প্রখর রৌদ্রে ঢাকা শহর মরুভূমির মতো ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কুলসুম–তার নিজের কামরায় বসে সীমাহীন আকাশের পানে তাকিয়েছিল। বাহিরের উষ্ণ বাতাস তাহার শরীরে উষ্ণ দীর্ঘ নিশ্বাসের মতো আগুনের হাল্কা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো।
কি দারুণ বেদনা তাহার কোমল বুকখানিকে পিষ্ট করে দিতেছিলো। সে আজ দশ বৎসরের কথা, কত আঁখি জলে সে স্বামীকে বিদান দিয়েছিলো। আর কতকাল সে এমনি করে দারুণ বেদনা নিয়ে কাল কাটাবে। কুলসুম ভাবিতেছিল–“এত বছর কি পড়িতে লাগে? একখানা চিঠি কি লিখিতে নিয়ে কাল কাটাবে। কুলসুম ভাবিতেছিল–“এত বছর কি পড়িতে লাগে? একখানা চিঠিও কী লিখতে নাই? একটা প্রাণীকে এমনি করে হত্যা করে বিদেশে পড়ে থাকা কি ধর্ম? এমন শিল্প-শিক্ষার কী ফল? অর্থ যদি এর উদ্দেশ্যে হয় তবে সে অর্থ আমি চাই না। ভিখারিণী হয়ে স্বামীকে নিয়ে ভিক্ষা করে খাবো। এত অর্থ, এত গহনা, এত রূপ দিয়ে আমার কি লাভ? সামান্য দরিদ্র কৃষক রমণীও ভাগ্য যে আমার চেয়ে অনেক ভালো। কেন এখানে আব্বা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন? একটা নির্মম হৃদয়হীন মানুষের অত্যচার সইতে?” বাহিরে পৃথিবী লতা, পাতা ও আলো-বাতাস পুড়িয়া ছাই হইতেছিল। কুলসুমের মুখোনিতেও তেমনি আগুন ধরে উঠলো।
দারুণ বেদনায় বালিশটাকে বুকে লইয়া সে বিছানার উপর শুইয়া পড়িল। চোখ দিয়া অজস্রধারে জল পড়িতে লাগিল।
সেদিন তার শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন না। তার শ্বাশুড়ী দুপুর বেলায় আপন কামরায় ঘুমিয়েছিলেন। একে বৃদ্ধাবস্থা, তাহার উপর প্রায় এক বৎসর বড় ছেলের কোনো চিঠি না পাইয়া তাহার শরীর ক্রমশ শোচনীয় হইতেছিল। দিনের বেলা দুপুরে একটু ন্দ্রিা ছাড়া আর কোনো সময়ে তার দ্ৰিা হয় না। সারা রাত্রি বসিয়া কাটাইয়া দেন।
পেছন হইতে এবাদ তার ভাবিকে ডাকিল–“ভাবি!”
এত দুঃখ ও বেদনার ভিতর কুলসুম তাহার ছোট দেবরের নানা রহস্য কথা বলিয়া অনেকটা শান্তি পাইত। দেবর এবাদ তাহার সহিত রহস্য করিলেও সে তাহাকে খুব শ্রদ্ধা করিত।
মানুষ যখন আপনাকে অত্যন্ত অসহায় মনে করে তখন সে সামান্য শত্রুতা মার্জার শিশুকে ভালবাসিয়া ও সান্ত্বনা পাইতে চায়। আপন ভাইয়ের সহিত যাহার অত্যান্ত শত্রুতা হয়, সে পথের অপরিচিত লোককে ভালবাসিয়া সুখ পাইতে চায়। যে মাতাল সন্তান মরিয়া গিয়াছে সে পরের ছেলেকে আগ্রহে বুকের সহিত জড়াইয়া ধরে। মানুষ একটা আকর্ষণ ব্যতীত বাচিতে পারে না। সে আকর্ষণ আপনার জন্যই হউক বা পর হউক, মানুষ হোক বা কর্ম হোক, একটা কিছু হইবেই। আত্মার এই অংশ কখনও শূন্য থাকে না।
অত্যন্ত বেদনায়, জীবনের এই কঠিন শূন্যতায় কুলসুম, তাহার দেবর এবাদকে অত্যন্ত ভালবাসে। এবাদের আহারের বন্দোবস্ত কুলসুম নিজেই করে, নিজ হাতে সে তাহাকে খাওয়ায়, নিজেই পার্শ্বের কামরায় তার শয্যা রচনা করিয়া চুপেচুপে শ্বশুরের অগোচরে ভীত এবাদকে তামাক সাজিয়া দেয়।
এবাদকে দেখিয়া কুলসুম অনেকটা সোয়ান্তি অনুভব করিল। কুলসুম অত্যন্ত স্নেহের স্বরে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া কহিল–“এবাদ! ভাই আমার, আয়!”
