লোহার শৃঙ্খলে বাধা হাত-পা বদ্ধ। রাত্রি বারটার সময় মাটির ভিতর কোমর পর্যন্ত পুঁতিয়া পাথর দিয়া তাহাকে চূর্ণ করা হইবে। ভদ্রলোকের বাড়িতে একজন বিদেশীর এই কাণ্ড করিবার সাহস! অতি গোপনে রাত্রি ৩টার সময় এই ভয়ানক কাণ্ড সংঘটিত হইবে।
ফিনির সম্মুখে এবাদের মাথা চুর্ণ করা হইবে। সে দাঁড়াইয়া দেখিবে, পিতার অনুমতি লইয়া কাহারো সহিত প্রেম করিলে সে প্রেমিকের কি দশা হয়।
মুক্তির আর কোনো আশা নাই। অনুতাপে আর কোনো ফল নাই। নিজ কৃত অপরাধের ফল এবাদকে মাথায় করিয়া লইতে হইবে। কেউ তাহাকে রক্ষা করিবে না। কী সাংঘাতিক!
রাত্রি ১২ টার আর বেশি দেরি নাই। আবাদ সেই নিভৃত গুহায় একাকী ঘড়ির দিকে চাহিয়া, সেকেণ্ডের কাটাটি হনহন করিয়া ঘুরিয়া আসিতেছে, দেখিতেছিল। এ কি আর স্ত্রীর প্রতি অত্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রায়শ্চিত্ত?
এবাদ তখন ভাবিতেছিল, যদি একবার সে তার স্ত্রী দেখা পাইত তাহা হইলে জীবনের এই শেষ মুহূর্তে সে তার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাইয়া লইত।
টং টং করিয়া গাড়িতে ১২টা বাজিল, সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকার নিভৃত গুহার লৌহদরজা অতি সহজে খুলিয়া গেল।
সেই অন্ধকারের ভিতর এবাদ দেখিল, যেন একটা মানুষ প্রবেশ করিল। এ কি ঘাতক?
ভয়ে এবাদ চীৎকার করিতে যাইতেছিল হঠাৎ একটা নারীর কোমল স্পর্শে এবাদ চমকিত হইয়া উঠিল। যে আর্তস্বরে অতি ধীরে জিজ্ঞাসা করিল–“কে?”।
বেলা কহিল–“ভয় নেই, এই কাপড় পরুন। আপনাকে মুক্তি দিতে আসিয়াছি। আপনার কাপড় আমাকে দিন। আমি মিস্টার এবাদ হইয়া এখানে বসিয়া থাকিব। এই শান্তি আমি লইব। দেরি করবেন না। রাস্তায় অন্ধকারে গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে।”
সহসা এবাদ একটা প্রচণ্ড মানসিক বিবর্তনের আঘাতে পড়িয়া যাইতেছিল। এ কী স্বপ্ন! জাপানে কি এমন রমণী সম্ভব?
কিন্তু তাহার ভাবিবার সময় ছিল না। সে বেলার সহিত কাপড় বদলাইয়া লইল। তারপর বেলার পুরুষ পোষাক-পরা দেবীমূর্তির সম্মুখে সেই নিবিড় আঁধারে একটা অজানিত স্বর্গীয় ভাবাবেগে মাথা অবনত করে সে বাহির হইয়া পড়িল। একটা পুরুষ দরজায় দাঁড়াইয়াছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে অতি সন্তর্পণে অন্ধকারের ভিতর দিয়া বেলার পোষাক-পরা মিস্টার এবাদ রাস্তায় যাইয়া অপেক্ষমান গাড়িতে উঠিয়া বসিল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নক্ষত্রবেগে সাগরকূলে জাহাজঘাটে ছুটিল। রাত্রি তিনটার সময় ভারতীয় মেলে মিস্টার এবাদ জাপান ছাড়িয়া দেশ অভিমুখে যাত্রা করিল।
ঠিক সেই সময় মিস্টার, এবাদের পোষাকে আবক্ষ প্রোথিতে মাথায় পাথরের উপর পাথর পড়িতেছিল। চিৎকার নাই, চাঞ্চল্য নাই,–নিশ্চল পাথরের মতো আঘাতের উপর আঘাত সে সহ্য করিতেছিল।
দরিদ্র স্বামীর রোগমুক্তির জন্য সতীসাদ্বী বেলা ১০,০০০ টাকার পরিবর্তে আপনাকে চূর্ণ করিয়া ফেলিল।
পরদিন উষাকালে মিস ফিনি দশ হাজার টাকা নিয়ে যখন লেমানের কাছে উপস্থিত হল তখন লোমন বিছানার উপর নিশ্বাসহীন জড় পদার্থের মতো পড়েছিল। ফিনি লেমানের মৃতদেহ ঠেলিয়া দেখিল তাহার বুকের সঙ্গে দলা করা একটা জামা, সেটা বেলার!
