অন্নদা শৈলকে আরও দুই গ্লাস জিঞ্জার লাল আনিতে বলিল। পিপাসিতা সৌদামিনী পর পর চারি গ্লাস জিঞ্জার পান করিল। তারপর দেহ যেন অবশ হয়ে এলো। চোখ অজ্ঞাতসারে মুদিত হয়ে গেল। সৌদামিনী ধীরে ধীরে বিছানার উপর ঘুমাইয়া পড়িল।
অতি উৎকৃষ্ট বিলাতি সুরা সৌদামিনীর সারা শরীরে অতি সুখের চৈতন্য-অপহারক শক্তি ছড়াইয়া দিয়াছিল।
প্রভাতের অরুণ কিরণ খোলা জানালা দিয়ে সৌদামিনীর গায়ের উপর যেয়ে পড়ছিল। চোখ খুলতেই তার সর্বনাশের দৃশ্য সে দেখতে পেল।
নিমেষের মধ্যে তার মাথায় প্রলয়ের আগুন জ্বলে উঠল। লাফ দিয়ে মেজে পড়ে সে এক পদাঘাতে দরজা ভেঙ্গে ফেলে। যখন সে মনের ভিতর একটা অতি প্রচণ্ড প্রলয় নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো, তখন তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সে তখন একেবারে পাগল।
.
অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
মাসের পর মা আনন্দে মধুর স্বপ্নে কেটে যাচ্ছিল।
ঘরের মধ্যে মিটি মিটি আলো জ্বলছিল। ফিনি মিস্টার এবাদকে গভীর প্রণয়ের আবেগে কত ভালবাসা জানাইতে ছিল। জীবনের চরম সুখে-বিশ্ব-সংসার ভুত-ভবিষ্যৎ ভুলে এবাদ ফিনির প্রেমে আপনারা সীমাহীন বাসনা ও মাদকতার আগুন নিয়ে এবাদ ফিনির জন্য একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছেন।
আজ কত বছর বাড়ি ছাড়া, তার যে, বাড়িতে এক স্ত্রী ছিল তা কি তার মনে আছে? স্বপ্নের মতোও সে কথা এবাদের মনে হয় না। এক বছর হলো বাড়িতে সে মোটেই পত্র লেখে না।
তখন রাত্রি তিনটা। আগের দিন বৈকাল বেলা ফিনি এবাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ইচ্ছা থাকলেও সে যেতে পারে নাই।
ফিনি এবাদের মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিল, “আমার প্রিয় ভারতবর্ষের বন্ধু! তোমাকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তে থাকতে পারি না। কিন্তু দিবারাত্র এখানে থাকলেও পিতা সন্দেহ করতে পারেন।”
এবাদ গম্ভীর আবেগে বলিল–“প্রিয়ে, আমারও তোমারি মতো অবস্থা। যতক্ষণ তুমি এখানে থাক না ততক্ষণ আমি পাগলের মতো পথের পানে চেয়ে থাকি।”
“আমি এক যুক্তি ঠিক করেছি।”
“কী যুক্তি?”
“তুমি একেবারে আমাদের বাড়িতে চলো।”
“যদি তোমার পিতা জানতে পারেন?”
“আমি তোমাকে আমাদের আঁধার ঘরে রেখে দেবো। আঁধার ঘর প্রত্যেক বাড়িতে থাকে। সেখানে কেউ থাকে না, না কেউ যায় না। নীরব আঁধার নিয়ে সেই কামরাটির মধ্যে মাটির নীচে আমরা থাকব। চাবী আমার কাছেই থাকে।”
“সেখানে আমরা আহার, জল কে দেবে?”
“আমার প্রিয় বিশ্বসী ভৃত্য বেলা।”
“ওকে কি বিশ্বাস করতে পারা যায়?”
