শহরের হতভাগিনীদের মধ্যে মোহিনী পতিতার মেয়ে, তেমন সুন্দর এমন আর কেউ নয়। মোহিনীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। ৫ খানি বাড়ি তার। বাড়ি ভাড়ার আয় মাসিক ৩০০.০০ টাকার কম নহে। তাহা ছাড়া নগদ ৮০,০০০.০০ টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ছিল। তাহার একমাত্র মেয়ে সুরী।
সুরী আদৌ তাহার মায়ের কথা শুনে না। একটি বাবু এই সুরীর জন্য পাগল হইয়াছেন। মোহিনী তার কন্যাকে বহুবার অনুরোধ করিয়াছে, কিছুতেই কিছু হয় নাই। কতবার এই বাবুটি ভিখারির মতো সুরীর গৃহপার্শ্বে দিনরাত্রি দাঁড়াইয়া থাকিত তার হিসাব নাই।
আজ প্রকোষ্ঠের মধ্যে সুরী এই বাবুটিকে নানা প্রকার অনুরোধে ব্যস্ত করিয়া তুলিতেছিল।
মেয়ের এই অস্বাভাবিক ব্যবহারে মোহিনী বিস্মিত হইলে সে বাহিরে কিছু বলিত না। অতি নম্রতাবশে মাঝে মাঝে সুরীকে কি যেন কহিতে যাইত, কিন্তু পারিত না। বারবিলাসিনীর কন্যার পক্ষে পুরুষ মানুষের প্রতি অবহেলা দারুণ অধর্ম। মোহিনী সুরীকে পাপ-পথে লইবার জন্য ভগবানের কাছে বহু পাঠা মানত করিয়াছে। মদনমোহনের সম্মুখে গালায় বস্ত্র লইয়া সে কত কাঁদিয়াছে। কিন্তু তবুও দেবতা সদয় হন নাই।
সুরী পতিতা রমণীর সন্তান, কিন্তু তবুও, তাহার ভিতরে একটা অস্বাভাবিকত্ব পরিলক্ষিত হইত, যাহা হতভাগিনীদের জীবনে একেবারেই নূতন, একেবারেই বিস্ময় উৎপাদক। বহুদিন সে তাহার মাকে দেখিয়াছে–কত পুরুষকে লইয়া নৃত্য ও গান করিতে। সে অনেক দিনের কথা। তাহার মায়ের এই জঘন্য রুচির পরিচয় যখনই সে পাইত তখনই তাহার বালিকা হৃদয় বেদনা ও ঘৃণায় ভরিয়া উঠিত।
সে কখনও মাতার সহিত দুই তিন দিন কথা কহিত না। মোহিনী কন্যার বিরক্তি বুঝিতে পারিয়া শেষ বয়সে সকল রকম আনন্দ পরিত্যাগ করিয়াছিল।
মোহিনী ইচ্ছা করিয়া তাহার কন্যাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছিল। সুরীর পড়িবার ঘর কত বইয়ে ভরা। বই পুস্তকের মধ্যে সে সর্বদা ডুবিয়া থাকিত। কিন্তু হইলে কি হয়, সে। যে বেশ্যার মেয়ে। বাবুদের আনন্দ বর্ধন করাই যে তাহার জীবনের কাজ। তাই পূর্ব পরিচিত বাবুটি আসিয়া প্রায়ই তাহার কর্তব্য স্মরণ করাইয়া দিতেন। আজও তিনি তাহাকে পথে আনিবার জন্য নানা রকম কথায় ফাঁদ পাতিতেছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সুরী বলিল–“মহাশয়, আপনার কতখানি ভুল হইতেছে তাহা আপনি বুঝিতেছেন না। আমার ন্যায় অস্পৃশ্যার সংসর্গে এসে নিজেকে এত হীন কাজে আপনার একটুও লজ্জাবোধ। হইতেছে না? আপনার এই ভালবাসার কোনো মূল্যই নাই। পাপের ভিতর আপনি সান্ত্বনা। খোঁজেন কেমন করিয়া? একটা মিথ্যা ভুলে আপনার মতিভ্রম ঘটিয়াছে। রূপ বলিয়া কোনো কিছু পদার্থ আছে কিনা