সেদিন মহিউদ্দিন মাদ্রাসায় পেলেন না। সমস্ত দিন তিনি চিন্তা করিলেন, তাহার পর সন্ধ্যাকালে তিনি একখানি পত্র লিখতে বসিলেন–তাহাতে শুধু লিখিলেন–ভাই সাহেব! পত্র পাইয়া যার পরনাই ব্যথিত হইলাম। আপনি মেয়ে দু’টিকে খুব সাবধানতার সঙ্গে এখানে লইয়া আসিবেন, তার পর যাহা করিতে হয় আমি করিব। এই দুইটি অসহায় প্রাণীর জন্য আমি করুণাময় আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।
সারাদিন মহিউদ্দিন চিন্তা করিলেন–মানুষের অত্যাচারে পড়িয়া মানুষ এমন করিয়া কেন জর্জরিত হয়? দেশের কুসংস্কার ও সামাজিক অত্যাচারে প্রপীড়িত কত হাজার হাজার রমণী এমনি করিয়া আঁখিজলে সারাজীবন কাটাইয়া দেয় তাদের কে খবর রাখে? সকল জায়গায় অত্যাচার চলে, মানুষের মনের উপর অত্যাচার চলে না। মানুষের খোদার দেওয়া স্বভাবের বিরুদ্ধে কেন মানুষ একটা কঠিন লৌহ দেওয়াল তুলিয়া দিয়া এত অত্যাচার ও অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়!
সামান্য দীন অবস্থা হইতে অনেক দুঃখ বেদনার সহিত সংগ্রাম করিয়া মহিউদ্দিন বড় হইয়াছিলেন, সুতরাং অনেকখানি দৃষ্টি তাহার লাভ হইয়াছিল। মানুষের দুঃখের প্রতি তাহার মনুষ্যত্ব ভয়ানক রকমে সাড়া দিয়া উঠিত।
তিনি আরও ভাবিলেন–মৌলবীরা যদি চেষ্টা করেন তবে বহু মানুষকে দুঃখের হাত হইতে তাহারা উদ্ধার করিতে পারেন। বহু মানুষ ইসলামের গতিতে আসিয়া নির্বাণ লাভ করিতে পারে। যে বেশি অন্ধ ও মূক তাহার জন্য বেশি বেদনা অনুভূত হওয়া আবশ্যক। গায়ে যার শক্তি আছে সে নিজের স্থান নিজে করিয়া লইতে পারে; পরের সাহায্য তার দরকার হয় না। ইসলাম অর্থ কী? মানুষকে শান্তি দেওয়া, বিশ্বমানবকে দুঃখ হইতে সুখের পথে লইয়া যাওয়া। কুসংস্কার, অত্যাচার ও অন্ধকার মাথায় পদাঘাত করা শুধু ভাবহীন উপাসনা ও উপবাসে ইসলামে মুক্তির খবর নাই।
তাহার মনে হইল, এ-দুটি দুর্বলা নিঃসহায় আত্মাকে যদি সে বাঁচাইতে পারে তবে সে আল্লাহর নিকট অনেকখানি মর্যাদা পাইতে। মহিউদ্দিন ঠিক করলেন সমাজের নিকট ছোট হইবার ভয় থাকিলেও তিনি নিহারকে বিবাহ করিয়া একটা অন্ধ ধর্মহীন ব্যথিত মানুষকে জীবন দান করিবেন। তাহার শিষ্য কছিমুদ্দিনও অবিবাহিত ছিল।
মহিউদ্দিন আবার ভাবিলেন–দেশের জাতির মাথায় কি পৈশাচিক অত্যাচারের ভার চাপান হইয়াছে। শক্তি ও ভারহীন হইয়া তাহারা তাহাদের আত্মার স্বাভাবিক দাবীর কথা ভুলিয়া পরাধীন পশু হইয়া আঁধারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাল কাটাইতেছে। সারা রমণী জাতিটা দারুণ অপমানে আত্মহীন কৃপার পাত্র হইয়া বাচিতে চেষ্টা করিতেছে মাত্র।
.