“বেলা অত্যন্ত বিশ্বাসী ভৃত্য। তাকে প্রাণ দিতে বললে সে প্রাণ দেবে।”
“বেশ যুক্তি রাতদিন তখন তোমার সঙ্গসুখ উপভোগ করতে পারবো কিন্তু কেন যে আমার একটু ভয় হচ্ছে।”
“সেটা তোমার মনের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের সেই নিষ্কলঙ্ক নির্বাত সুখ-সমুদ্রে কোনোও প্রকার দুশ্চিন্তার স্থান হওয়া উচিত নহে।”
“কেমন করে সেখানে যাবো?” বাহিরের দিকে এক গুপ্তদ্বার আছে। সেই পথ দিয়ে গভীর রাতে তোমাকে নিয়ে যাবো।”
এমন সময় বাহির হইতে দরজায় যা পড়লো। ফিনি বিছানা হইতে উঠিয়া কাপড় পড়িয়া কহিল–“ওহে প্রিয়! বেলা এসেছে!”
কয়েক মিনিট বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকিয়া বেলা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মিস্টার এবাদ ও ফিনিকে নমস্কার করিল।
ফিনি বেলাকে জিজ্ঞাসা করিল–“পিনাস ঠিক হয়েছে?”
বেলা আর একটা নমস্কার করিয়া কহিল, “হয়েছে।”
সেদিন ফিনি এবাদকে লইয়া সাগর-ভ্রমণে বাহির হইবে। পূর্বদিনেই একখানা পিনাস ঠিক করিতে বেলাকে সে বলিয়া দিয়াছিল। বেলা তাহার কত্রীর আজ্ঞা পালন করিয়া অতি প্রত্যুষেই সংবাদ দিতে আসিয়াছে।
বেলা অত্যান্ত বিশ্বাসী তাহা আগেই বলা হয়েছে। তার কত্রী–ফিনির কাছে সে অত্যান্ত ঋণী। শোকে-দুঃখে সে সর্বদা ফিনির সাহায্য পায়। ফিনির যতই দোষ থাকুক না কেন, সে সর্বদা তার কত্রীর দোষ সকলের নিকট হইতে গোপন করিয়া রাখিত এবং শহরময় সে প্রচার করিয়া বেড়াইত যে, তাহার কত্রী মিস ফিনির মতো মেয়ে সারা শহরে নাই।
বেলা তার কত্রী ও মিস্টার এবাদকে স্নান করাইয়া দিয়া প্রাতঃভোজনের বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।
|||||||||| অতঃপর আহারাদি করিয়া অতি প্রত্যষেই মিস ফিনি, তাহার বিশ্বাসী ভৃত্য বেলা এবং এবাদকে লইয়া সাগরাভিমুখে যাত্রা করিল।
প্রায় আধ ঘণ্টার ভিতর গাড়ি সাগর উপকূলে উপস্থিত হইল।
প্রকাণ্ড পিনাসে চড়িয়া এবাদ মিস ফিনির সহিত সমুদ্রবিহারে বাহির হইলেন। পিনাসে তিনটা কামরা। বেলা পিছন দিককার কামায় যাইয়া দরজা বন্ধ করিল। এবাদ তার প্রিয় ফিনিকে লইয়া সম্মুখের প্রকোষ্ঠে উপবেশন করিলেন।
সমুদ্রের ঢেউগুলি পিনাসে আছাড় খাইয়া পড়িতেছিল ফিনি এবাদের বাহু ধরিয়া তাহার কোমল পেলব দেহ এবাদের গায়ের উপর এলাইয়া দিল। এবাদ ফিনির লাল কুসুম কোমল গণ্ডে চুম্বন করিতে লাগিল।
ফিনি কহিল–“প্রিয় বন্ধু আমরা কত সুখি। দেবতা প্রসন্ন ছিলেন তাই তোমাকে পাইয়াছি। সেবারে যখন তোমারে সহিত সমুদ্রে-বিহারে হইয়াছিলাম তখন একটুও ভারি নাই যে, আমাদের এত সুখের দিন আসিবে। তোমার দিকে চাহিয়া চাহিয়া আমি প্রেমের আগুনে মরিয়া যাইতাম, কিন্তু, তুমি কিছুই বুঝিতে পারিতে না।”
এবাদ কহিল–“প্রিয় ফিনি, তোমার ভিতর যে এত প্রেম ছিল তাহা আমি ভাবিতে পারি নাই। তখন ভাবতাম; তুমি আমার সাধারণ শ্রেণীর একজন বন্ধু! কে জানিত, তুমি আমাকে এত ভালবাস।”