সুরীর অর্থের অনটন ছিল না। কিন্তু এত টাকা দিয়া সে কী করবে? নিজের আদৃষ্ট এবং সংসারের দুঃখ ও বিচিত্রতা ভেবে সে ইচ্ছা করলে সারাজীবন পীড়িতের সেবায় কাটাইয়া দিবে। কত লক্ষ লক্ষ রমণী দুঃখে, বেদনায়, অভাবে ও বিপদে পড়িয়া পথে দাঁড়ায়। তাহাদের আর ফিরিবার পথ থাকে না। কত পবিত্র ও সৌন্দর্যের ফুল অকালে শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে। কেহ তাহাদের খোঁজ রাখে না। জীবনে একবার একটা ভুল করিলে তাহার আর অনুতাপ করিবার উপায় নাই। কি অসীম দুঃখ বেদনা কি ভীষণ পাপে লক্ষ লক্ষ রমণীর বুকে চিতা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাদের একটু সরে দড়াবার পথ নেই। কত বড় বড় ঘরের কত সাধ্বী সংসারের অবহেলা ও ঘূর্ণাবর্তে পড়িয়া ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক পথে এসে দাঁড়ান। তাহাদের আঁখিজলের খবর কেউ রাখে না। তাদের বেদনা জগৎকে জানাবার কোনো উপায় নেই। একে দারুণ লজ্জা তার উপর মানুষের ঘৃণা ও অবহেলায় তারা নিবিড় আঁধারের মধ্যেই আত্মগোপন করে।
সরযু ক্যামবেলে ভর্তি হইয়াছে। মানব-সেবার পক্ষে ঔষধের জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
যত মেয়ে-ছাত্রী ছিল, তাদের মধ্যে সরযুই সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্রী। তাহার অনুধাবনশক্তি দেখিয়া কলেজের সকলেই চমৎকৃত। সে প্রতি পরীক্ষায় সুবর্ণ-মেডেল ও বৃত্তি লাভ করে। সমস্ত বৃত্তি সে, আতুর অনাথিনী রমণীগণকে বিলাইয়া দেয়। রমণী হইয়া সে রমণীর দুঃখ ভালো করিয়া বুঝিয়াছিল।
কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের মোড়ে সে একটা ছোট দোতলা বাড়ি লইল।
ভাড়া চল্লিশ টাকা। প্রতিদিন নিজের গাড়িতে চড়িয়া সে স্কুলে যায়। হুগলীর সম্পত্তি হইতে তাহার মাসিক আয় ৩০০ টাকা। এই তিনশত টাকাতেই তার বেশ চলতে লাগলো।
কখনও সে ব্রাহ্ম-মহিলাদের মতো, কখনও মেয়েদের মতো পোশাক পরে।
চাকরের মধ্যে একজন পশ্চিমদেশীয় দারোয়ান। বেতন তার দশ টাকা আর খাই খচর। একজন দাসী, তার বেতন পাঁচ টাকা।
একটু স্পর্শে, একটুখানি ভুলে যে ধর্ম নষ্ট হয়, সেই হিন্দু ধর্মের উপর সে আস্থা হারিয়েছিল। কেহ যেন তাই বলিয়া মনে না করেন সরযুর কোনো ধর্ম ছিল না। জীবন তার অত্যন্ত পবিত্র। সর্বদুঃখহর ঈশ্বরের কারুণ্য ও সর্বনিয়ামক শক্তির উপর তার গম্ভীর বিশ্বাস। মানুষের কাছে কোনো ধর্মের লোক সে, জানাইবার প্রয়োজন হইলে সে কহিত, আমি ব্রাহ্ম। সরযু বুঝিয়াছিল, জগতের কুসংস্কার ও মিথ্যার মাথায় পদাঘাত করিতে বিশ্বের সকল। মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্র পুত প্রেমের শৃঙ্খলে বাধিতে ইসলামই পথ। পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিতরে সে মুখ ফুটিয়া সে কথা প্রকাশ করিতে ভয় পাইত। সে দেখিল, এসলামের অণুকরণের নব গঠিত ব্রাহ্ম ধর্ম ও কুসংস্কার ও ভুলের প্রধান শত্রু। ইহাদিগকে অবাধে মুসলমান বলা যাইতে পারে যদি ও তারা লজ্জা ও ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিবার খাতিরে মুসলমান নাম গ্রহণ করে না। মহাত্মা রামমোহন রায়ের সময় যদি বঙ্গদেশের। মুসলমানের অবস্থা ভালো থাকিত। তবে চিন্তাশীল, উন্নত হিন্দু সম্প্রদায় ব্রাহ্মধর্ম বলিয়া এসলামের নূতন শাখা বাহির করিতেন না।
সরযুর জীবন কী সুখময়! তার কামনা নাই, বাসনা নাই, মানুষের কল্যাণে বাসনা নিয়েই তার জীবন। তার জীবন কত পবিত্র, কত মধুর!
