“সেই রমণী না হয় চিরজীবন আপনার আশ্রমে থাকলো, কিন্তু এই বালিকার কী হবে?”
“তাকে ভালো করে লেখাপড়া শিখিয়ে, পাঁচশত টাকা যৌতুক দিলে অনেক বর পাওয়া যাবে। রমণীর নাম কাদম্বিনী, বাড়ি তার যশোরে ছিল! আপনাকে বোধ হয় বলেছি।”
“হ্যাঁ,! বলেছেন আপনাকে এই মহৎ কার্যের জন্য কতখানি শ্রদ্ধা করবো তা বুঝতে পারছি। আপনি দেবী। আপনি যে পথ দিয়ে যান সে পথের বাতাস ও ধুলা পবিত্র হয়ে যায়।
সরযু মুখ নত করে বললেন,–“আপনি আমাকে লজ্জিত করেছেন।”
মিস্টার রহমান সরযুর লজ্জানত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন স্বর্গীয় আভা তার মুখে ফুটে উঠছে।. আহা তিনি যদি মুসলমান হতেই মিস্টার রহমান পরক্ষনেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে মনে মনে বললে, “ছিঃ সে কি কথা!”
সরযু আবার বললেন–“এই আশ্রয়ে আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি উইল করবে। যে সব স্ত্রীলোক বিপদে পড়ে সংসার হতে তাড়িত ও ঘটনাক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথে দাঁড়াবে। তাদেরকে আমি এখানে স্থান দেবো। অবিবাহিতা রমণীর বিবাহের জন্য স্বতন্ত্র টাকার উইল করবো। সঙ্গে সঙ্গে একটা শিল্প বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। শিল্পের মধ্যে সেলাই শিক্ষাই বেশি হবে। তা ছাড়া কাঠের কাজও শিখাবো!”
“স্ত্রীলোককে কাঠের কাজ শিখাবেন!”।
“তাতে দোষ কি! মিস্টার রহমান? স্ত্রীলোকের গায়ে জোর নাই? আমার ইচ্ছা তাদের সমস্ত শক্তিকে জাগাইয়া দেওয়া। অনিচ্ছায় যেন তাদেরকে পাপ না করতে হয়। সারাজীবন যাতে তাদেরকে পিশাচ হয়ে না থাকতে হয়। বিধাতার রাজ্যে কেউ সারাজীবন পাপকে জড়িয়ে থাকতে পারে না। উচ্চ বংশের রমণী যারা, তাদেরকে আমি নিজে চিকিৎসা বিদ্যা শেখবো! দেশে অসংখ্য ধাত্রী আবশ্যক!
“শ্রদ্ধায় আপনার সম্মুখে আমার মাথা নত হয়ে আসছে। আমার ইচ্ছা সরাজীবন আপনার কাছে থেকে আপনার এই কাজে সাহায্য করি।”
“ভগবান কি সে সুবিধা করে দেবেন? আপনার ন্যায় দৃষ্টিসম্পন্ন একজন ব্যক্তির সাহায্য পেলে আমি দ্বিগুণ শক্তিতে কাজ করতে পারি।”
রহমান বলিলেন–“আপনার এ গভীর বেদনার মূল কী? কি করে এই বিরাট সহানুভূতি আপনার হৃদয়ে জাগলো? আমি আপনাকে নমস্কার করি।”
সরযুর চোখ অকস্মাৎ জল দেখা দিল। স্বর তাঁর ভারি হয়ে উঠলো। রুমাল দিয়ে অতি কষ্টে চোখের জল সরিয়ে বললেন—”আপনি কি তা শুনবেন? পরে বলবো।”
রাণাঘাটের বহু লোক ফুলারানীর প্রেমে পড়িয়া সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কালীপ্রসন্ন নিজের স্ত্রীকে ফেলে থুয়ে রাত দিন ফুলরানীর দরজার পরে থাকে। সেখানেই সে খায়, সেখানেই।
সে শোয়। লোকে বুঝাইতে চাইলে সে বলে, ফুলরানীকে সে ভুলতে পারে না–তাতে তার অধম হবে।
কুৎসিৎ রোগে ফুলরানী আজ কয় মাস ধরে কষ্ট পাচ্ছে। কোনো চিকিৎসায় ফল হয় না দিন রাত্রি অপরিসীম কষ্ট।
ফুলীর মা কলকাতা যেয়ে শুনে এসেছি। লেডী ডাক্তার সরযু এই সমস্ত চিকিৎসায় খুব পারদর্শী। অসংখ্য টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিলো। ১০০ টাকা ভিজিটে এবার ডাক্তার সরযু ফুলরানীকে দেখতে আসছেন।
রাত্রি আটটার সময় সেভেন-আপে রাণাঘাটে সরযু গাড়ি থেকে নামলেন। বিশেষ কোনো কারণে মিস্টার রহমান আসতে পারেন নাই। অবিলম্বে একখানা গাড়ি ঠিক করে তিনি ফুলানীর বাসা অভিমুখে যাত্রা করলেন। ষ্টেশনে ফুলরানীর চাকর রাধা এসেছিল।
দ্বিতল বাড়ি। উপর তলার প্রকোষ্ঠে একখানা বহুমূল্য পালঙ্কের উপর ফুলরানী শুয়েছিল। নিকটেই একখানা চেয়ারে ফুলীর মা বসেছিল। দরজায় কালীপ্রসন্ন দাঁড়িয়ে।
ফুলীর মা ডাক্তারকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাহার হাত ধরে যানাক্লিষ্ট ফুলরানীর বিছানার পার্শ্বে নিয়ে গেল।
কালীপ্রসন্ন তখনও দাঁড়িয়ে। ফুলরানীর মা বিরক্ত হয়ে বললে ”আজ যাও বাপু! রাতদিন এমনি করে বিরক্ত করলে কি করে চলে? দেখতে পাচ্ছো তো, ফুলীর কত অসুখ!”
