সেদিন সন্ধ্যাকালে পাড়ার লোক হাটে গিয়াছিল। লোহারাম স্ত্রীকে সম্মুখে আসিতে বলিল। রোগযন্ত্রণায় কাদম্বিনী নড়িতে পারিতেছিল না, তত্রাচ সে লোহারামের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। কাদম্বিনী তখন আট মাস। লোকে তখন বেশ করিয়া কানাকানি আরম্ভ করিয়াছে। কাদম্বিনী কিছুমাত্র গ্রাহ্য করে নাই।
লোহারাম কহিল–“এ সব কী কানাকানি আরম্ভ হইয়াছে? প্রমাণও তো যথেষ্ট পাচ্ছি, অর্থটা কি বল।”
কাদম্বিনী তাহার সকল যন্ত্রণা তখনকার মতো ভুলিয়া গেল। দারুণ উত্তেজনায় কঠিন স্বরে কাদম্বিনী বলিল–“তুমি হয়তো আমার পেটে ছেলে হবার কথা বলিতেছ?”
লোহারাম বলিল”হ্যাঁ, ব্যাপারখানা কী?”
“ব্যাপার কিছুই নহে। রাধা আমার স্বামী! তাহারি সহবাসে আমি অন্তঃসত্তা হইয়াছি।”
একটা জ্বলন্ত অগ্নিময় স্পর্শে লোহার বুকটা অকস্মাৎ ছ্যাৎকরিয়া উঠিল। সে অত্যন্ত ঘৃণার, সহিত বলিল–“রাধা তোমার স্বামী। আর আমি? কবে সে তোমাকে বিবাহ করিয়াছিল?”
কাদম্বিনী বলিল”কোনোও কালে মন্ত্র উচ্চারণ না করিলেও সে আমার অভাব দূর করিয়াছে, ভালবাসিয়াছে ও স্নেহ করিয়াছে। দুটি না বোঝা মন্ত্রের দোহাই দিয়ে তোমার মতো লম্পট আমার জীবনকে শ্মশান করে রাখবে, ইহা কোনো শাস্ত্র অনুমোদন করে না আর স্বামীই যদি হও তবে এর জন্যে দায়ী কে? এ পাপ ও কলঙ্কের কারণ তুমি। তুমি নরপিশাচা স্বামীর মূর্তিতে তুমি আমার বুকে ছুরি দিয়েছ।”
বাঘের মতো লোহারাম কাদম্বিনীর ঘাড়ের উপর যাইয়া পড়িল। যদি আইনের ভয় না থাকিত তাহা হইলে লোহারাম তদ্দণ্ডে কাদম্বিনীকে হত্যা করিত। লোহারাম কাদম্বিনীর চুল মুড়িয়া দিল। তাহার পরিধনের বস্ত্র কাড়িয়া লইয়া তাহাকে বাড়ির বাহির করিয়া দিল।
সেই রাত্রে গৃহ হইতে তাড়িত হইয়া কাদম্বিনী রাধার করুণা ভিক্ষা করিয়াছিল। নরপিশাচ রাধা কহিল ”ভদ্রলোকের মাথায় যদি কলঙ্ক চাপাও তাহা হইলে আমি তোমাকে জেলে দিতে ছাড়িব না”।
বতাহা আঁধারে নদীর কূলে অসহায় গৃহ হইতে তাড়িতা কাদম্বিনীর মৌন আত্মাটি কেমন করে নিজের কাছে কাঁদছিল–সে খবর রাখতে সকলেই লজ্জাবোধ করে বোধ হয়?
