আবদুর রহমানের সহিত সরযু এই বিষয় লইয়া একবার পরামর্শ করতে চাহে।
ফেরত ডাকে রহমান সরযুকে শত ধন্যবাদ দিয়া পত্র লিখিয়া দিল–শীঘ্র সে একবার তাহার সহিত দেখা করিবে।
কে যেন অতি অস্ফুটস্বরে সেই সময় রহমানের মনের ভিতর বলিয়া গেল, “আহা! সরযু যদি মুসলমান হইক।” রহমান চমকিত হইয়া বলিয়া উঠিল–ছি!
রহমান তখনও অবিবাহিত।
.
পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যাবেলা বকুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রমা নিহারের মতো হাত ধরে বললে–“নিহারা! দিদি! বল, তোর মন কি বলে?
“মনে দিন রাত হুহু করে আগুণ জ্বলে। কী করব, তুই বল? আর তো উপায় নাই, অত্যাচারী সমাজ আমাদের বিধবার হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দিয়ে বেঁচে থাকবে না? মুসলমানদের কেমন সুন্দর ব্যবস্থা। কোনো নারীর স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয় না। হিন্দুদের ভিতর পুরুষ একশটা বিবাহ করতে পারে, আর মেয়েরা সারাজীবন আগুনকে বুকের ভিতর পুষে রাখবে। কি ধর্ম! কি অবিচার!”
রমা শূদ্রের মেয়ে। নিহার কায়স্থের মেয়ে। তত্রাচ এদের মধ্যে বাল্যকাল হতে অত্যন্ত ভালবাসা। একজনের ব্যথা অন্যজন প্রাণপণে বুঝিতে চেষ্টা করে। বাল্যকাল হতে তারা। এক জায়গায় খেলা করে, তাহার পর একই সময় তাহারা বিধবা হয়, উভয়ের মানসিক অবস্থা! একই প্রকার ভয়ানক, সুতরাং প্রতিদিন তাহাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্বন্ধ আরও গাঢ় হইয়া উঠিতেছিল।
রমা নিহারের গলা ধরিয়া বলিল–“দিদি, কী করে একটা দীর্ঘ জীবন কাটাবো? প্রাণ যে ফেটে বেরোয়! কেউ আমাদের দুঃখ বুঝে না। আয়, আমরা বিষ খেয়ে মরে যাই।”
“মরতে পারলেও এ জ্বালা জুড়োতো কিন্তু নিজ হাতে কেমন করে নিজের প্রাণ বের করে দেবো?”
“তা তো ঠিক। আমরা মরি না কেন? পোড়া ব্যাধি আমাদেরকে কি চেনে না!”
“আচ্ছা আয়, ঠাকুরের কাছে পাঁঠা মানত করি। ঠাকুরকে বলি–ঠাকুর আমাদেরকে তোমার শীতল ক্রোড়ে আশ্রয় দাও। আমরা দুইবোন জোড়া পাঁঠা দেবো।”
“মরে গেলে কেমন করে ঠাকুরকে পাঠা দেবো?”।
রমা চিন্তা করিয়া বলিল, “তা তো ঠিক, কিন্তু আর যে সহ্য হয় না। অধর্ম ও পাপ করতে পারবো না আমরা, কিন্তু এ আগুন কি করে নিভাবো?”
“দেখো আমাদের আত্মীয়-স্বজন কেউ আমাদের দুঃখের কথা ভাবে না। কেউ আমাদের বেদনার কথা জানে না। সংসারের কাজ চলে যায়। কে খোঁজ রাখে, কার মনের ভিতর কী চিতা জ্বলেছে! সাধু ও জ্ঞানী যারা তারা স্ত্রীলোককে ঘৃণা করেই নাকি এত বড়!”