বাড়িতে পড়ে পড়ে তার বাংলা সাহিত্যে বেশ জ্ঞান জন্মেছিল। আরবি শব্দ বাঙ্গালায় পড়ায় সুবিধাজনক নয় দেখিয়া, সে অল্পদিনের মধ্যে দুই তিন খানা ইংরেজি বই পড়িয়া লইল।
কোনো পুরুষ লোকের সহিত সে আলাপ করিত না। স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা আবশ্যক জানিলেও সে স্বাধীনতার অর্থ পুরুষের সহিত মেলামেশা মনে করিত না। পুরুষকে সে। সাধ্যমত দূরে রাখিত। সামনাসামনি হইয়া কখনও সে পুরুষের সহিত কথা বলিত না।
কঠিন পরিশ্রমের ফলে সরযু প্রশংসার সহিত দুই বৎসর অধ্যয়ন করিল, আর এক বৎসর পরেই সে উপাধি লাভ করিবে।
এই পরিশ্রম ও ঔদাসীন্যের ভিতর সে একটা লোকের কথা অত্যন্ত আগ্রহের সহিত ভাবিত। সে যে কলিকাতা আসিয়া এবং ক্যাম্বোল ভর্তি হইয়াছে তাহা যথাসময়ে সে মিস্টার আবদুর রহমানের কাছে লিখিয়াছে। আবদুর রহমানের গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ চিঠি সরযুর মনে একটা মধুর পরিত্রতায় পূর্ণ দাগ ফেলিত।
এই দীর্ঘ দুই বৎসরের মধ্যে অনেকবার মিস্টার রহমানের সহিত সরযুর দেখা হইয়াছে। মিস্টার রহমানকে সে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে।
রহমান সেদিন ও সরযুর হাতের একখানা চিঠি পাইয়াছে। পত্রের প্রতি পঙক্তি সরযুর দেবীভাবের পরিচয় দিতেছে। আবদুর রহমান এমন আশ্চর্য দেবীপ্রতিমা রমণী আর কোথাও দেখে নাই। সে তাহাকে একজন অকৃত্রিম বন্ধু মনে করে। সরযুর ন্যায় মহিলার সহিত আলাপ করিয়া সে গৌরব অনুভব করে। সরযুর জীবন ও সাধনার প্রতি আবদুর রহমানের মনে একটা আশ্চর্য সহানুভূতি জাগিয়া উঠিয়াছে।
সেদিন আব্দুর রহমান সরযুর পত্রে জানিতে পারিয়াছে, সরযু একটা আশ্রম খুলিতে চাহে। সেখানে সহায়-সম্পত্তিহীন রমণীরা নিম্নশিক্ষা করিবে। সরযু, বহু টাকা ও সম্পত্তি এই কার্যে উৎসর্গ করিতে চাহে। সমস্ত জীবন কুমারী থাকিয়া সে তার এই উদ্দেশ্যে কর্মে পরিণত করিতে চেষ্টা করিবে। দেশের স্ত্রীলোকের দুঃখ, পাপ ও সহায়হীনতা তাহাকে দারুণভাবে আঘাত করিয়াছে। এই জন্যই সে ক্যাম্বেলে ভর্তি হইয়াছে।