“পঞ্চাশ টাকায় আমি পারবো না।”
“কেন?”
“সাজো বছরে তোমার বাড়িতে সে দালান তুলে দেবে। শহরের সব বাবু তোমার গোলাম হয়ে যাবে।”
উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিয়া অন্নদা উৎসাহে আবার প্রস্তাব করিল ”আচ্ছা তাহলে মোট একশত টাকা নিবি?”
বিহারী কোনো কালে একশত টাকার মুখ দেখে নাই। একেবারে হাতের উপর সে এতগুলি টাকা দেখতে পাবে। সুতরাং সে আর বেশি আপত্তি করতে সাহস করিল না!
বিহারী বলিল, “রাজি হতে পারি, কিন্তু সে যে পোষ মানবে, তা তো মনে হয় না। শেষকালে তুমি আমার কাছে টাকা ফেরত চাবে তা কিন্তু হবে না।”
অন্নদা বলিল, “সে যা করতে হয় আমি করবো টাকা একবার দিয়ে আবার ফিরে চাবো? তেমন অধার্মিক আমি নই। কত সাবিত্রী দেখেছি? অন্নদার জঁকো হাতে পড়ে সব পাখির মতো পোষ মেনেছে!”
বিহারী বলিল–“তাতো ঠিক তোমাকে কি আমি জানি না। কিন্তু দেখো ধর্ম খেয়ো না!”
“সে সন্দেহ করো না।”
“কেমন করে কি করবো?”
বাড়িতে যেয়ে বলল–“আমরা গরীব মানুষ, এখানে থেকে আপনার কষ্ট হচ্ছে। এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আপনার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। বাবুর স্ত্রী খুব ভালো লোক। আপনার কথা শুনে কত কাঁদলেন। বাবুর স্ত্রী আপনার সকল সুবিধা করে দেবেন। তাঁর অনেক মেয়ে আছে। অনেক ঘর আছে। আপনাকে এত ঘর ছেড়ে দেবেন।”
“কবে আনতে লোক পাঠাবেন?”“কাল দুপুর রাত্রে। তুই সব ঠিক করে রাখবি।”
অন্নদা পঞ্চাশ টাকা গনিয়া বিহারীর হাতের উপর দিল। সঙ্গে আর এক জোড়া ধোয়া কাপড় দিয়ে বললে–“এখন পঞ্চাশ টাকা দিলাম। বাকি টাকা কাল রাত্রে দেবো।”
আনন্দে বিহারী উদ্বেল হইয়া গেল। জীবনে তার এমন সৌভাগ্য ঘটে নাই। অন্নদাকে নমস্কার করিয়া বিহারী বিদায় হইল।
সে মাসে মোটেই টাকা আসে নি। জেলেদের ভাঙ্গা ঘরের মধ্যে বসে সৌদামিনী ভাবছিল ভগবান এমনি করে জীবনকে শ্মশানে পরিণত করলো!
কাপড় একেবারে ফেটে গিয়েছে। ঘরে মাত্র সকাল বেলার জন্য দুমুঠো চাল আছে।
আর এক নূতন কথা। কোনো কোনো ইতর রমণী হেসে হেসে কানাকানি করে বলছিল–বিহারী এই মাগীরে নিয়ে……
সৌদামিনীর লজ্জায় ঘৃণায় ইচ্ছা করিতেছিল–প্রাণ তার বেড়িয়ে যাক। সে তার নিজের শরীর নিজে ছিঁড়ে ফেলে। হায়! ধর্মে কেন বলে আত্মহত্যা কর মহাপাপ? তাতে
অনন্তকাল নাকি নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে?
অতিদুঃখে সে অভিশাপ দিয়ে শ্যামাচরণ লক্ষ্য করে বললে–“এই তোমার প্রেম? এই তোমার হিন্দু ধর্ম? এই ধর্মের তোমরা বড়াই করো? জীবনের অতি আপনার সতী অর্ধাঙ্গিনীক ফেলে দিয়ে ধর্ম রক্ষা করো।”
এমন সময় বিহারী পিছন হইতে ডাকিয়া কহিল–“কি কথা একটা?”
সৌদামিনী কহিলেন–“কি কথা বিহারী?”
