বাবু বলিলেন–“আমি চৈতন্যশূন্য হই নাই। আমার জ্ঞান আছে। জ্ঞান যার নাই সে কখনও এমন করিয়া কাহাকেও ভালবাসিতে পারে না। আমি নিজের সম্পত্তি তোমায় দান করিব।”
সুরী হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল–“মহাশয়! এই আপনার জ্ঞান? জিজ্ঞাসা করি, এ সম্পত্তি কার? ইহা কি আপনার নিজের অর্জিত? না, আপনার পিতা পিতামহের? যদি আপনার অর্জিত ধন না হয়, তাহা হইলে পরের দেওয়া দানকে এমন করিয়া পথে ফেলিয়া দিবার আপনার কি অধিকার আছে? এই বিরাট সম্পত্তি আমার ন্যায় অপাত্রে দান না করিয়া, কোনো সকার্যে ব্যয় করুন।”
বাবু বলিলেন–“শয়তানের কাছে আমি নিজেকে বিক্রয় করিতে রাজি আছি। সত্য করিয়া বলিতেছি তোমার মুখে এসব বাজে কথা শোভা পায় না। ভালো কথা বলিয়া দয়া করিয়া আমাকে সুখী কর।”
সুরী আবার কহিল–“আপনার স্ত্রীর সহিত যদি কোনো অপরিচিত লোক এই প্রকার প্রেমালাপ করে, তবে আপনার কি মনে হয়?”
বাবু কহিলে–“স্ত্রীকে তাহা হইলে আমি হত্যা করিব।”
“কেন?”
আমার সম্মুখে, আমার স্ত্রী পরপুরুষের সহিত প্রেমাভিনয় করিবে, আর আমি তাহা দেখিব?
সুরী বলিল–“আর আপনি আপনার স্ত্রীর সম্মুখে পর-রমণীকে লইয়া যে প্রেমাভিনয় করিতেছেন। ইহাতে তিনি কী ভাবিতে পারেন?”
বাবু বলিলেন–“কিছু না।”
সুরী বলিল–“আপনার মাতাকে চরিত্রহীনা বলে জানেন আর তারই উদরে আপনার জন্ম হইয়া থাকে, তা হলে আপনি কী করবেন?
বাবু কোনো কথা না বলিয়া সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেলেন।
০৬-১০. ঢাকা জেলার এক দ্বিতল গৃহে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
ঢাকা জেলার এক দ্বিতল গৃহে এক বিংশতি বর্ষীয় যুবক তাহার ভাবির সহিত রহস্য করিতেছিল।
সদাগর এবাদত আলী ঢাকা জেলার শ্রেষ্ঠ সদাগর। পুত্র এবাদ আলী বি. এ. পাস করিয়া জাপানে শিল্প শিক্ষা করিতে গিয়াছেন। ছোট ভাই এরশাদ স্কুলে পড়ে। এবাদত আলী আজ দুই বৎসর হইল পুত্রকে জাপানে পাঠাইয়াছেন। সদাশয় এবাদত অতিশয় অমায়িক ভদ্রলোক। পুত্রবধূ কুলসুম বাড়িতেই থাকেন। এরশাদের এখনও বিবাহ হয় নাই। সে স্কুলে পড়ে।
এরশাদ প্রাতঃকালে উপর-তলায় তাহার ভাবির ঘরে নাস্তা করিতে গিয়াছিল। খাইতে খাইতে এরশাদ ভাবিকে কহিল–“ভাবি, বড় ভাইয়ের আর আসবার দেরি কত? এই দুই বছর গিয়াছেন। বড় ভাই কেমন লোক ভাবি আপনার কষ্টের কোনো ধার তিনি ধারেন না।”
কুলসুম কহিলেন–“তোর তা দিয়ে দরকার কী? স্বামী ছাড়া হয়ে থাকলে বৌয়ের কষ্ট হয় কি না, যখন বিয়ে করবি বৌকে জিজ্ঞাসা করিস। এখন তার কী?”