এবাদ তাহার ভাবির পায়ের কাছে আসিয়া শুইয়া পড়িল। এবাদের মুখ স্বেদসিক্ত। কুলসুম অত্যন্ত স্নেহে এবাদের মুখোনি আঁচল দিয়া মুছাইয়া দিলেন।
ভাবি আর দেবরে অনেক কথা হইল। কেবল স্নেহ আর শ্রদ্ধাতে।
এবাদের মুখে একটা ফোট হইয়াছিল। কুলসুম হাত দিয়া সেটা টিপিয়া দিলেন, হাতের চাপে এবাদের উজ্জ্বল রক্তময় মুখোনি আরও রক্তময় হইয়া উঠিল।
.
উনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ
তখন সন্ধ্যা। দিবালোক ধীরে ধীরে সরিষা যাইতেছিল। পল্লীপথের নির্জনতা মশার গুঞ্জনধ্বনিতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছিল। সেই নির্জন পথের নির্জন কালিমার ভিতর দিয়া রমা ও নিহার নইমুদ্দিন শেখের বাড়িতে যাইতেছে।
গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ভালবাসার পাত্র-চির পরিচিত সরল ধর্মভীরু নইমুদ্দিন শেখ তখন উপসনা শেষ করিয়া তামাক খাইতেছিল।
বেশি দূরে তার বাড়ি নয়। মাঝে একখানা পতিত জমি, তার পর কয়েকখানা বাড়ি, তার পর একটা গ্রাম্য ছোট রাস্তা, দু’পাশে তার সুপারী গাছ, তারপর ঘোষদের বাড়ি। দুঃখিনী বিধবার ভাঙ্গা একখানা ঘর, আর বেদনা-ভরা একখানা উঠান পার হয়ে রমা আর তার বন্ধু নিহার নইম শেখের বাড়ির উপস্থিত হলো।
বৈকাল বেলা রমা আর নিহার তাদের মায়ের কাছে তাদের পুরানো আত্মীয় না হলেও আত্মীয় ঠাকুরদার নইমুদ্দীন শেখের বাড়িতে যাবে বলে প্রস্তাব করেছিল। কোনো মা তাতে আপত্তি তুলেন নাই।
নইম আর নাতনী রমা আর নিহারকে দেখে হুঁকো ধুয়ে চীৎকার করে বললে, “ওগো, নাতনীরা এসেছেন। কই, এদিকে এসে বসতে দাও”–বলিয়া গৃহিণীর জন্য অপেক্ষা করিবার সময় তার সহিল না। নিজেই সে একখানা ছালা এনে নিহারকে বসতে দিলো।
তার পর কতো স্নেহের কথা এই সেদিন রমা-নিহার নইমের চোখের সামনে ছোট কচি খুকী ছিল। আজ তারা সেয়ানা, তারই সামনে তাদের বিয়ে হয়েছিল, তারই সামনে…। নইম কহিতে পারিল না। গলার স্বর তাহার আর্দ্র হইয়া উঠিল।
তারপর আরও কত কথা হইল। অনেক কথার পর নিহার বলিল,–“একটা কথা।”
নইম কহিল–“দিদি?”
“খুব গোপন কথা।”
“যদি ঘৃণাক্ষরে কেউ জানতে পারে তা হলে সর্বনাশ হবে।”