সাতদিন পরে ফুলী তার মাকে ফেলে মাথা মুড়ে সাদা কাপড় পরে সরযুর আশ্রমে যেয়ে উপস্থিত হয়েছিলো। সরযুও তাঁকে জনননীর স্নেহে জড়িয়ে ধরেছিলেন। পাঠকের মনে আছে, মহিউদ্দীনের এক শিষ্য ছিল। এই যুবক প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে পড়ার খরচ সগ্রহের জন্য কলিকাতার রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
দেশের লোক মিস্টার রহমানের পরামর্শে সে সাহাষের জন্য সরযু ডাক্তারের সহিত দেখা করে সরযু এই যুবকের সহিত সগদ ৫০০ টাকা ও ৫০০ টাকার গহনা দিয়ে ফুলরানীকে বিবাহ দেন। সেই টাকায় মহিউদ্দিনের শিষ্য, বি. এ. পাস করেছিলেন।
… জিলায় এই দম্পত্তির সন্তান-সন্ততি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা এখন দেশের মধ্যে সম্রান্ত ব্যক্তি।
.
সপ্তচত্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
অতি প্রত্যুষে ফুলে-ভরা ছোট বাগানের দিকে তাকিয়ে সরযু গত জীবনের কথা ভাবছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল মিস্টার রহমান তার কাজে সহানুভূতি দেখাবার উপযুক্ত লোক। বহু ভদ্রলোকের সহিত তাঁর আলাপ হয়েছে, কিন্তু এমন ভদ্রলোক তিনি কখনও দেখেন নাই প্রাণের এক কোণে সরযু দেখতে পেলেন–মিস্টার রহমান যেন একগাছা তিনি কখনও দেখেন নাই প্রাণের এক কোণে সরযু দেখতে পেলেন মিস্টার রহমান যেন একগাছা ফুলের মালা হাতে করে তাকে ডাকছেন।
সরযুর লাল মুখ রক্তে ভরে উঠলো। অজ্ঞাতসারে সেই নির্জন কামরায় সে মুখ নত করে ফেললে।
মিস্টার রহমান যদি তাঁকে বিয়ে করেন, তাহলে তাঁর কাজের কি কোনো বাধা হবে? মিস্টার রহমান কি তার সঙ্গী হবেন?
বস্তুত রহমান শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিতে সরযু তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে তার আত্মবিশ্বাস করতে প্রলুব্ধ হচ্ছিল। মিস্টার রহমানকে সারাজীবন সঙ্গে পেলে সে রমণী জাতির স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য কিছু করতে পারে। একা শত বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই বিরাট কাজ কী সে করে উঠতে পারবে! _ মিস্টার রহমান ছাড়া আর কোনোও সঙ্গী পাওয়া কি তার পক্ষে সম্ভব হবে? বাহিরের চাকচিক্যের অন্তরালে সে যে অত্যন্ত ছোট। বিধাতা তাকে ছোট করে রেখেছেন। মিস্টার রহমানের মনুষ্যত্বের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। তিনি সমাজ ও অসত্যকে ভয় করবার লোক নন।
তিনি একটা সঙ্গী পেতে চান কেন? তার কর্মের সাহায্যের জন্য! তাঁর জীবনব্যপী সংগ্রামে ভরসা দিবার জন্য একটা লোক তিনি চান।
.
