বিহারীর বোন বলিল–“হিন্দুর বৌ তুমি, তোমার তো জাতি গিয়াছে। হিন্দুর মেয়ের কোনো বিপদ হলে জাত থাকে না, তা বুঝি জান না?”
সৌদামিনী বুকের ভিতর একটা দীর্ঘ তীক্ষ্ম শলার মতো কি যেন প্রবেশ করিল। বাহিরে তিনি বলিলেন–“ওসব কোনো কথা নয়, তার স্বামী নিশ্চয়ই তার সন্ধানে বেরিয়েছেন।”
আরও বললেন–“তারা যে কষ্ট স্বীকার করেছে তার জন্য তারা যথেষ্ট পুরস্কার পাবে।”
বিহারী, নবা ও বিহারীর বোন পুরস্কারের নাম শুনিয়া আনন্দিত হইয়া উঠিল এবং তৎক্ষণাৎ বিহারী চিড়ার সন্ধানে বাহির হইল।
শীঘ্র শীঘ্র গ্রামময় রাষ্ট্র হইল, নদী দিয়ে একটি বৌ ভেসে যাচ্ছিল, বিহারী আর নবা তাকে তুলে বাড়ি এনেছে।
বর্ষীয়সী রমণীরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললে–“আহা বউটির জাত গেল, তবে আর বেঁচে থেকে লাভ কি?”
একমাস অতীত হইয়া গিয়াছে তবুও কেউ সৌদামিনীর সন্ধানে এলো না একমাস পরে সৌদামিনী একটা কাল সন্দেহ বুকে নিয়ে একখানা পত্র লিখিল। পত্রখানি এই :
তারিখ … প্রিয়,
কি লিখবো! চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। আমি নদীর উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম। দুইজন ধীবর আমাকে তুলে এনেছিলো! আমি বর্তমানে এখানে আছি। তুমি পত্র পাঠমাত্র এসে আমাকে নিয়ে যাবে। পথের পানে চেয়ে রইলাম।
দাসী সৌদামিনী এক সপ্তাহ পর উত্তর এলো–
প্রিয় সৌদামিনী!
তোমার পত্র পেয়েছি। হাজার দুঃখ হলেও তোমাকে আর আনবার যো নাই। ১০টি টাকা পাঠাইলাম। আরও অনেক পাঠাইব। সেখানে ঘর বেঁধে নিও। সমাজের ভয়ে আমার সেখানে যাবার যো নাই।
ইতি–
শ্যামচরণ।
পত্র পড়ে সৌদামিনী মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ে গেল। এত ভালবাসার এই পরিণাম! সমাজের ভয়ে শ্যামচরণ তার এত বছরের স্ত্রীকে অবাধে ফেলে দিলেন। আপন স্ত্রীর প্রতি এত অবিশ্বাস! স্ত্রী তবে কেমন করিয়া পুরুষকে বিশ্বাস করে? স্ত্রীলোকের কী আত্মা নাই? স্ত্রীলোকেরই জাতি যায়? পুরুষের কী জাতি নাই? একটা আত্মার জন্য, একটা সত্যের জন্য সমস্ত বিশ্বসংসারের সহিত সগ্রাম বাঁধালে কি ক্ষতি? বালা দুগাছি বিক্রি করে সৌদামিনী ধীরদেবরকে ও বিহারীর বোনকে ২০ টাকা দিল। বাকি এক মাসের খাবার খরচ করে কয়েকখানি কাপড়ে ব্যয় হয়ে গেল। সৌদামিনীর কষ্টের অবধি রহিল না। ছোট লোক পয়সার চাকর। সৌদামিনী একেবারে পথের ভিক্ষারিণী হলেন। যার মান-মর্যাদা কিছুই এর পরে রইল না। যাকে ধরে তার এত সম্মান সেই যে তাকে তার বিপদের সুযোগ নিয়ে পথে ফেলে দিচ্ছে। এই কি ধর্ম?
