আবদার রহমান হাছানের কানের কাছে মুখ লইয়া বলিল, “বেশ মেয়ে! পল্লীগ্রামের হাবা মেয়ে বিবাহ করা অপেক্ষা এইরূপ মেয়ে বিবাহ করাই ভালো। তার ভিতরে সে একটা মানসিক বল আছে তা বুঝতে পাচ্ছ বোধ হয়। পরের কথায় সহজে দমিতা হবার পাত্রী সে নয়। তার নিজের বিশ্বাস ও চিন্তার উপর একটা ভয়ানক শ্রদ্ধা আছে। এরূপ মেয়ে বিবাহ করেই সুখ।”
হাছান মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “অপমানের কোনো কারণ আছে কি?”
“কিছু না! চুপ করে বসে থাক আর খাও। আমার প্রাণ থাকতে তোমার অপমান হবে, এ বিশ্বাস তুমি কর?”
আবু যাহাই বলুন ব্যাপার অত্যান্ত শোচনীয় হইয়া পড়িল। দুপুরবেলা তারা মসজিদে এসেছেন। মৌলভী পবিত্র হইয়া হাছানের পার্শ্বে কোরআন
শরীফ হাতে লইয়া বসিয়াছিলেন। গহনা-পত্র আগেই দেওয়া হইয়াছে। শুধু আমেনার সম্মতির জন্য সকলে বসিয়া আছেন। এক ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ হইবার কথা।
প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমেনা কঠিনভাবে বলিতেছে, মিস্টার হাছানকে সে বিবাহ করিবে না।
আমেনা মলিন বসনে নিজের ঘরে মাটির উপর বসিয়াছিল। চুলে তার তেল নাই। একখানা গহনা সে পরে নাই।
পিতা কাঁদিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “মা, আমার জাতি যে যাবে। তোমার যে এত অমত আছে একথা তোমার মাও তা কোনোদিন বলেন নাই।”
আমেনা রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “আব্বা! অনেক আগেই আমি মাকে বলেছিলাম, এই, বিবাহে আমার বিপদ হবে।”
পিতা বলিলেন, “তোর কী বিপদ হবে? আমার যা সামান্য সম্পত্তি আছে। তাতে তোর সারাজীবন বসে খেলেও ফুরাবে না। তুই কার কি ধার ধারিস?”
আমেনা বলিল, “আব্বা, ভাতের জন্যই কি লোকে কন্যার বিবাহ দেয়? বাপের কি কন্যার জন্য ভাত-কাপড়ের অনটন হয়? আপনি কি আমার মঙ্গল চান না।”
আমেনার পিতা আমেনাকে অত্যান্ত ভালবাসিতেন। কিন্তু সে ভালবাসার অর্থ কি কন্যার মঙ্গল চিন্তা নহে?
মৌলবী এমদাদ আলী সাহেব তার কথা কহিতে পারিলেন না। মুখ ঢাকিয়া দারুণ। মানসিক যন্ত্রণায় ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
অনেক রাত্রি হয়ে গেল। আমেনা তেমনি কঠিন হয়ে বসে রইল।
সকাল বেলা উপাসনা করা শেষ করিয়া সকলে আবার মসজিদে আসিয়া বসিলেন। আর দূরে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয় ভাবিয়া আবদুর রহমান একবার আমেনার সহিত দেখা করিতে গেলেন।
পূর্বেই বলা হইয়াছে; সম্পর্কে আমেনা আবদুর রহমানের চাচাত বোন।
আমেনা একা একা বসে পড়ছিলো। আবুকে দেখে সে চোখের জল মুছিয়া বলিল, “ছোট ভাই আপনি ও আমার বিরুদ্ধে?”
আবু অত্যন্ত বিস্মৃত হইয়া বলিল, “কেন হয়েছে কি?”
“আপনি জানেন না?”
“জানি বই কি। দু’নি থেকে তুমি এতগুলি লোককে কষ্ট দিচ্ছে।”
“সে দোষ কি আমার?”
“তোমার নয় তো কার?”
“আপনার, আমার পিতারও আমার মায়ের।”
“কেমন করে?”
