নইম আরও একটু এগিয়ে এসে বললে–“কী কথা বোন। কেউ শুনবে না, তুমি আস্তে আস্তে বল। আমাকে তোরা আপন ঠাকুর দাদা মনে করবি। তোদের দুঃখে; তোদের ব্যথার কথা মনে হলে সেদিন আমার খাওয়া হয় না। রাত্রে ঘুম আসে না। মুখে কি বলবো ভাই? খোদা জানে। আহা! তোরা যদি হিন্দুর ঘরে ন. জন্মিতিস তাহলে তোদের জীবন এমন শ্মশান হতো না। কী করতে পারি; কী ক্ষমতা আছে আমার? খোদার কাছে মোনাজাত করি–এদৃশ্য যেন আর আমার দেখতে না হয়।”
নিহার বলিল–“সত্যিই বলবো, কিছু মনে করবে না তো? তুমি আমাদের দাদা হও বলেই বলতে সাহস পাচ্ছি, নইলে বলতে পাত্তেম না।”
“বলো কোনো ভয় নেই। তোমাদের প্রত্যেক কথা আগ্রহের সাথে শুনবো।”
“দাদা, তুমি আমাদেরকে অত্যন্ত ভালবাস তাই বলতে সাহস পাচ্ছি। যদি অন্যায় হয় তবে প্রতিজ্ঞা করো কারো কাছে এ কথা প্রকাশ করবে না।”
মহিউদ্দিন রংপুরের এক পল্লীগ্রামে একটা মাদ্রাসা খুলেছেন। সেখানকার বড় মৌলবী তিনি। নিকটস্থ আট-দশ গ্রামের লোক তাহাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। …
গ্রামে কোনো মারামারি হয়েছে, মহিউদ্দিন তাহা মিটমাট করিয়া দেন। কাহারো বিবাহ তিনি যাইয়া সমস্ত বন্দোবস্ত করেন। কেহ, পীড়িত হইয়াছে, তিনি যাইয়া চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন, কাহারো আত্মীয়ের মৃত্যু হইয়াছে, মহিউদ্দিন যাইয়া তাহার অন্ত্যেষ্ট্রিক্রিয়া সমাধা। করেন। মাদ্রাসা ছাড়া বাহিরের লোক এইসব কাজে তাঁহাকে বহু অর্থ দিয়া শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।
প্রাতকালে তিনি তাঁহার ছাত্র কছিমুদ্দিনকে পড়াইতেছিলেন। কছিমুদ্দিনও নদিয়ার মানুষ। অর্থ ব্যয় করিয়া পড়িবার সাধ্য নাই বলিয়া সে তার দেশী মৌলবী মহিউদ্দিনের কাছে আজ তিন বৎসর যাবত পড়ে। শুধু কাজ করিয়া আহার করিয়াই তার দিন যায় না।
মহিউদ্দিন জ্ঞানলাভেচ্ছু কছিমকে প্রত্যহ নূতন নূতন জ্ঞান দান করেন। একই পড়া এক মাস পড়াইয়া মহিউদ্দিন নিজের কাজ-কর্মের সুবিধা করিয়া লন না এবং তিন বৎসর কছিম ইংরেজি, বাংলা, আরবি ও উর্দু ভাষায় বিশেষ জ্ঞান লাভ করিয়াছে। ইংরেজি বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছেলেদের সহিত ইংরেজিতে সে কথা বলিতে পারে। খবরের কাগজও সে বেশ পড়িতে পারে এবং মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখিবার ইচ্ছা পোষণ করে। কোরানের পঠিত অংশের অর্থ বেশি বলিতে পারে। প্রতিবেশী দিল্লী পাঞ্চাবের মুসলমানের ঘরের খবর লাভের জন্য সে উর্দু পড়ে। অন্য কোনো উদ্দেশ্যের জন্য নয়। উর্দু ভাষায় কথা বলিয়া সে ভদ্রলোক হইবার কল্পনা পোষণ করে না। সে চাকরি করিবার উদ্দেশ্যে