হাছান চাহিয়া দেখিল, ধীরে ধীরে ললিতা তাহার দিকেই আসিতেছে। সেই ঘুড়ি ধরিয়া দেওয়া ব্যাপার আজ ছয় মাসের কথা। কোনো কথা কাহারো মধ্যে না হইলেও হাছানের প্রাণে যেন এত দিনে একটা স্নেহ ও বন্ধুত্বের ভাব জাগিয়া উঠিয়াছে। ললিতা যেন তাহার পরিচিত শত বন্ধুদের মধ্যে একজন।
সহসা হাছানের ইচ্ছা হইল সঙ্কোচ ফেলিয়া একবার সে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি। কেমন আছেন?”
ললিতা ধীরে ধীরে আসিয়া জানালার পার্শ্বে দাঁড়াইল।
হাছান কথা বলিতে পারিতেছিল না, তাই অতিকষ্টে অত্যন্ত বিনীতভাবে ভয়ে ভয়ে সে জিজ্ঞাসা করিল,–“আপনি কেমন আছেন?”
ললিতার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। সে কহিল, “ভগবান আপনার মঙ্গল করুন, আপনি তবু জিজ্ঞাসা করিলেন। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে না আমি কেমন থাকি।”
“প্রায়ই দেখি আপনার চোখে-মুখে একটা বিষাদের ছায়া। আপনার এ বালিকা বয়স!”“যাতনায় জীবন আমার ভরা। এ সংসারে এমন কেহ নাই, আমার দুঃখ বুঝেন!”
“কেন, কীসের আপনার দুঃখ? আপনি পিতার বাড়িতেই থাকেন ইহার কারণ কী? আপনার স্বামী কোথায় থাকেন?”
বালিকা কাঁদিয়া ফেলিল। কাঁদিয়া কাঁদিয়া সে কহিল–তাহার স্বামী নাই। বালিকা বয়সে সে বিধবা হইয়াছে। সারাজীবন তাহাকে দুঃখে ও বেদনায় কাটাইয়া দিতে হইবে। এ সংসারে এতটুকু তাহার জন্য স্নেহ নাই। এ সংসারে একটি মানুষ নাই, ডাকিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে–সে কেমন আছে।
হাছানের প্রাণ ব্যথায় ভরিয়া গেল; তাহার এই অপরিচিতা বন্ধুর এত দুঃখ! কথা না। বলিলেও আবু আজ বুঝিল অজানিত অবস্থায় কতখানি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি দিয়া সে এই সুবর্ণ প্রতিমাকে আত্মার অজ্ঞাতে পূজা করিয়া আসিয়াছে। আত্মার গভীর প্রদেশে আজ যেন কে কঠিন আঘাতে জিজ্ঞাসা করিতেছে “হাছান! তুমি একটা অসহায় আত্মাকে কি বাঁচাইতে পারো না?” কিন্তু কেমন করিয়া?
.
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
পরদিন সন্ধ্যাকালে হাছান ললিতার নিকট হইতে একখানি দীর্ঘ পত্র পাইল। পত্রের প্রতিছত্রে একটা অসহায় আত্মার করুণ আর্তনাদ গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিতেছিল। বিপুল আগ্রহে নির্জনে হাছান পড়িয়া দেখিল :
“কী বলিয়া সম্বোধন করিব বুঝিতেছি না। এই অবহেলা-ভরা সংসারে আমার প্রাণ বাঁচিতেছে না। বিমাতার দারুণ বাক্যবাণ, পিতার নির্মম অবহেলা, সংসারের দারুণ রুদ্রতা আমাকে বলিতেছে তুমি চলিয়া যাও-জানি না কি কারণে, আপনাকে এত নিভৃতে কথা বলিতে প্রলুব্ধ হইতেছি। আপনি আমার কি করিতে পারেন? তবুও ইচ্ছা এই নিদারুণ সংসারের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিবার পূর্বে আপনাকে আমার প্রাণের কথা বলিয়া যাই। এই জ্বালাময় সংসারের মাঝে একটা সহানুভূতিময় মানুষের কাছে যদি থাকিতে পারিতাম, তাহা হইলে আর এ কঠিন সংকল্প করিতাম না। কিন্তু কে আছে আমার এ। সংসারে?” তাহার পর সংসারের শত কথা। তাও এক এক করিয়া সব কথা পড়িল।
শেষে যাহা পড়িল তাহাতে তাহার আত্মা শিহরিয়া উঠিল। অবহেলা ও নির্মম আঘাতে ললিতা আত্মহত্যা করিবে?
