আমেনা কথা কহিলেন না। বিবাহের পর ছয় মাস সুখে কাটিয়াছিল। তারপর আমেনা নিত্য নূতন কল্পিত অপমান ও উপহাসে কাল্পনিক দীনতা ও হীনতায় নিজেকে স্বতন্ত্র করিয়া রাখে। সে সব সময়ই মনে করে, সে ছোট-তার স্বামী তাকে মনে মনে ঘৃণা করেন। শথ চেষ্টাতেও সে তার মর্যাদা বাড়াইতে পারে না। বিধাতা তাকে ছোট করিয়াছেন, মিস্টার হাছানের স্তুতিবাক্যে সে বড় হইতে পারে না। সে তাতে আরও বিরক্ত হয়। সে দিনে দিনে আপনাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাছানের পার্শ্ব হইতে সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিতেছিল। হাছান তাহার দিকে হাসিলে সে মনে করে, এ তীব্র উপহাস কেন? যদি হাছান স্ত্রীকে নমস্কার করেন, আমেনা ভাবে তাহার হীন ব্যক্তিত্বকে আরও হীন করিয়া ফেলা হইল। সারাদিন সে চিন্তা করে। প্রতি কাজে সে নিজেকে অপমানিত মনে করে। চাকরাণীরা হাসিতে থাকিলে
আমেনা মনে করে, তাহারি হীনতা লইয়া তাহারা কানাকানি করতেছে।
যদি বেশি মূল্যের কাপড় আনিয়া দেওয়া হয় আমেনা বিরক্তির সহিত ভাবে আমার হীনতাকে ঢাকিবার জন্য বাহিরের আঁকজমকপূর্ণ পোশাকের ব্যবস্থা হইতেছে। আমি ছোট তাই দামী পোশাক পরিয়া মর্যাদা বাড়াইয়া তুলিতে হইবে। যদি কাছে আসিয়া রসিবার জন্য হাছান ডাকেন, আমেনা ভাবে–আমাকে না ডাকিয়া আমার কাছে আসিলেই তো হয়। যদি হাছান তাহার বিছানায় যাইয়া বসেন, আমেনা মনে করে–যেন অতিথি! একটু আলাপ করিয়া তাহাকে আনন্দ দেওয়া হইতেছে মাত্র।
রান্না যদি বেলা হয়ে যায়, আমেনা মনে করে সে ছোট ঘরের মেয়ে বলে তার প্রতি এই অবহেলা। ঘৃণায় সে চাকরানীদের সহিত কথা বলে না। সে সর্বদা মনে সন্দেহ করে–চাকরানীরা মনে করে, সাহেবের বউ ছোট। আমেনা তাহাদেরকে কোনো আদেশ দিতে ভয় ও সঙ্কোচ অনুভব করে।
বাহির হইতে কে যেন দরজায় আঘাত করিল। এই ঝড়ের মধ্যে কে পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টের ঘরে, আঘাত করিতে সাহস করে? ঝড়ের শব্দকে উপেক্ষা করিয়া সে শব্দ মিস্টার হাছানকে বিস্মিত করিল।
মিস্টার হাছান রিভলভারটি ঠিক করিয়া দরজার কাঠে উপস্থিত হইয়া ধীরে ধীরে দরজা খুলিয়া দিলেন।
অতি ক্ষিগ্রবেগে একটি রমণীমূর্তি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। এ কি? এ যে ললিতা!