চত্বরিংশ পরিচ্ছেদ
মাথার তেল ফুরিয়ে গিয়েছিলো–কাদম্বিনী রাধাকে তেল এনে দিতে বললে।
কাদম্বিনী আবার বলিল–দাঁতে তার বড় ব্যথা। একটু মাজন না পেয়ে সে বড় কষ্ট পাচ্ছে। রাতে তার ঘুম হয় না।
সেইদিনই বিকাল বেলা রাধা নিজে পছন্দ করে একজোড়া পাছাপেড়ে বাহারের শাড়ি কিনিয়া আনিয়া দিল। তাতে দোষ কী? কাদম্বিনী কী বিধবা যে সে চুল বাঁধবে না? দাঁতে মাজন লাগাবে না? রাধা এ কথা তাকে প্রায়ই মনে করে দিত। কাদম্বিনীর দুঃখ অনেককটা উপশমিত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে রাধার কাছে অত্যান্ত শক্তিহীন হইয়া পড়িল কেন? তেমনি করিয়া রাধার সহিত আর কথা বলতে আজকাল সে সাহস পায় না। কেন? স্বর তাহার শক্তিহীন ও স্ত্র।
রাধার সম্মুখে সে একেবারে দিনে দিনে ব্যক্তিত্বহীন হইয়া পড়িল। সে কি রাধার স্ত্রী? স্ত্রী কাহাকে বলে? স্বামীর সহিত স্ত্রীর সম্বন্ধ কি স্ত্রীলোকেরা সম্মান রক্ষা, তাদের সাংসারিক সুখ-দুঃখের উপশম করাই তো স্বামীর কাজ, তাই জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয়, কাদম্বিনী কি রাধার স্ত্রী?
মিথ্যা কথা! রাধা তাহাকে সমবেদনা জানায় মাত্র! সে আর কেউ নয়।
০ ০ ০ ০
কাদিম্বনী যখন ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন একদিন দারুণ উপদংশ রোগগ্রস্ত হয়ে লোহারাম খালি হাতে বাড়ি এসে উপস্থিত।
তার এই ভয়ানক অবস্থার সময় সে তার ব্যথিতা, বিস্মৃতা, অবহেলিতা স্ত্রী কাছে ফিরে এসেছে। সংসারে তো অনেক পথ ছিল। আর কোনো পথ তাহার আজ মনে পড়ে নাই কেন?
যেদিন কাদম্বিনী বুঝিল, সে অন্তঃসত্ত্বা সেদিন তার লজ্জা হইল না। স্বামীর উপর একটা ভয়ানক ক্রোধও ঘৃণার আগুন তাহার বুকের মধ্যে জ্বলিয়া উঠিল।
উপদংশ–রোগগ্রস্ত হয়ে নিজের পত্নীর কাছে লোহারামের ফিরিয়া আসিতে লজ্জা হয় নাই, আর কাদম্বিনীরই কী এত লজ্জা?
উপদংশ রোগের অর্থ কাদম্বিনী বেশ বুঝে। লোহারাম লক্ষ্য করিল। তাহার অতিনা, চরিত্রবতী স্ত্রীর অতীত সলজ্জা ভাব সেই কথা ও হাসির ভিতর দিয়া একটা অন্তনিহিত অনুরাগের ছায়া আর নাই।
উপদংশের কী ভীষণ জ্বালা তাহা যাহার হইয়াছে সেই বোধ হয় বেশি করিয়া জানে। দারুন যন্ত্রণায় লোহারাম আত্মহত্যা করিতে যাইত, কাদম্বিনী নানা প্রকারে সান্ত্বনা দিয়া তাহাকে নিরস্ত্র করিত।
অন্তরের ভিতর দারুণ ঘৃণা পোষণ করিয়া কাদম্বিনী লোহরামের সেবা করিত। লোহরামের শরীর কিছু ভালো হইলে সে দেখিল, তাহার স্ত্রী কাদম্বিনীর রোগ আরম্ভ হইয়াছে। পাপীর সংস্রবে আসিয়া কাদম্বিনীর মাথায় নূতন বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তাহাতে তাহার কিছুমাত্র সহানুভূতি হইল না।