লেখাপড়া শিখিতেছে না। বাড়িতে তার অনেক জমি আছে তাতে ধান, গোল আলু ও আখ যথেষ্ট পরিমাণে হয়। সমাজে যাহাতে নিতান্ত অশিক্ষিত লোকের মতো কাল না কাটাইতে হয় এইজন্য সে অধ্যায়ন করিতেছে। দুনিয়ায় মূর্খের মতো বাচিয়া থাকাই বিপজ্জনক। লেখাপড়া শিখিয়া সে কৃষকের কাজ করিয়া খাইবে, সংসারে। কাজ করিয়া অর্থ উপায়ে। করিবে তত্ৰাচ সে একটা অপদার্থ মুখ হইয়া থাকিবে না। ইহাই তাহার ইচ্ছা। শিক্ষিত মানুষ যে কাজই করুক তাহাতে তার গৌরব। তাতেই তার মান ও প্রসার হয়। ধীরে ধীরে তার অহঙ্কারহীন আত্মশক্তি জাগিয়া উঠিতেছে।
পিয়ন আসিয়া মৌলবী সাহেবকে একখানা পত্র দিয়া গেল। পত্রখানি মৌলবী সাহেবের ভগ্নিপতি নইমুদ্দীন লিখিয়াছে অনেকদিন তিনি তাহার দরিদ্র ভগ্নি ও ভগ্নিপতির সংবাদ পান না, তজ্জন্য তিনি দুঃখিত ছিলেন। আগ্রহের সহিত চিঠি খুলিয়া দেখিলেন তাতে লেখা আছে :
দোয়াবরেষু–অনেকদিন হইল তোমার সংবাদ না পাইয়া যার পরনাই দুঃখিত আছি। একটি কথা বলিতেছি, খুব চিন্তা করিয়া যাহা ভালো বিবেচনা কর ফেরত ডাকে লিখিবে। আমি অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত, আছি। কী করিব কিছুই বুঝিতেছে না। তুমি জ্ঞানী সুতরাং তোমার কাছে বিহিত মীমংসা হইবে, সন্দেহ নাই।
চক্রবর্তী কন্যা নিহার দীনবন্ধু দাসের কন্য রমাকে তুমি চিনতে পার। বিধর্মী হইলেও বাল্যকাল হইতেই এই দুইটি বালিকার উপর আমার প্রগাঢ় স্নেহ।
আমি মুখ মানুষ হইলেও ইহাদের জন্য আমি অত্যন্ত বেদনা, অনুভব করি। তুমি জান। না বোধ হয়, ইহারা খুব বাল্যকালে স্বামীহারা হইয়াছে।
পরকথা, সেদিন সন্ধ্যাবেলা, নিহার ও রমা আমার কাছে এক অতি গোপন কথা বলিয়া গিয়াছে। সংসারের সাধারণ মানুষ তাহাদের দুঃখ ও কথার গুরুত্ব অনুভব না করিলেও প্রত্যেক হৃদয়বান তাহাদের জন্য প্রভূত বেদনা অনুভব করিবে। অত্যন্ত ও ভয় ও সঙ্কোচের সহিত তাহারা একথা বলিয়াছে, আমার সাহায্যে তাহারা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ।
করিয়া দুইজন চরিত্রবান মুসলমান যুবকের সহিত বিবাহিতা হইতে চায়। বলিতে কী, তাহাদের এই সৎসাহসে হৃদয়ে আনন্দ অনুভব করিয়াছিলাম ও করিতেছি। ইসলাম যদি এই দুইটি আত্মাকে শান্তি ও মুক্তি দিতে পারে তবে অত্যন্ত ভালো কথা। কিন্তু আমরা দ্বারা এই গুরুতর কার্য কি করে সম্ভব? একে হিন্দুদের শক্তি বেশি, তা ছাড়া দুইজন যুবতী স্ত্রীলোক লইয়া কথা, তুমি কী যুক্তি দিতে চাও, সত্ত্বর লিখিবা!
মহিউদ্দিন পত্র পড়িয়া একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিলেন। চিঠিখানি আমরা আমাদের ভাষায় লিখিলাম। বস্তুত ঠিক এরূপ ভাষায় পত্র লেখা হইয়াছিল না।