“না ভাবি! রাগেন কেন? আমি কি আর মিথ্যে কথা বলছি।”
দেবরের রহস্য বুঝতে পেরে এরশাদের ভাবি বলিলেন–“সেটা কি আর মিছে কথা! কষ্ট? দারুণ কষ্ট। যখন বিয়ে করবে তখন যেন বৌয়ের কষ্ট বুঝতে ভুল না। স্বামী ছাড়া হয়ে থাকলে মেয়ে মানুষের যে কষ্ট হয় সেটা কি আর ঢাকবার কথা। দেখো তোমার বৌ যেন ১৫ দিনও তোমার অদেখা হয়ে না থাকে। নইলে সে লুকিয়ে লুকিয়ে কাদবে। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবে চোখে ধোয়া লেগেছে।”
“ভাবি আব্বা তো আমার বিয়ে দেবার নামও করেন না। তুমি তবে দেখ, মা কী বলেন? কুড়ি বছর তো কম বয়স নয়! রাত্রে ভাবি, বড় লজ্জার কথা। কী বলবো আপনাকে! মন কেমন করে। কাকে বলি, কিছু ভাল লাগে না। রাগে আমার গা জলে যায়। সকলেই মেয়েদের বিয়ের জন্য ব্যস্ত, আমরা যেন কেউ নয়।”
“তোমার পড়াশুনা খুব হবে! রাতদিন বৌয়ের ভাবনা ভাবে, না বইয়ের ভাবনা ভাবে? মাকে বলবো, এরশাদের আর পড়াশুনা হবে না একটা ফুটফুটে দেখে বিয়ে দাও। কেন আর বুড়ো বয়সে প্রাইভেট মাস্টারের তাড়না।”
“ভাবি! আপনার পায়ে পড়ি, অমন করে বলবেন না। ওতে বড় লজ্জা পাব, একটু ভালো করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলবেন। আচ্ছা ভাবি, আপনি যে ফুটফুটে একটা মেয়ের কথা বললেন, সে কি আপনার মতই সুন্দরী হবে?”
মেয়েমানুষ যেমন প্রকৃতির হউক না কেন, নিজের রূপের প্রশংসা শুনলে মনে মনে সে একটু আনন্দ অনুভব না করে পারে না। কুলসুম মনের ভাব গোপন করিয়া একটু উৎসাহিত হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন–“কেন, তোমার ভাবি কি বড় সুন্দর?”
“কী বলেন ভাবি? আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে ঢাকা শহরে নাই।”
কুলসুম দেবরের কাছে মনে মনে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হইয়া গেলেন। এমন করিয়া তাহার সৌন্দর্যের তারিফ এর আগে আর কেউ করে নাই। তাঁর স্বামীও কখনও তাহাকে মুখ ফুটিয়া বলেন নাই। ”কুলসুম! তুমি কত সুন্দর তুমি কত মধুর।”
চাঞ্চল্য ও ভালবাসার প্রকাশ কখনও তাঁর মুখে দেখা যেতো না। হাসির একটা রেখাও তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিত না। সম্পূর্ণ কাজের ও সংসারী লোক বলতে যা বুঝায় তাই তিনি। প্রতিদিন অন্ধকারে দুইজনের দেখাশুনা–তাড়াতাড়ি হয়তো একটা ব্যস্ততা ভরা প্রণয়-সম্ভাষণ, তার পর সব শেষ! কেবল কাজ।
আজ এই দুই বৎসর যে সব চিঠি আসিয়াছে তাহাতে কেবল কঠিন পাথরের কুচির মতো কতকগুলি কথা সাজান। কোথাও একটু গন্ধ নাই। সবগুলিতেই লেখা থাকে–কাজের ভিড়ে পত্র লেখবার সময় হয় না। আব্বাকে আর আম্মাকে আমার সেলাম জানাইও। এখনো অনেক কাজ শিখিতে বাকি আছে। বাড়িতে থাকবে, আমাকে না বলে কোথাও যেও না–আর কিছু নহে।
এরশাদ আবার কহিল–“ভাবি, আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি কখনও দেখি নাই।”