কেন? এত বড় দীর্ঘ তাহার দেহ। এই বাইশ বৎসর ধরিয়া সে কত বড় মানুষের গ্রন্থ। পড়িয়াছে। সে কি একটা অসহায় আত্মার কিছুই করিতে পারে না। হাছান মনে মনে বলিয়া উঠিল–এই বালিকাকে রক্ষা করিতে হইবে। এই কার্যের জন্য তাহাকে যে ক্ষতি, যে বেদনা, যে কষ্ট সহ্য করিতে হয় সে করিবে। নচেৎ সে মিথ্যা, মিথ্যা তার শিক্ষা ও জীবন, মিথ্যা তার ধর্ম।
হাছান কাগজ লইয়া পত্র লিখিতে বসিল। সে লিখিল :
শ্রদ্ধেয়া ভগিনী, আপনার পত্র পড়িয়া গভীর বেদনা অনুভব করিলাম আমি আপনার কী উপকার করিতে পারি বুঝিতেছি না। তবুও ঈশ্বরের নামে আজ প্রতিজ্ঞা করিলাম, আপনার জন্য যাহা করিতে হয় করিব। আপনি বিশ্বাস করুন, আজি হইতে আমি আপনার ভাই হইলাম। অন্তরে যখন বেদনা অনুভব করিবেন তখন একটা নীরব হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহের চিন্তা করিবেন। আত্মহত্যা করিবার ঘৃণিত প্রবৃত্তি দূর হইবে। বাহিরের লজ্জা ও সঙ্কোচ আমাকে কর্তব্য-পথচ্যুত করিতে পারিবে না। এই প্রতিজ্ঞার জন্য হয়তো ভবিষ্যতে আমার বিপদ হইতে পারে। কিন্তু তজ্জন্য আপনি দুঃখিত হইবেন না। আপনার অকৃত্রিম সহৃদয়তায় আমি মনে মনে বিপুল গৌরব অনুভব করিতেছি।
হাছানের মনে যে পাপটুকু ছিল তাহা সেই দিনই বেশ করিয়া ধুইয়া গেল।
.
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
”আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে কি তুমি ঘৃণা কর? আমি কুৎসিত হইতে পারি কিন্তু আমার অর্থ আছে। অনেক লোক আমাকে খুব ভয় করে। বল, তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর!”
হুগলীর পাড়া-বিশেষের এক প্রকোষ্ঠে এক যুবতী এক বাবুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া, যুবতীর নিখুঁত সৌন্দর্য সমস্ত ঘরখানি আলোকময় করিয়া তুলিয়াছিল।
বাবু যুবতীর করুণা ভিক্ষা করিতেছিলেন। তাঁহার চোখে সোনার চশমা, পরনে। মূল্যবান পোশাক।
তখন রাত্রি দশটা। রাস্তায় জন-কোলাহল ছিল না। শান্তস্বরে যুবতী কহিল–“বাবু, আপনার ন্যায় ভদ্রলোকের কি আমাদের ন্যায় ইতর লোকের করুণা ভিক্ষা ভালো? ঘরে আপনার সতী স্ত্রী আছেন। আমাদের এই পাপ স্থানের স্পর্শে আপনার দেহ অপবিত্র করিবেন না। আপনার দেবী প্রতিমা সত্য স্ত্রীর অভিশাপে আমাদের নরকেও স্থান হইবে না। দয়া করে ক্ষমা করুন। আমি আপনার পায়ে ধরি।”