একজন দয়াদ্ৰহৃদয় মুসলমান ভদ্রলোক বললেন, “আমি তোমাকে টাকা দিতে রাজি আছি। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”
কুলসুম কাঁদিয়া বলিল,–“আমায় কেটে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে! কোথায় গেলেন।“
ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। একটা পথহারা অসহায় রমণীর সহিত কথা না বলিয়া সকলে ঈশ্বর উপাসনায় মন দিলেন। ছোটলোকেরা অশ্লীল ভাষায় বলাবলি করিতেছিল–মাগীর যেমন কামড়।
০ ০ ০ ০
এমন সময় একটা যুবতী আসিয়া কুলসুমের হাত ধরিয়া কহিল–“আয় বোন, আমার সঙ্গে আয়-ভয় কী তোর?” সে ছখিনা পতিতা।
কুলসুম মাথা নত করে তার পেছনে পেছনে চলে গেল।
.
ত্ৰিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
লেডি ডাক্তার সরযুবালা গাড়িতে চড়ে হ্যারিসন রোড দিয়ে যাচ্ছিলেন। সহসা তাহার দৃষ্টিপথে একটি রমণী পড়িল। একটি বৃহৎ দালানের রকে বসে রমণী একটি শিশুর মুখে বটের পাতার সাহায্যে দুধ দিচ্ছিল। সরযুর বুকখানি ধড়াস করিয়া উঠিল। রমণীর মাথার চুল উঠে গিয়েছিলো, সর্বাঙ্গে ঘা। পরণে অতি মলিন ছিন্ন বসন। শাঁ শাঁ করে শীতল বাতাসে এসে শিশুটিকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে তুলছিলো। রমণী তার সেই হেঁড়ে কাপড় দিয়ে শিশুকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল। জীর্ণ বসনের সকল জায়ঘায় ছেঁড়া। যে দিক সে ধলতে যাচ্ছিল, সেই দিকই ছিঁড়িয়া যাইতেছিল। সরযু কোচোয়ানকে গাড়ি থামাইতে বলিলেন।
কোচোয়ান গাড়ি থামাইলে; গাড়ি সেখানেই রাখিতে বলিয়া সরযু রমণীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।
একটা ছোট হাঁড়িতে একটু দুধ। কোথা হতে যে সেই দুধটুকু পেয়েছিলো তা জানি। সহসা হাঁড়িটা বাতাসের আঘাতে নিচ পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গেল। শিশু একটু দুধের আশায় তখনও হা করিয়াছিল। সরযু রমণীর সম্মুখে যাইয়া অতি মধুর স্বরে বলিলেন–“তোমার কোনো পাড়ায় বাড়ি, মা?”
কাদম্বিনী একটা মেমসাহেবকে তাহার সম্মুখে উপস্থিত দেখিয়া ভয়ে পলায়ন করিতে যাইতেছিল। পরক্ষণেই সরযুর মুখের অমৃতমাখা বাণী শুনিয়া, কৃতজ্ঞতায় একেবারে চোখের জল ফেলিয়া বলিল,–“আমার বাড়ি নাই মা। আমি ভিখারিনী, মুক্ত আকাশ আমার ঘর, শৃগাল কুকুর আমার আত্মীয়!”
সরযু বলিলেন–“ভয় নাই মা! আমি তোমার আত্মীয়! বল, তোমার বাড়ি কোথায়? এ শোচনীয় অবস্থা তোমার কেন?”
