“তবে যে আমি কোনো কিছু দিলে তুমি লও না?” কাদম্বিনী কথা বলিল না।
রাধা আবার বলিল–“ও পাড়ার নিমাই ঘোষের ছেলে জামালপুরে গিয়েছিলো। সে যা দেখে এসেছে তা লোকের কাছে বলবার যোগ নাই রাম! রাম!”
কাদম্বিনী আগ্রহান্বিত স্বরে কহিল, “কি খবর রাধা? তার কোনো অমঙ্গল হয়েছে কি?”
রাধা কহিল–“অমঙ্গল! কীসের অমঙ্গল? তুমি যেমন বোকা দিদি! সে ওদিকে নবাবি চলা চেলে তোমার কথা ভুলে মদ আর গাঁজা, আর নিত্য নূতন মেয়ে মানুষ নিয়ে সুখভোগ করছে, আর তুমি উঠতে-বসতে তার নাম করছে!”
কে যেন কাদম্বিনীর গায়ে জ্বলন্ত মশাল ছুঁইয়ে দিল। অন্ধকারে কাদম্বিনীর মুখোনি সহসা অতিমাত্রায় বিস্ময় ও ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো।
কাদম্বিনী আবার কহিল–“নিমাই ঘোষের ছেলে নিজের চোখে দেখে এসেছে?”
সে মিথ্যা আর বলবে কেন? তার কি এতে কোনো স্বার্থ আছে?
সমস্ত রাত্রি কাদম্বিনী ঘুমাইল না।
তার এই সতীত্বের, এই অপেক্ষার এই পরিণাম!
পরদিন হাট থেকে রাধা আট সের চাল, এক জোড়া কাপড় এক বোতল তেল আনিয়া কাদিম্বনীর কাছে পাঠাইয়া দিল। কাদম্বিনী তাহা লইতে আজ অস্বীকার করিল না।
নিমু শেখের শালা মহিউদ্দিন। ছোটকালে তার নাম ছিল মদো। সে গরু রাখত আর পাড়ায়। পাড়ায় তামাকে খেয়ে বেড়াতো।’
কলকাতা থেকে সেবারে এলাম প্রচারকমণ্ডলীর এক মৌলানা এসেছিলেন। এক বিরাট সভা হয়েছিল। দু’দিনের পথ থেকে মানুষ চাল-চিড়ে বেঁধে বক্তৃতাশুনতে এসেছিল।
মদো সেদিন তার মুনিব-বাড়ি গেল না। গরুগুলি মরার গেল বলে কয়েকবার তার মুনিব চীৎকার করতে করতে ডাকতে এলেন; মদো প্রত্যেক বারেই বলিল–তার ভয়ানক মাথা ধরেছে। বিছানা হতে তার ওঠবার যো নাই।
মুনিবের চীকার যখন আর শোনা গেল না তখন সে তার মার কাছ থেকে একটুখানি তেল নিয়ে; মিঞাদের পুকুর থেকে ডুব দিয়ে দুটি পান্তা খেয়ে তুলে–থোওয়া কাপড়খানা পরে, ক্ষারেকাঁচা একপাট্টাটা মাজায় বেঁধে, সাজানো গামছাটা কাঁধে ফেলে চুপে চুপে মৌলানা সাহেবের বক্তৃতা শুনতে চলে গেল। মদো বা মধু দেখলো কত হাজার হাজার লোক। তার রাখাল হৃদয়ে যেন এক অপূর্ব ভাব সে উপস্থিত হল। সে ধুলা ঝেড়ে এক জায়গায় বসে বক্তৃতা শুনতে আরম্ভ করলো। মৌলানা সাহেব কত কথা বললেন। মধুর চোখে কখনো জল এলো, কখনো ক্রোধ তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারলে সে সামান্য জাতি নয়। তার পূর্বপুরুষগণ জগতের বড় বড় লোক ছিলেন। তার মনে প্রশ্ন হল, সে তবে কেন এত ছোট, এত ঘৃণিত?