সর্বাঙ্গ তার সিক্ত। সে কাঁদিতেছিল। অত্যন্ত শ্রদ্ধায়, অতি পুরাতন উদ্বেলিত স্নেহ-স্মৃতিতে মিস্টার হাছান ভাই এর মতো অত্যন্ত বিস্ময়ে অত্যন্ত আবেগে ললিতাকে জড়াইয়া ধরিলেন।
আমেনা এই পৈশাচিক দৃশ্য দেখিল। তার চোখের সম্মুখে স্ত্রীর প্রতি এই অবমাননা! অত্যন্ত ঘৃণায় অত্যন্ত লজ্জায় একটা মূৰ্ছাকে অতি কষ্টে সংবরণ করিয়া আমেনা অন্ধকারে নিজের বিছানায় আসিয়া শুইয়া পড়িল।
মিস্টার হাছান স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আমেনা বিবি! ইনি তোমার একজন। বোন! শীঘ্র একখানা শাল আনিয়া দাও।” কিন্তু আমেনা তখন সেখানে ছিল না।
হাছান নিজেই কাপড় আনিয়া ললিতাকে পরিতে দিলেন।
হাছান, বলিলেন–“ললিতা, তোমাকে দেখে আমার কত আনন্দ হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। সেদিন যে পত্র লিখছো তাতে তো কিছুই লেখা নাই! ভালো করিয়া সকল কথা খুলিয়া বল।” প্রথম দর্শনের উদ্বেল আনন্দ সহসা ললিতার মুখে অদৃশ্য হইল।
ললিতা বলিলেন—”আমার জীবন অত্যন্ত অসহনীয় হয়ে পড়েছিলো। আমার চোখের সামনে সারা সংসারটা মরুময় হয়ে উঠেছিলো আত্মা সেখানে প্রতিধ্বনি পায় না সেখানে কারো বেঁচে থাকা কঠিন। সে পিতাই হোক, আর মাতাই হোক। স্নেহ-মায়া ছাড়া জগতে কে বেঁচে থাকতে পারে? আমার জন্য একটু শান্তিও ছিল না। অসহায় আত্মার চারদিকে দিবারাত্র আগুন জ্বলতো। তাই আপনার কাছে এসেছিল অন্নের জন্য নয়ম, সহানুভূতি ও স্নেহের জন্য।”
হাছান চেয়ারে বসিয়াছিলেন। সহসা চেয়ার ছাড়িয়া হাছান অত্যন্ত স্নেহে ললিতার হাত ধরিয়া বলিলেন–“তোমার এই বিশ্বাসকে আমি প্রাণের আবেগ নিয়ে সার্থক করতে চেষ্টা করবো। আজ হতে আবার আমি তোমাকে নূতন করিয়া মানিয়া লইলাম।”
ললিতা বলিলেন–“আজ হতে আবার আমাকে নূতন করিয়া মানিয়া লইতে হইবে কেন? আমি আপনার কে, এ কথা হুগলীর বোর্ডিং ঘরেই তো আপনি আমাকে বলেছেন।”
গভীর স্নেহে হাছান বলিলেন–“ক্ষমা কর ললিতা। তুমি আমার চিরজীবনের বোন। কিন্তু তোমার যে আজ হতে জাতি গেল?”
ললিতা ঘৃণায় সহিত বলিলেন, “আমার জাতি গেল? কী ভয়ানক কথা! এমন কথা বললে যে পাপ হয়। আপনার স্পর্শে এসে আমার জাতি যাবে? আপনি ব্রাহ্মণের চেয়ে অনেক বড়। বিধাতা কাহারো কপালে ব্রাহ্মণের ছাপ মারিয়া দেয় নাই। আমার বিশ্বাস আমার কাছে। আমার জাতি যাইবে ও কথা যদি কেউ বলে, তাহা হইলে বুঝিবে সে আমার মনুষ্যত্বের প্রতি ঘোর অবমাননা করিল। পাপীকে ঘৃণা করা নিতান্ত অযৌক্তিক না বলেও পূণ্যবানকে যে ঘৃণা করিবে, বিধাতার বজ তাহাকে অস্তিত্বহীন করিয়া দিবে। স্বাতন্ত্রের দ্বারা জাতিকে বাঁচাতে চেষ্টা না করিয়া মনুষ্যত্বের পাথর দিয়া জাতির জীবন গঠন করিতে হইবে। আমি ঐ সব মানি না। বিশ্বাসে মানুষের মুক্তি নাই, মুক্তি কর্মে। কমেই মানুষের মহত্ত্ব। মহত্ত্বের প্রাণ মানুষের সেবায়, আর্তের রক্ষায়, পতিতের উদ্বারে গভীর সহানুভূতিও বেদনাবোধ, ঘৃণায় নহে।”