আমেনার দৃঢ় বিশ্বাস হইল, এই মেয়েটি নরপিশাচ হাছানের প্রণয়িনী। দিবারাত্র ললিতার সহিত গল্প করে। মানুষ যেখানে প্রাণের প্রতিধ্বনি পায় সেখানেই সে যায়; কেহ তাহাকে বাধা দিতে পারে না। যে বাধা দিতে চায় সে ভুল করে।
ললিতার কিছুমাত্র সঙ্কোচ নাই। হাছান বৈকাল বেলায় বাড়ি আসিলেই সে তার স্বাভাবিক স্নেহে অনুপ্রাণিত হইয়া হাছানকে বাতাস করে। তাহার খাইবার বন্দোবস্ত সে-ই করে। তাহাদের আসার পরদিন হইতে মিস্টার হাছানের আহারের পরিবর্তন হইয়াছে। সে সব জিনিসে অনভ্যাসবশত বা সংস্কারফলে ললিতার ঘৃণা উপস্থিত হইতে পারে, সে-সব দ্রব্য তিনি সেই দিন হইতে পরিত্যাগ করিলেন।
দারুণ ঘৃণায় একটি দীর্ঘ ভুল বুকে লইয়া আমেনা একদিন বাপের বাড়ি চলিয়া গেলেন। মিস্টার হাছান আমেনার হাত জড়াইয়া ধরিয়া তাহার অপরাধ প্রকাশ করিতে বলিলেন। আমেনা কোনো কথা বলিলেন না। সারা জীবন আর তিনি হাছানের কাছে ফিরিয়া আসেন নাই।
দুটি অতি দুঃখী আত্মার সঙ্গে সারা জীবন কাটিয়া গেল। যদি তাদের পরিচয় না হইতো, তা হলে বোধহয় তারা কেউ বাচিত না।
জিজ্ঞাসা করি–বিবাহ জিনিসটা কী? বিবাহ কি সহানুভূতির আদান প্রদান নহে?
ললিতা শেষ জীবনে মহাপুরুষ মোহাম্মদের মহামানবতাকে বিশ্বাস করে ছিলেন। সারাজীবন হাছান ললিতার বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন।
.
পঞ্চচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
স্টীমারের উপর রমা ও নিহার বসেছিল। নইম শেখের সঙ্গে পালিয়ে তারা রাইপুরে যাচ্ছে।
এমন সময় টিকিট কালেক্টর এসে টিকিট চাইলে। তখন নইম শেখ নিচে গিয়েছিল। রমা কহিল–“টিকিটি তাদের কাছে নাই।”
‘টিকিটওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল–“কোথায় যাবে তোমরা?”
একটু ভীত হইয়া রমা কহিল–“তাতো জানি না!”
বাবু একটু সন্দিগ্ধ হইয়া উঁচু গলায় জিজ্ঞাসা করিল–কোথায় যাবে জান না। কী জাতি তোমরা?”
নিহারকে দেখাইয়া রমা বলিল–“উনি ব্রাহ্মণ, আমি শূদ্র।”
বাবু আরও বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“তোমাদের সঙ্গে কে?”
রমা ইতস্তত করিতে লাগিল। বাবু সন্দিগ্ধ হইয়া আরও উঁচু গলায় বলিল–“তোমাদের সঙ্গে কে যাচ্ছে বল।”
রমা বলিল–“নইমুদ্দীন শেখ!”
বিস্ময়ে বাবু আবার বলিল–“নইশ শেখ! তোমরা হিন্দু একজন বামুনের মেয়ে, আর একজন শূদ্র। যাচ্ছো কোথায় জান না! যে নিয়ে যাচ্ছে সে মুসলমান!”
চিৎকার করিয়া বাবু ডাকিল–“পুলিশ পুলিশ!”
অবিলম্বে দুইজন সিপাহী এসে সেখানে উপস্থিত হল। মূর্তি তাদের অতি ভয়ানক। অন্তর তাহাদের কত কাল তা কে জানে।
অনেক লোক রমা ও নিহারের চারিদিকে দাঁড়াইয়া গেল। এমন সময় নইমুদ্দীন এসে সেখানে উপস্থিত। সিপাই রাহেন কহিল–“শালা, দুই দুইটি মেয়েকে বের করে নিয়ে পালাচ্ছে!”