“আপনারা আমার সুখ-দুঃখে বুঝতে পাচ্ছেন না।”
“তুমি বলতে চাও, তোমার সুখ-দুঃখের কথা তুমি নিজেই চিন্তা করো।”
“আর কেউ করে না।”
“এত লেখাপড়া শিখে তুমি, এত বড় অকৃতজ্ঞের মত কথা বলছো?”
আমেনা নরম হইয়া পড়িল। অনেকক্ষণ হাত রগড়াইয়া আমেনা বলিল, “এ বিবাহে সুবিধা হবে না।”
“কেন? কোনোদিক দিয়ে?”
“আমার মন এগোয় না। কিছুতেই এগোচ্ছে না।”
“তুমি কি মিস্টার হাছানকে ঘৃণা কর?”
”না, কখনো না। কখনো না। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।”
“তবে তোমার এ কি ব্যবহার?”
“তিনি আমাকে বিবাহ করে সুখী হবেন না। আমি তার চেয়ে অনেক হীন। যেচে সেধে আমি কাহারো সহিত বিয়ে পুষতে চাই না।”
“কে বললে তোমাকে বিয়ে করে সুখী হবে না? তুমি জান না, সে তোমাকে অত্যন্ত ভালবেসে ফেলেছে ইহা সাময়িক নহে। তার মনের এই ভাব চিরকাল থাকবে। তুমি তার চেয়ে হীন? মিথ্যা কথা। রূপ-গুণে তুমি তার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। তার সঙ্গে মিশতে তোমার কোনো সঙ্কোচ আবশ্যক নাই। ভয়ে ভয়ে তোমাকে কাল কাটতে হবে না। তোমার স্বাধীনতা নষ্ট হবে না। যেচে-সেধে কেউ তোমাকে বিয়ে দিচ্ছে না। বরং কারই আগ্রহ বেশি। মানের ঘোরে যদি কেউ আগে বিয়ের প্রস্তাব না করে তবে বিয়ে কী করে হবে? আমরা আগে প্রস্তাব করেছি বলে কি আমাদের মান গিয়েছে? আমাদের মেয়ে তুমি। চির জীবনের মতো তোমাকে একটা অগৌরবের মধ্যে ফেলে দেবো এই যদি তোমার বিশ্বাস হয় তবে সেটা মিথ্যা ধারণা।”
০ ০ ০ ০
বেলা ১২টার সময় আবদুর রহমান ফিরে এসে বললেন, মেয়ের মতে ১২ হাজার টাকার কাবিন হোক। আর কোনো কথা নেই।
কেহ আপত্তি তুলিলেন না।
অবিলম্বে সুখ ও দুঃখের ভবিষ্যৎ লইয়া দুটি অপরিচিত আত্মার আচ্ছেদ্য বন্ধন হয়ে গেল!
বিবাহের পরের দিনই তার এলো মিস্টার হাছান ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ হয়েছেন। কাজ শিক্ষার জন্য তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রেনিং-এ যোগ দিতে হবে।
.
সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ
অন্নদা পতিতা, তার ঘরের মধ্যে সে বিহারীর কাঁধের উপর হাত রাখিয়া বলিল, “দেখতে কেমন?”
বিহারী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “কী বলেন? দেখতে যেন কাঁচা হলুদ। আগুনের দলা। ঠিক যেন দুর্গা ঠাকুরুণ।”
বিহারী ধীরব মানুষ। পতিতাদের গহনা ও কাপড়ের চটক দেখিয়া মনে করিত, তারা এক একজন মহারানী। সুতরাং সে ভয়ে তাহাদের সহিত খুব সম্ভমের সহিত কথা বলিত।
অন্নদা বলিল, “তাহলে পঞ্চাশ টাকাতেই স্বীকার?”
“আমার যেন বড় অধর্ম হবে।”
“তুই তো আর কচ্ছিস না। তুই গরিব মানুষ, একটা ভদ্র লোককে বাড়ির ভিতর স্থান দেওয়া কি তোর পক্ষে সম্ভব? তার আর ভদ্রলোকদের কোপনজরেও তুই পড়তে পারিস। কাজ তো এত ঝঞ্ছট দিয়ে! আমার ঘাড়ে পার করে দে। তোর কিছু অধর্ম হবে না। যা করবার আমিই করবো।”