তার কি হয়েছে? কেন তাকে ফিরে নেওয়া যাবে না সহায়-সম্পত্তিহীন হয়ে স্ত্রীলোকের পক্ষে ছোটলোকদের মধ্যে কেমন করে কাল কাটান যায়? গত জীবনের এত ভালবাসা, এত প্রেমের প্রতিজ্ঞা মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল। একটা মানুষের জন্য, একটা সত্যের জন্য মানুষ যারা তারা সমাজ তো দুরের কথা, নিজের জীবন দান করতে আনন্দ বোধ করে। নারীর উপর স্বামীর একি অত্যাচার! ইহাই কি ধর্ম। ইহারি নাম কি জাতিরক্ষা। এই পৈশাচিক ধর্মই কি এতকাল সে পালন করে এসেছে। ধর্মের নামে একি অত্যাচার?
সৌদামিনীর ইচ্ছা হইল, সমস্ত দেবতাগুলোকে তিনি পৃথিবী ছাড়া করেন। সমস্ত হিন্দু সমাজকে তিনি সাগর-জলে ডুবিয়ে মারেন।
তিনি কেমন করে এখানে থাকবেন। এই সব ছোটলোকদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস কী? হায়! এমনি করে বিধাতা তার কপালে আগুন ধরিয়ে দিলেন। কোথায় তার পুত্র হরিচরণ? সে হয়তো তার মাকে এমনি করে ফেলে দিত না। সে সংসার ছাড়তো, সে ধর্ম পরিত্যাগ করতো, কিন্তু তার মাকে সে ফেলতো না। সৌদামিনী হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। তিনি কোনো দিন ভাবতে পারেন নাই, তাঁর স্বামী তাঁর পুত্রের তুলনায় এত ছোট। তিনি চিরকালই ভেবে এসেছেন যে, পুত্রকে তিনি পরিত্যাগ করতে পারেন কিন্তু তার পতি দেবতাকে তিনি কখনও পরিত্যাগ করতে পারেন না।
.
ত্রয়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
লোহারামের স্ত্রী কাদম্বিনীর কাপড় একেবারে ছিঁড়ে গিয়েছে। সাত বছর সে ক্ষুদ-কুঁড়ো খেয়ে বেঁচে আছে। বাড়ির গিন্নীর পনেরখানা কাপড়। চাকরে আর দুই জোড়া কিনে নিয়ে গেল!
বাড়ির কাজেই রাধাগোবিন্দের বাড়ি। রাধাগোবিন্দ গ্রাম্য সম্পর্কে লোহারামের ভাই, সুতরাং কাদাম্বিনীর দেবর। রাধা প্রায়ই কাদম্বিনীর সঙ্গে আলাপ করতো। অনেকবার সে কাদম্বিনীকে কাপড় কিনে দিতে চেয়েছে। কাদম্বিনী গম্ভীরভাবে রাধার অযাচিত দান প্রত্যাখ্যান করেছে।
আজ সন্ধ্যাবেলা রাধা কাদম্বিনীর ঘরে তামাক টানতে টানতে এসে উপস্থিত হল। ঘরে প্রদীপ নাই। তেল থাকলে আলো জ্বলতো।
রাধা অন্ধকারে কাহাকেও না দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“দিদি, বা আছ গা?”
কাদম্বিনী অন্ধকারের ভিতর হইলে বলিল–“এই যে এখানে বস আছি।”
বেদনায় দারিদ্রে কাদম্বিনীর আর মনের জোর নাই। এই দুঃখ ও অভাবের শেষ কোথায়?
কাদম্বিনী একখানি ছেঁড়া ছালা পেতে দিয়ে বললে, “বসো রাধা।”
রাধা তামাক টানিতে টানিতে আবার বলিল–“এমনি করে আর কদিন চলবে দিদি?”
কাদম্বিনী মুদৃ আর্দ্র কণ্ঠে বলিল–“কি করবো। ভগবান কপালে যা লিখেছিল তাই হচ্ছে। কে আছে আমার এ সংসারে?”
রাধা বলিল–“দিদি, অমন কথা বলো না। আমি কি তোমার পর?”
রাধা যে তার কোনো কালের কেউ নয়–কাদম্বিনী তাহা বিলক্ষণ জানিত। তত্রাচ বললে–“না না তুমি পর এমন কথা বলবো কেন?”