অষ্টচত্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
যেখানে কলিকাতা বড় লাইব্রেরি, তারই অনতিদুরে দু’টি যুবতী এক জায়গায় বসে পান বিক্রি করে। নীচ জঘন্য স্ত্রীলোকদের মতো তাদের মুখে কথায় চটুলতা ছিল না। ক্রেতার কোনো রসিকতায় তারা উত্তর দিত না।
ভাগ্যের কী মর্ম বিদারক পরিহাস! যে রমা ও নিহার এককালে স্বর্গের পূণ্য নিয়ে বাতাস ও মাটিকে তাদের দেহ ও চরণের স্পর্শ দিয়ে পবিত্র করেছে, আজ দেশের মূর্খতা, অবিচার ও হৃদয়হীনতার ফলে তারা কোথায়? ইহা ভাবিতেও আমাদের চোখ দিয়া জল পড়ে। অশ্লীল ও জঘন্য কথা–এসব না ভাবলেও চলবে না।
উভয়ে তারা এক জায়গায় বসে। সারাদিন বড় বড় জ্ঞানী লোকের কাছে তারা পান বিক্রয় করে। ক্রেতার মুখের দিকে চেয়ে তারা কখনও কথা বলে না। শহরের এক জঘন্য পল্লীতে এক ক্ষুদ্র খাপরার কামরায় তারা বাস করে। একই সঙ্গে তারা খায়। দুঃখে হোক বা প্রেমে হোক তাদের এখন জাতি বিচার নাই।
সেদিন পান বিক্রি করে তাদের দুইজনের আড়াই টাকা লাভ হয়েছিল। এইরূপে তারা পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলো। জঘন্য পল্লীতে থাকলেও তাদের কাছে কোনো বদমায়েসের স্থান হতো না। ভিতরে একটা অস্বাভাবিক উচ্চ প্রবৃত্তি সেই জঘন্য স্থানেও তাদের আত্মার উপরে বসেছিলো।
অনেকদিন থেকে একটা বদমায়েস বক্তা নিহার পানওয়ালীর কাছে প্রেম ভিক্ষা করছিলো। গায়ে তার যেন অসাধারণ শক্তি। দেখতে যমের মতো। নিহার অত্যন্ত ঘৃণায় বলেছিলো, পান বিক্রি করলেও সে শহরের সাধারণ পানওয়ালী নহে। বদমায়েস রাস্তার মধ্যে নিহার ও রমাকে অতি পৈশাচিক ভাষায় বলেছিল–“আমার বাসনা আমি পূর্ণ করবোই করবো। বাজারের পতিতার আবার এত বড়াই কেন?”
সেদিন সন্ধ্যাবেলা নিহার বাসায় ফিরে এসে রান্নার আয়োজন করিতেছিল। রমা পার্শ্বে বসে মাছ ধুইছিল। এমন সময় ও বদমায়েস যুবকটি এসে বললে, “নিহার, আমার কথা তোকে শুনতে হবে। আমি পাঁচ টাকার জায়গায় দশ টাকা দিতে রাজি আছি।”
রাত যখন দশটা তখন সহসা দরজায় আঘাত পড়লো। নিহার রমার কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে বললে–“দাখানা, ঠিক করে ধর রমা। আমার কাছে বঁটি আছে।”
নিহার জিজ্ঞাসা করিল, “কে?” অতি রুক্ষ্ম ও পৈশাচিক ভাষায় উত্তরে শোনা গেল, “দরজা খোল মাগী। জানিস না আমি কে! যদি দরজা না খুলবি, আমরা ঘর ভেঙ্গে ভিতরে আসবো। আমি একজন নহি। আমরা দশজন এসেছি।”
একটা ভয়ানক শক্তি রমা ও নিহারের ভিতর জেগে উঠলো। রমণীর স্বাভাবিক ভীরুতার পরিবর্তে একটা রুদ্র ভাব রমা ও নিহারকে মুহূর্তের মধ্যে মাতাল করে ফেললো। নিহার রমার কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে আবার বললে–“রমা, হাতের বল যেন ঠিক থাকে।”
নিহার ধীরে ধীরে দরজা খুলে বললে–“এস! ঘরের মধ্যে এস!”
তার পর সেই অন্ধকারে ছোট ঘরে দশ মিনিটের মধ্যে দশটি লোকের মাথা দেহ ছাড়া হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। পুলিশের অপমান ও সাধারণের উপহাসকে ভয় করে সেই রাত্রেই রমা ও নিহার নদীতে যেয়ে আত্মহত্যা করে।