.
দ্বিত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
কলিকাতা ট্রেটি বাজার চর্বির দোকানের সম্মুখে একটা অসামান্য রূপবতী মেয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছিলো।
রমণীটি কে? অনেক মুটে মুজুর ছোটলোক যুবতীর চারি পার্শ্বে দণ্ডায়মান। অনেক ভদ্রলোক সেই পথ দিয়া যাচ্ছিলেন। লোকে কি বলবে, এই ভয়ে তাহারা যুবতীর দিকে একবার মাত্র নজর করে আপন কাজে চলে যাচ্ছিলেন। গঙ্গার-উত্তর ধারের একজন খুঁড়িওয়ালা লোক সাত হাত হুঁকোর নল টানিতে টানিতে অত্যন্ত ঘৃণার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “বাড়ি কোথায় মাগী?”
“বাড়ি আমার ঢাকা।”
“যার সঙ্গে বের হয়ে এসেছিল, সে তোকে ফেলে বুঝি পালিয়েছে?”
কুলসুম আবার হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সে স্বরে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইতেছিল। সকাল বেলা গাড়ি হইতে নামিয়া জনতার মধ্যে সে এবাদকে হারাইয়া ফেলিয়াছে। সারাদিন হাঁটিয়া হাঁটিয়াও সে এবাদের সন্ধান পায় নাই। সন্ধ্যাকালে সে কলুটালা, দিয়া ড্যামজেনলেন দিয়া ট্রেটি বাজার যাইয়া অত্যন্ত দুঃখে অসীম, বেদনায় আত্মকৃত পাপের অনুতাপে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিতেছিল।
ছেলেমানুষ এবাদ যৌবনের উদ্দাম বাসনায় মুগ্ধ হয়ে তার ভাবিকে নিয়ে কলিকাতার বুকের উপর এসে যখন দাঁড়ালো, তখন সহসা ক্লান্তিভরা পথের মাঝে অতি ভীষণ অনুতাপ এসে তার কবি বুকখানা জড়িয়ে ধরলো। সে তখন বুঝতে পারলো, কী ভীষণ কাজ সে করেছে। সমস্ত বিশ্ব তাকে মৌন ভাষায় বলেছে, ওরে নরপিশাচ, ওরে শয়তান, কী করেছিস। . সে ভয়ে ভাবিকে রাস্তার ভিতর ফেলে ফেরৎ গাড়িতে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করিল। সে একটুও ভাবলো না, তার ভাবির কি হবে! মুহূর্তের ভুলের ফলে হাসতে হাসতে সে তার ভাবির অতি সুন্দর, অতি পবিত্র, অতি মহান দীর্ঘ জীবনের উপর একটা দীর্ঘ শ্মশান রচনা করা গেল। ওহো! উদ্ধার নাই, পথ নাই, ফিরবার উপায় নাই–একটুখানি দাঁড়াবার জায়গা নাই, সে কি পুরুষ? হাজার পাপে যার দোষ হয় না, যে জীবন ভরে ব্যভিচার করে, বৃদ্ধকালে সে দেশপূজ্য মহাপুরুষ হতে পারে!
অসীম জ্বালায় কুলসুম কাঁদছিলো। তার পদ্মের মতো পা ছিটে রক্ত বেরুচ্ছিলো, কিন্তু তবুও তো কেউ তাকে একটু বসতে দিতে পারে না। কারণ তার তখন জাতি গিয়েছে, সে অস্পৃশ্য, তার সঙ্গে মানুষ কথা বলতে লজ্জা করে।