কাদম্বিনী হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া বলিল, “আমার সঙ্গে বেশি কথা বলিবে না। আপনার সম্মান হানি হইতে পারে। আমি পাপীয়সী-পাপ করেছিলেম। স্বামী আমাকে পথে বার করে দিয়েছেন। আমি অস্পৃশ্যা, আমার ছায়ায় আসলে আপনার পাপ হবে। এই শিশুটি আমার পাপের সাক্ষি আমার কেউ নাই, আমায় কেউ নাই। জ্বালায়, যন্ত্রণায় আমাকে পথে পড়ে মরতে হবে।”
সরযু বলিলেন–“আমি পত্নীকে ভালবাসি, আমি নিজেই পাপী–আমি নিজেই অস্পশ্যা। আমার সঙ্গে যেতে রাজি আছ! তোমার চিকিৎসা হবে। তোমার সুখ ফিরে আসবে। বল, যেতে রাজি আছ। আমি তোমার জননী হলাম।”
কাদম্বিনী শিশুকে ফেলিয়া সরযুর পা জুড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল,–“তুমি আমার জননী। তোমার বুকখানি মাতার স্নেহে ভরপুর।”
সরযু দূরে কোচোয়ানকে গাড়ি আনতে বলিলেন।
.
চতুশ্চত্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি বহিতেছিল। রানীগঞ্জের পুলিশ সাহেব মিস্টার হাছান কামরায় বসে অফিসের খাতা দেখছিলেন আর পার্শ্বে চেয়ারে উপবিষ্টা স্ত্রী আমেনার সহিত কথা বলছিলেন। তখন রাত্রি নয়টা। বাহিরে প্রলয়ের ভয়ে সকল মানুষ রাস্তা-ঘাট ছেড়ে যে যার মতো আশ্রয় গ্রহণ করেছে।
মিস্টার হাছান বলিলেন,–“প্রিয় আমেনা তোমার এমন ভাব কেন? সকল সময়ই তোমার মুখ ভার। এতে আমার অত্যন্ত কষ্ট হয়। বিবাহিতা জীবন পুস্তকেই শুধু পড়েছি বড় সুখের। শুনিয়াছি, প্রেমিকা ধারায় স্বর্গ রচনা করেন! তাদের প্রেম মুনি-ঋষির জিনিস। পুস্তকেই পড়িয়াছি, জীবনে তাহার সন্ধান পাই না কেন!”
আমেনা কথা বলিলে না।
মিস্টার হাছান আবার কহিতে লাগিলেন,–“যখন কলেজে পড়িতাম তখন কবিদের রঙ্গিন কল্পনা বাস্তবে পরিণত করিবার বাসনা ছিল। কিন্তু একজনের ইচ্ছায় কী তা সম্ভব! তুমি এমন করিয়া দূরে দূরে থাকিলে আমাদের জীবন কত বিষময় হবে, তা কি তুমি বুঝতে পার না? কি তোমার বেদনা, আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি তুমি খুলে বল, আমি তার জন্য ক্ষমা চাহিব–আমি তার প্রতিবিধান করবো। খাওয়া একদিনও ভালো হয় না। চাকরানীর যা ইচ্ছে তাই রান্না করে রাখে। তুমি যদি একটু দয়া করে দেখ, তাহলে তো কোনো দোষ হয় না। তুমিও তা খাবে। আর দয়া করে যদি আমাকে স্বামী বলে মানো। তাহলে আমিও তো খাবো। এতে কি অপমান বিবেচনা করো? কাজে কি অপমান আছে? অপমান হয় পাপে ও নীচতায়। কাপড়, জিনিসপত্রের কিছুরই ঠিক থাকে না। যেখানে সেখানে জিনিসপত্র পড়ে থাকে। প্রত্যহ একখানা রুমাল বাজার থেকে আসে, অথচ একখানাও ঠিক থাকে না। এসব কে দেখবে, বল? আমার কি আপন আর কেউ আছে? কত শিশি গন্ধতেল সেফের উপর সাজানো। তুমি স্পর্শ করবে না। বিধবার বেশে মলিন কাপড়ে রুক্ষ কেশে কাল কাটাও। চোর ডাকাতকে জব্দ করতে পারি কিন্তু বিদ্রোহী আত্মাকে আমি দমন করদে পারি না। তোমার এমন ভাব কেন? এ বেদনা আমার কাছে অসহ্য হয়ে পড়েছে। জীবনে কিছুমাত্র সুখ নাই।”