার সংবাদ আনিয়াছিলেন তাঁহার পোশাকও ইউরোপীয়ান ধরনের। ঢেউ তোলা গাউন। শুভ্র মুখের উপর লাল রুমালখানি তাহাকে অভিনব করিয়া তুলিয়াছিল।
উভয়েই গাড়িতে যাইয়া বসিলেন। এবাদ তাহার বন্ধু মিস্ ফিনির পীড়ার কথা ভাবিতেছিলেন।
গাড়ির মধ্যে সুন্দরী অপর পার্শ্বে না বসিয়া মিস্টার এবাদের পার্শ্বেই বসিলেন। এবাদ বিস্মিত হইলেও কিছু বলিতে পরিলে না।
সুন্দরী যেন এবাদের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন–“মহাশয় বিস্মিত হইবেন। আপনাকে দূরে রাখিয়া আমি নিজের মতো বসিয়া আরাম করিতে চাহি না। ইহাতে কোনো লজ্জা অনুভব করিবেন না।”
এবাদ বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন–“কী জানি, হইতে পারে–জাপানের ইহাও একটা ভদ্রতার নিয়ম হইতে পারে।”
এবাদ অজ্ঞতার ভান করিয়া কহিলেন–“মহাশয়া! ক্ষমা করিবেন। জাপানি সভ্যতার সকল অংশের সহিত এখনও আমি পরিচিত হই নাই। আপনার সহিত আমার পরিচয় হইল। আশা করি, এ বন্ধুত্ব এক দিনের হইবে না। এতদিন আপনার সহিত আমার পরিচয় হয় নাই, তজ্জন্য আমি যথেষ্ট দুঃখিত। মিস্ ফিনির কাছে একদিনেও আপনার কথা শুনি নাই। আমার দুর্ভাগ্য বলিতে হইবে।”
এবাদ লক্ষ্য করিলেন যুবতীর আঁখি ক্রমশ সহজ দৃষ্টি হারাইল। সে যেন একটা অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে যুবতীর দিকে আকর্ষিত হইতেছে।
যুবতী কহিলেন–“জাপানি সুন্দরীরা মন হরণ করিতে পারে কিনা? তাদের সৌন্দর্য আপনার চোখে কেমন দেখায়?”
এবাদ কি উত্তর দিবেন ভাবিয়া পাইতেছিলেন না। দৃষ্টি অবনত করিয়া তিনি কহিলেন–“জাপানি মহিলারা বেশ সুন্দরী। তাহাদিগকে দেখলে মনে খুব তৃপ্তি জন্মে।”
যুবতী আবার কহিল–“বটে! আমাদের দেশের সুন্দরীকে দেখলে আপনার তৃপ্তি জন্মে। আচ্ছা, তাহাদিগকে আপনার ভালবাসতে ইচ্ছা হয়?”