সন্দেহ। আপনার স্ত্রীর সহিত আমার তুলনা করুন, কীসে আমি তার চেয়ে বড়? তিনি পবিত্র, আমি অপবিত্র, সেই জন্য? তাঁর প্রেম সংযত, আমাদের ভালবাসা উদ্দাম, তার ভালবাসা স্বর্গীয় এবং বিশ্বাসে ভরা, আমাদের প্রেম অস্থির ও বিশ্বাসহীনতায় কলঙ্কিত। তিনি আপনার সুখ ও দুঃখের সহচরী, আর আমরা মধুলুব্ধ ভ্রমরের ন্যায় আপনার সম্পদের চাটুকার। ক্ষমা করুন মহাশয়। এই পাপ হতে ফিরিয়া পড়ুন সতীর বুকে ছুরি হানিবেন না।” কথায় কথায় রাত্রি ১২টা হইয়া গেল। সকলেই ঘুমাইয়া গিয়াছে। মোহিনী আপনার প্রকোষ্ঠে নিদ্রাভিভূতা। শুধু সুরীর ঘরে আলো জ্বলিতেছিল। বাবু বলিলেন, যাদের জাতি নাই, তাদের মুখে এমন উপদেশ শোভা পায় না। আমার স্ত্রীর নাম করিও না। তাহাকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি; তার রূপ থাকিলেও আমি তাহাকে ঘৃণা করি। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমার প্রতি দয়া প্রকাশ কর। বিপুল অর্থের বিনিময়ে আমি তোমার কৃপাভিক্ষা করি।”
সুরী কহিল–“আপনি আপনার স্ত্রীকে ঘৃণা করেন? একথা বলিতে আপনার লজ্জা হল। সত্য কথা বলিতে কী? আপনার বর্তমান অবস্থা যদি তিনি জেনে থাকেন, তা হলে। আপনার তাঁহাকে ঘৃণা করবার তো কোনো অধিকার থাকিবেই না। পারন্তু আপনিই অধিক করিয়া তাহার কাছে ঘৃণার পাত্র হইবেন। আপনার ঘৃণা কি কারণহীন?”
বাবু বলিলেন–“কারণহীন নয়। সে অত্যন্ত অসভ্য।”
সুরী হাসিয়া বলিল–“তাই বুঝি আপনি অসভ্য স্ত্রীকে রাখিয়া অপেক্ষাকৃত সভ্য রমণীর কাছে আসিয়াছেন? আপনার স্ত্রী অসভ্য, তিনি আপনার ভালবাসা লাভের অযোগ্য! আর আমি যোগ্য! আমি অধিক সভ্য! আমার কৌলীন্য-গৌরব বেশি?”
বাবু ধৈর্যশূন্য হইয়া বলিলেন,–“সুরী, অত বিরক্তিকর কথা বলিয়া সময় নষ্ট করিতেছ কেন? এসব বাচালতা পরিত্যাগ কর। ধর্মকথার স্থান ইহা নহে। আমি তোমাকে ভালবাসি। নিষ্ঠুরের মতো তুমি আমার সহিত ব্যবহার করিও না।”
সুরী কহিল–“ইহা ধর্ম-মন্দির নয় স্বীকার করিলাম। কিন্তু মহাশয়! স্মরণ করিবেন ইহা প্রেমেরও স্থান নহে। এখানে দিবারাত্র বাসনায় আগুন জ্বলে। আপনি মনে করিতেছেন আপনার প্রস্তাবে আমি আত্মহারা হইব, তাহা কখনও নহে! যে স্বামী স্ত্রীকে ভালবাসে না সে আমাদের মতো রমণীকে ভালবাসিবে? আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না। আপনি অন্ধ হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু যখন জ্ঞান হইবে তখন আঘাতে পদাঘাতে দূরে নিক্ষেপ করিবেন; কিংবা যখন আপনার জ্ঞান হইবে তখন আপনি পথের ভিখারি। আমাদের দয়ায় অনেক মানুষ পথের ভিখারি হইয়াছেন। আপনি ফিরিয়া যান। এখানে সুখ নাই। কেবল বাসনার আগুন। কেবল একটা বিরাট ভুলের মধ্যে আপনি চৈতন্যশূন্য হইয়াছেন।