নিহারের চোখে অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে ছিল। গাছের পাতাগুলি বেদনায় কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।
রমা নিহারকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “দিদি, ভগবান ব্যথিতের বন্ধু, তার উপর আস্থা থাকা আবশ্যক। আমরা যদি মুসলমান হতাম, তাহলে এ নরকের আগুনে পুড়ে মরতে। হতো না। মুসলমানদের হৃদয়ে আছে, তারা দুঃখীর দুঃখ বুঝে; উপাসনা করতে জানে। মৌলভী সাহেবের বিধবা মেয়ে জমিলার সেদিন এক ডেপুটির সঙ্গে বিয়ে হল। জমিলা। দেখা হলেই বলে, তার মৃতস্বামীর স্মৃতি সে মুছে ফেলে নাই। ডেপুটি তার মৃত স্বামীর নতুন মূর্তি পরিগ্রহ করে তাকে ভালবাসে। সে ডেপুটির কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ সে জমিলার এত বড় শোককে একটু লাঘব করতে এগিয়েছে। এরূপ স্বামী পেলে কে দ্বিতীয় বার বিবাহ করতে লজ্জা বোধ করে? মায়ের এক সন্তান মরে গেলে সে তার দ্বিতীয় পুত্রকে টেনে নিয়ে শোক ভুলতে চায়। তাতে কি তার মাতৃত্বের মহিমা কমে যায়?”
নিহার বলিল–“আয় আমরা দুজনেই মুসলমান হই। মুসলমান ধর্ম খুব ভালো ধর্ম। শুনেছিস তো, মৌলবীরা কত সত্য কথা বলে।”
“কি করে মুসলমান হবো?”
“তাহলে খুব ভালো হয়, কেমন?”
‘হ্যাঁ তা ঠিক। বেশ ভালো যুক্তি বটে। মুসলমানদের মধ্যে খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কি করে কি করবো?”
“সে ভার আমি নিচ্ছি। নইমুদ্দিনের দাদা আমাকে আর তোকে খুব ভালবাসে। তাকে সব কথা বলবো। সে কলকাতা ইসলাম মিশনে খরব দেবে। সেখান থেকে মৌলবী এসে আমাদিগকে মুসলমান করে ভালো বিয়ে দেবে। সবার মাঝে নইম দাদা বলবে দুটি হিন্দু রমণী স্বেচ্ছায় মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে চায়। কারো বাধা দেবার ক্ষমতা থাকবে না?”
দু’জনে ঠিক করলো নইম দাদা আশ্রয় গ্রহণ করা কর্তব্য।
৩৬-৪০. মসজিদের ভিতর লোকে লোকারণ্য
ষড়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
মসজিদের ভিতর লোকে লোকারণ্য। মিস্টার আবু হাছানের আজ এমদাদ মিঞার সর্বগুণালঙ্কৃতা কন্যা আমেনার সহিত বিবাহ।
আবদার রহমান বরের কাছেই বসিয়াছিলেন।
এক বিপদ উপস্থিত হইয়াছে মৌলবী এমদাদ সাহেব ও তাহার স্ত্রী আমেনাকে কবুল’ বলাইতে পারিতেছেন না। কত রকমের বুঝান হইতেছে। জাতি যাইবার ভয় দেখান হইতেছে কিছুতেই আমেনা বলিবে না–“বিবাহের রাজি আছি।”
পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের মতো লজ্জা ও শরমে সে নিজের গলায় নিজে ছুরি দিয়া ভদ্রতার পরিচয় দিতেছিল না সে রানীর মতো নিজের দাবি বুঝিয়া লইবার জন্য কঠিনভাবে বলিতেছিল ”একে বিবাহ করিতে আমি রাজী নহি।”
সভার লোক আমেনার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া একেবারে অবাক। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল এমন ভয়ানক মেয়ে তারা কখনো দেখে নাই। হবে না কেন, লেখাপড়া শিখিলেই মেয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মা-বাপকে পর্যন্ত গ্রাহ্য করে না।
সভাস্থ সকল লোক চিন্তাযুক্ত! হাছানের পিতা রাগিয়া আগুন হইতে ছিলেন।