মৌলানা বললেন–“মানুষকে মরতে হবে। টাকা-কড়ি-ধন-সম্পত্তি কিছুই মানুষকে বড় করে না। বড় করে শুধু বিদ্যায়, আর যার চরিত্র বড় সেই বড়। পদবীতে লোক বড় হয় না। যে কোনো মুসলমান শ্রেষ্ঠ হতে পারে। খোদা কারো মাথায় বড় ছোট বলে ছাপ মেরে দেন নাই। যে বড় চেষ্টা করে সেই বড় হয়!”
মধুর মনে প্রশ্ন হল, সে কেন বড় ও শ্রেষ্ঠ হয় না?
মৌলানা বললেন ”যে মুসলমান বিদ্যা লাভ করে না সে মুসলমান নয়। প্রত্যেক মুসলমানকে বিদ্যা লাভ করতে হবে। মূর্খের উপাসনার কোনো মূল্য নাই! জ্ঞান লাভ করা মুসলমান ধর্মের এক শ্রেষ্ঠ নির্দেশ!”
মধু ভাবিল, সে মুসলমান নয়। যতদিন না সে বিদ্যালাভ করতে পারে ততদিন সে কাফের।
মৌলানা আবার বললেন–খোদাকে ভরসা করে মানুষ যা ইচ্ছা করে তাই হতে পারে।
মধুর প্রাণের ভিতর আগুন জ্বলে গেল। সে সভার মধ্যেই নীরবে প্রতিজ্ঞা করলে, সে যত দিন না লেখাপড়া শিখে একজন মুন্সী হতে পারে ততদিন সে মুসলমান নয়। বাড়ি ফিরে এসে পরদিন অতি প্রত্যুষেই বিছানা থেকে উঠে একেবারে সে শহরে চলে গেল। একখানা প্রথম ভাগ আর একখানা আরবি বই কিনে বাড়ি ফিলে এলো।
আজ দশ বৎসর পরিশ্রম করে মধুর মনস্কাম সিদ্ধ হয়েছে। সে এখন মুন্সী মহিউদ্দিন।
বাঙালা ও আরবি ভাষায় মহিউদ্দীনের যথেষ্ট দখল জন্মেছে। কেউ তাকে তুমি বলে কথা বলতে সাহস পায় না। ভিতরে তার শক্তি জেগেছে, সে একজন খাঁটি মুসলমান হয়েছে। খোদার জন্য সে যে কোনো কাজ করতে পারে। সে কোনো মানুষকে ভয় করে না। খোদা ছাড়া আর কেউ তার প্রভু নয়। ইদানীং ইংরেজি ভাষায় তার ব্যুৎপত্তি জন্মেছে। সে এখন একজন খাঁটি ভদ্রলোক যথার্থ একজন মুসলমান। সে অত্যান্ত বিনয়ী, মান বাড়ানোর জন্য সে বিনয়ী নয়। ভিতরটাই তার বড় হয়ে গিয়েছে। তাকে সম্মান ও নমস্কার করতে প্রত্যেক হৃদয়বান মনে আহ্লাদ হয়। সে একজন চাষার ছেলে এ কথা সে ঢাকে না। সে বলে এতেই তার বেশি গৌরব, এতেই তার বেশি মনুষ্যত্ব।
ভগ্নিপতি নইম শেখের বাড়ি আজ মহিউদ্দিন এসেছেন। ছোটকালের মধুকে দেখে নইমের মনে গৌরব জন্মেছে। তবুও সে আর তাকে মধু বলে ডাকতে সাহস করছে না।
মহিউদ্দিন তার চাষা ভগ্নিপতির মানসিক অবস্থার কথা বুঝতে পেরে বললেন ”আমি সেই মধুই আছি। আমার জন্য কোনো সম্মানের আবশ্যক নাই।”
নইম তার সরল চাষা-প্রাণের অন্তঃস্থল হতে আশীর্বাদ করে বললে,–“খোদা তোমাকে বেহেশত নছিব করে। তুমি আমাদের গৌরব।”
মহিউদ্দিন বললেন–“তোমরাও আমার গৌরব।”
.
চতুত্রিংশ পরিচ্ছেদ
সরযু বা সুরীর মা, আবদার রহমান যে দিন হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসে তার দু’দিন পরেই মুত্যুমুখে পতিত হয়।
সরযু মোহিনীর মৃত্যুর একমাস পরে কলিকাতা চলে আসে। সংসারের সমস্ত সুখ সে বিসর্জন করলে।