৪১-৪৫. নিভৃত কুটীরে ফিনি
একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
নিভৃত কুটীরে ফিনি এবাদের পার্শ্বে বসিয়াছিল। অসীম আবেগে তাহার প্রণয়ীর মুখে সে চুম্বনের উপর চুম্বন প্রদান করিতেছিল।
সেই আঁধার প্রকোষ্ঠের এক কোণে একটা ম্লান প্রদীপ তাহাদের নির্জন প্রণয়ভরা চাঞ্চল্যকে আরও চঞ্চল করিয়া তুলিতেছিল। বহুমূল্যে একখানি, তদুপরি প্রায় দেড়হস্ত। পরিমিত মোটা গদি কামগন্ধভরা হৃদয়ে বাসনা ও কামনা জাগাইতে অত্যন্ত অনুকূল। অসীম সুখে এবাদ সেই দুগ্ধফেননিভ উপর আপনাকে ছাড়িয়া দিয়াছিল।
সহসা দরজায় আঘাত পড়িল। ফিনির সকল ও উল্লাস, কামনা ও আনন্দ একটা অতি শীতল বিরাট বরফ্যুপের চাপে যেন চৈতন্যহীন হইয়া গেল। অথবা জগতের একটা অতি মধুর সুষমা-ধরার সহিত যদি কাহারো ওষ্ঠের স্পর্শ হইতে থাকে আর ঠিক সেই সময়
পৃথিবীটা পায়ের তল হইতে সহসা সরিষা গিয়া একটা ভীষণ আগুনের সীমাহীন পথে। তাহাকে ফেলিয়া দেয় তখন তাহার মানসিক অবস্থা যেমন হয়, ফিনিরও তেমনি হইল। ওষ্ঠ তাহার নীলবর্ণ হইয়া গেল–ধমনীর প্রবাহ সহসা নিথর হইয়া গেল। তাহার চোখ দুটি সহসা মাথার মধ্যে বসিয়া গেল।
আর একটা প্রচণ্ড আঘাত! এবাদ একটা যন্ত্রণাব্যঞ্জক চিৎকার করিয়া কহিল–“ফিনি, মিস, ফিনি! এই দূরবেশ আসিয়া রমণীর মোহে অবশেষে প্রাণ হারাইতে হইল!”
আর একটা প্রচণ্ড আঘাতে ভিতর দিককার অর্গল ভাঙ্গিয়া গেল।
ফিনির পিতা দেখিলেন তার যুবতী কন্যা ফিনি এক যুবকের পার্শ্বে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া আছে।
০ ০ ০
বেলা লেমানের শীর্ণ হাতখানি চুম্বন করিয়া কহিল,–“আমার প্রিয় লেমান সতীর সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবের পথ মুক্ত করিয়া দাও। যেদিন তোমাকে ভালবাসিয়াছিলাম, সেইদিন এদিন ও আত্মা তোমার সেবার নিযোগ করিয়াছি। দশ হাজার টাকায় তোমার উত্তম চিকিৎসা হইবে। তোমার সকল রোগ সারিয়া যাইবে। ছেলেগুলির কষ্ট থাকিবে না। পশুর মতো বাঁচিয়া লাভ কী? এই দেহ তোমার সেবায় উৎসর্গ করিবার এমন সুযোগ কোনো সতীর ভাগ্যে ঘটে না।”
লেমান হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল–প্রিয়তমে, কী ভয়ানক বলিতেছ! আমি তোমার এই ভয়ানক আত্মোৎসর্গ সহ্য করতে পারিব না। আমি আরও বেদনা সহ্য করিতে রাজি আছি।”
“না প্রিয় লেমান, অনুমতি দাও–আমাকে চরম সুখে সুখী হইতে দাও। এতকাল কি তোমার বৃথা সেবা করিলাম? আমাকে এই দান দিতে তুমি ইতস্তত করিতেছ? ইহাতে আমার কত সুখ তা তুমি বুঝিতেছ না?” প্রায় তিনঘণ্টা ধরিয়া বাদানুবাদ হইল। লেমন কাঁদিতেছিল।
ছেলেগুলি বিছানার উপর তাদের পবিত্র ও শুভ্র ফুলের পাপড়ীর মতো ওষ্ঠগুলি মুক্ত করিয়া শুইয়াছিল। দেবী বেলা এক এক করিয়া সন্তানের মুখে চুম্বন দান করিল। আঁখিতে তাহার জল নাই। একটি অসীম পুলক তাহার চোখেমুখে প্রতিভাত হচ্ছিল।
বেলা আবার তাহার স্বামীর হাত ধরিয়া কহিল–“সখে! ছেলেগুলি যখন জিজ্ঞাসা করিবে, মা কই? বলিও তোমাদের মা, বেড়াতে গিয়াছে, শীঘ্রই আসিবে।”
লেমানের শীতল ওষ্ঠে বেলা আর একটা চুম্বন মুদ্রিত করিয়া দেবতাদের হাতে স্বামীকে উৎসর্গ করিয়া পেছনের দিকে চাহিতে চাহিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।