নইমুদ্দীন থতমত খাইয়া গেল। কে কি উত্তর দিবে, বুঝিতেছিল না। রমা ও নিহার কাদিতেছিল। অবিলম্বে একখানা কাপড়ে নইমের হাত বাঁধা হয়ে গেল।
কমলাপুরের সাব-ইন্সপেক্টর সুরেন বাবু রাগে জ্বলে গেলেন। মুসলমানেরা এত বড় স্পর্ধা! তিনি হুকুম দিলেন, “গারদ-ঘরে শালার দাড়ি ধরে একেবারে হাড় ভেঙ্গে দাও। বিচারে, যা হয় হবে! চাকরির পরোয়া সে করে না।“
সুরেন নিজ ব্যয়ে রমা ও নিহারের বাড়িতে তার করে দিলেন। জাতি যাবার ভয়ে তারা কেউ এলেন না! বাড়ি হতে যে মেয়ে বেরিয়ে যায়, তার সন্ধান নেওয়া ঘোর অপমানের কথা, তা সুরেন বাবু ভুলে গিয়েছিলেন।
শ্রীঘ্র রমা ও নিহারকে সাক্ষী, করে নইমুদ্দীনকে সুরেন বাবু চালান দিলেন।
হাকিমের সম্মুখে রমা ও নিহার বলিল, “তারা স্ব-ইচ্ছায় নইমুদ্দীনকে সঙ্গে যাচ্ছে। তাতে কাহারো বাধা দিবার ক্ষমতা নাই।” হাকিম পরদিন নইমদ্দীনকে মুক্তি দিলেন। আইনে তাকে বাধা দিবার ক্ষমতা ছিল না। রাত্রিতে গারদ–ঘরে রমা ও নিহারের সকল গৌরব ও সকল মর্যাদা চুরি হয়ে গিয়েছিল।
নইমুদ্দীনের চোখের সম্মুখে এই ভয়ানক অত্যাচার হয়ে গেল। হিন্দু হলেও তারা যে নইমুদ্দীনের নাতিনী! একটা অতি ভয়ানক মানসিক বেদনাময়, পুলিশের ভীষণ প্রহারে ও অপমানে নইমুদ্দীনের সেই দিন মনের অবস্থা অত্যান্ত খারাপ ছিল।
সে ক্ষিপ্ত শৃগালের মতো নদীর কূল দিয়ে রমা ও নিহারকে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অমাবস্যার রাত্রি। বনপথে গভীর নিবিড় আঁধার। তারা স্টীমারঘাটে যাচ্ছিল। হঠাৎ নইমুদ্দীনের মাথায় এক প্রচণ্ড আঘাত পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে দুইটি বলবান হিন্দু যুবক রমা ও নিহারের হাত ধরে আঁধারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
৪৬-৪৮. সরযু তার বাসার প্রকোষ্ঠে
ষত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
সরযু তার বাসার প্রকোষ্ঠে বসেছিলেন। মিস্টার আবদুর রহমান তাঁর সম্মুখে। সরযু বলিলেন–“মিস্টার রহমান, আপনাকে আমার সঙ্গে রাণাঘাটে যেতে হবে।”
মিস্টার রহমান বলিলেন,-বেশ, আপনার অনুরোধ আমি পালন করবো। কিন্তু কোথায় থাকবো?” ..
“কোথাও থাকতে হবে না। আমার সঙ্গেই যাবেন।”
“লোক কিছু বলবে না তো?”
“লোকের কথাকে আপনি ভয় করেন? আপনার যদি মনের জোর না থাকে, তবে আপনি হিন্দুর পোশাকে যাবেন।”
“আচ্ছা।”
“আমার শুধু রোগী দেখা নয়, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে আছে।”
“কী উদ্দেশ্যে।”
“সেখানে গেলেই বুঝতে পারবেন।”
“যে রমণীকে সেদিন পথ থেকে তুলে এনেছি, তার শরীর খুব ভালো হয়েছে। তার মেয়েটি দেখতে কার্তিকের মতো। মা ও মেয়ে উভয়ের লেখা পড়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছি।”