ফুলরানী যাতনায় অস্থির হয়ে চিৎকার করছিলো। কলিকাতার ডাক্তারকে দেখে সে বিছানায় উঠিয়া সরযুর হাঁটু জড়াইয়া ধরিয়া কহিল,–“মা গো, আর সহ্য হয় না। একটু বিষ দিন বিষ। খেয়ে প্রাণত্যাগ করবো। আর পারি না!”
সরযু শান্তস্বরে বলিলেন, “তোমার ব্যথা এখনই সেরে যাবে। আমি ঔষধ দিচ্ছি।” সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটু ঔষধ খাইয়া দিলেন।
প্রায় আধ ঘণ্ডার মধ্যে যাতনা কমে গেল। ফুলীর মা সরযুর পা জড়াইয়া ধরিয়া বললে, “আমাদেরকে রক্ষা করুন, আপনার ভালো হবে। আমরা পতিতা, সকলেই আমাদেরকে ঘৃণা করে। টাকা খরচ করিলেও কেউ ঘৃণা করে আমাদেরকে ভালো ঔষধ দেয় না। এ যাবৎ কেউ আমাদের বাড়িতে আসে নাই। আপনি দেবী, তাই আপনার এই দয়া।”
সরযু বলিলেন, আমি ডাক্তার মানুষ, ঘৃণা করলে ব্যবসা চলে না। বিশেষ করে এইসব চিকিৎসা আমি করে থাকি।”
সরযু আর একবার ঔষধ খাওয়াইয়া দিলেন।”
আর একঘণ্টা কেটে গেল। ফুলীর সকল বেদনা যেন কি যাদুমন্ত্রে অকস্মাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেলঃ ফুলরানী কৃতজ্ঞতায় মাটিতে নামিয়া সরযুর পা জড়াইয়া ধরিয়া বললে”মা আপনি দেবী! আপনার ঔষধ অমৃত।”
রাধা চৌকাঠের উপর বসে ঝিমুচ্ছিলো।
সরযু বললেন–“একেবারে নিরাময় লাভ করতে হলে তুমি আর কখনও কোনো পুরুষের স্পর্শে আসতে পারবে না।”
ফুলী হাত জোড় করিয়া বলিল–“আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আপনার কাছে। আপনি আমার জননী। আপনি দেবী। আর আমি পাপ করবো না। যখন দারুণ দুঃখে এই পাপ পথ অবলম্বন করি, তখন খোদার কাছে প্রতিজ্ঞা করি, ‘খোদার দুঃখ ঘুচলেই তোমার পথে ফিরে আসবো।’ অনেক অর্থ হয়েছে। তবুও এই প্রলোভন হতে মুক্ত হতে পারি না। আমাদের কি খোদা নাই? আমরা কি শৃগাল-কুকুর অপেক্ষাও অধর্ম? কিন্তু কোথায় যাবো? যে সমস্ত নরপিশাচ আমাকে অনুগ্রহ করে, তাহারা আমাকে স্থান পরিত্যাগ করতে দেখলে শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। মাগো, আমাকে রক্ষা করুন। এই পাপ-পথে আর আমি থাকবো না একটু স্থান কোথাও পেলে, এই বৈভব-এই সম্পত্তি ফেলে শাক খেয়ে থাকবো। মৌলবীদের কাছে পরলোকের কথা শুনেছি কি ভয়ানক, কত পৈশাচিক, আমাদের জীবন। কিন্তু ইচ্ছা করে আমি এই পথে এসে দাঁড়াই নি। সংসার আমাদিগকে এখানে তাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায়, অবহেলায় আমরা এখানে এসেছি। কুকুর অপেক্ষা ঘৃণিত ছিলাম। এক্ষনে আমি রানী হয়েছি, কত ভদ্র ও বড়লোক আমার চরণ লাভ করিবার জন্য ব্যস্ত।”