“আপনার বড় কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারি। বিশেষ করে আমাদের মতো। ছোটলোকের বাড়িতে ভদ্রলোকের পক্ষে থাকা অসম্ভব।”
“আমি আর এখন ভদ্রলোক নহি বিহারী! এখন আমি অত্যন্ত ছোট। তোমরা যে আমাকে একটু জায়গা দিয়েছ এতেই আমি কৃতজ্ঞ ইচ্ছা করেছিলাম তোমাদিগকে ভালো করে পুরস্কার দেবো, কিন্তু তাহলো না। বিহারী এর পরে আমার কি হবে তা বুঝতে পারি না। কাল আমি রানী ছিলাম, আজ পথের ভিখারিণীর চেয়ে নিকৃষ্ট!”
“আপনি অত বিচলিত হবেন না। আপনার একটা কূল করেছি।”
“সৌদামিনী আগ্রহের সহিত বলিল, “কি কূল করছো বিহারী?”
“এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আপনার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। বাবুর স্ত্রী খুব ভদ্রলোক। আপনার কথা শুনে কতো কাদলেন। বাবুর স্ত্রী আপনার সকল সুবিধা করে দেবেন। তার অনেক মেয়ে আছে অনেক ঘর আছে। আপনাকে এক ঘর ছেড়ে দিবেন।”
সৌদামিনী কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল–“বিহারী তুমি কি স্বপ্নে দেখছো, ভালো করে বলো। কে এমন দেবী আছেন। তুমি কি সত্য কথা বলছো?”
“আমি খুব সত্য বলছি। এরপরে আর আপনার কষ্ট হবে না। ভগবান আপনার দুঃখ, মোচন করেছেন।”
“করে যাবো সেখানে?”
“আজই!”
সৌদামিনী অত্যন্ত বিস্ময়ে বলিয়া উঠিল–“আজই!”
“হ্যাঁ আজই!”
সৌদামিনী পাল্কি হইতে যখন অনুদার বাড়ির উঠানে নামিল তখন পাল্কির দুই পাশে সাতটি যুবতী মেয়ে। সকলেরই সাজ-সজ্জা খুব চমৎকার।
সৌদামিনী অত্যন্ত সঙ্কোচের সহিত জিজ্ঞাসা করিল–“তিনি কই?”
একজন প্রৌঢ়া অত্যান্ত আগ্রহের সহিত মেয়েগুলিকে ঠেলিয়া সৌদামিনীর হাত জড়াইয়া ধরিল। সৌদামিনী রমণীর পদধূলি গ্রহণ করিল।
অত্যন্ত স্নেহ ও ভালবাসা দেখাইয়া অন্নদা সৌদামিনীকে এক সজ্জিত ঘরে লইয়া বসাইল। যুবতীদের মধ্যে কেহ তাহাকে বাতাস করিতে লাগিল, কেহ বসিবার আসন ঠিক করে দিল, কেহ জলখাবারের বন্দোবস্ত করিল।
ঘরের ভিতর একখানা মুল্যবান কৌচ, দুইখানা চেয়ার, একখানা ইজিচেয়ার; একটা বড় আয়না, আর অনেক কুৎসিত ছবি!
অন্নদা কৌচের উপর সৌদামিনীকে বসাইয়া নিজে তাহার পার্শ্বে বসিয়া হাজার মমতা
ও ভালবাসার পরিচয় দিতে লাগিল।
অন্নদা কহিল–“আপনাকে এই ঘর একেবারে দিলাম। এখানে উঠবেন বসবেন, মোট কথা, এ ঘর আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হল।”
অন্নদা এই সময় শৈল বলিয়া কাহাকে যেন ডাকিল। শৈল অনতিবিলম্বে এক থালা, খাবার আর গ্লাসে করিয়া লইয়া আসিল।
সৌদামিনীর খাবার ইচ্ছা না থাকিলেও অন্নদার অনুরোধে সে খাইতে বসিল। তার পর গ্লাসটা হাতে নিয়ে সৌদামিনী বললে–“এটা কী জিঞ্জার? এত বন্দোবস্ত কেন? সাদা জলেই আমার তৃপ্তি হয়!”