ঘটনা আরও ভয়ানক বিচিত্র যে, এই রমণীকে রক্ষা করিবার জন্য কেহ অগ্রসর হয় নাই। মুনসেফ বাবু সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শুধু কাঁদিতে থাকেন।
আবু বলিলেন–“ভয়ানক কথা! অত্যন্ত ভয়ানক!
“দেশের লোকগুলি কী পিশাচ! কাহারো পানে কেউ তাকায় না। এ উহার মাথা ভাঙ্গিয়া খায়। কীসের ধর্ম, কীসের মনুষ্যত্ব!”
৩১-৩৫. আর তো সহ্য হয় না
একবিংশ পরিচ্ছেদ
ফেলী বলিল–“মা, আর তো সহ্য হয় না। চল যাই। থানায় যেয়ে দারোগাকে চারি আনা ঘুষ দিয়ে নাম লিখিয়ে নেই গিয়ে!”
ফেলীর মা। চল আমিও নাম লেখাবো। আমাদের কোথায়ও স্থান নেই। আজ চারিদিন যাবৎ প্রতিবেশীর নিকট হইতে ফেলীর মা আর ফেলী ভাতের মাড় চেয়ে চেয়ে খাচ্ছে। হায়! মানুষের কি এত দুঃখ! এত দারিদ্র্য, এত ঘৃণা, এত অবমাননার ভিতর। মানুষ কি করে ধর্ম রক্ষা করে! মানুষে মুখে বলে পবিত্র হও, ধর্ম কর, কার্যত সে সদাই মানুষকে অধর্ম করিতে বাধ্য করে।
একখানা ভাঙ্গা ঘর, একখানা থালা, স্বামীর থালা, স্বামীর কালের একখানা পাটা তার পুরানো বদনাটা বিক্রি করে, ফেলীর মায়ের হাতে সাত টাকা হল।
দু’খানা নূতন কাপড়; একখানা আয়না, একখানা চিরুণী, এক শিশি সুগন্ধ তৈল, আর এক কৌটা মাজন তারা গ্রাম্য হাটের দিন কিনিয়া আনিল। মা-মেয়ে ঠিক করিল, ইহাতেই তাদের পাপের মূলধন হইবে!
আঁধার তখনও অল্প অল্প ছিল, মা ও মেয়ে এমনি সময় ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া পড়িল। বুক তাদের কাঁপিল না, বরং একটা মুক্তির আনন্দ অনেক দিন পরে তাহাদেরকে মাতাইয়া তুলিল।
সারাদিন হাঁটিয়া তাহারা ঝিনাইদহ মহকুমায় আসিয়া উপস্থিত হইল। পথের অনেক লোক ফেলীর মুখের দিকে অনেকবার চাহিয়াছিল। এর আগে তার মলিন মুখের দিকে
একবারও কেউ ফিরিয়া তাকায় নাই। আজ মুখে গৌরব! কত রূপ! কত আলো।
রাত্রিতে তারা এক হোটেলে রইল। মায়ে-ঝিয়ে হোটেল-স্বামীর কারণহীন অনুগ্রহে খাবার সময় সকলের চেয়ে বেশি ব্যঞ্জন পাইয়াছিল। সকাল বেলা হোটেল-স্বামী সকলের। নিকট হইতে পয়সা গ্রহণ করিল, কেবল লইল না ফেলী আর তার মায়ের নিকট হইতে।
তারা দেশ ছাড়িয়া নদের জেলা চুয়াডাঙ্গা মহুকুমায় যাইবে। একখানা ফেরত গাড়ির ভাড়া ঠিক হইল এক টাকা। গাড়োয়ান আগ্রহের সঙ্গে হেসে ফেলী আর তার মাকে গাড়িতে তুলে নিল। তখন বেলা আটটা।
গাড়ির ভিতর ফেলীকে তার মা বলিল–“ফুলরানী! ব্যাটাকে পান তৈরি করে দে।”
গাড়োয়ান আনন্দাতিশয্যে বলিল–“থাক; থাক।”
পথের মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেছিল, গাড়ি কোথায় যাবে? গাড়োয়ান অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত বলিতেছিল, “বৌ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে।”
নামাইবার সময় ভাড়া তো লাগিলই না, অধিকন্তু গাড়োয়ান ফুলরানীকে একখানা চাটুকদার শাড়ী আর একটি টাকা দিয়ে বললে,–“মনে রেখ। মাঝে মাঝে এসে দেখা। করলে যেন জায়গা পাই।” ফুলরানী মধুর হাসিয়া বলিল–“জীবনে তোমাকে কখনও ভুলব না। তোমাকে দেখা অবধি মন আমার কেমন হারিয়ে গিয়েছে।” গাড়োয়ান তার। মাথাটা ফুলরানীর পায়ের কাছে রেখে খালি হাতে বাড়ি চলে গেল। এই হতভাগাই আজ পাঁচ টাকা জলে ফেলে না দিয়ে পাঁচটি পয়সাও কি ভিক্ষাস্বরূপ দু’দিন তাহাদেরকে দিতে পারে নাই?
.
দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
“ওটা কী ভেসে যায় রে?”
নবা বলিল–“তাই তো রে, ওটা কী?”
বিহারী নৌকাখানি একটু এগিয়ে নিয়ে বললে–“একখানা কাপড়। চিলুঘাটের ন্যাকড়া বুঝি?”
“না না, ভালো করে দেখ দেখি। চুলের গোছা দেখা যাচ্ছে।”“চল, একটু এগিয়ে দেখে আসি।”
নৌকাখানি এগিয়ে নিয়ে বিহারী আর নবা দেখতে পেলে একটা আধবয়সী স্ত্রীলোক ভেসে যাচ্ছে।
মানুষ যেমন প্রকৃতিরই হোক না কেন, সে একেবারে চোখের সামনে কাউকে মরে যেতে দেখতে পারে না। উভয়ে ধরাধরি করে মাতৃল্পে দেহটি নৌকার উপর টেনে উঠিয়ে, ফেললো।
বিহারী, চিৎকার করে বলে উঠলো,–“আরে জ্যান্তো মেয়ে মানুষ। নৌকা বেয়ে দে একেবারে বাড়ির ঘাটে।”
।তার পরে তীরবেগে নৌকা বেয়ে দিতে তারা ভিতর বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছল।
বিহারী তার দিদিকে ডেকে তাড়াতাড়ি সৌদামিনীর অসাড় দেহ ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে ফেললো। পেটের ভিতর জল যেয়ে পেট ফুলে উঠেছিলো। বিহারী পেট থেকে জল বের করে দিল। বিহারীর বোন সৌদামিনীর গায়ে সেঁক দেওয়া আরম্ভ করলো।
সারাদিন পরে বৈকাল বেলা সৌদামিনী চোখ খুলে চেয়ে দেখে, সে এক ধীবরের বাড়িতে শুয়ে আছে।
বিহারীর বোন বললে–“কে গো তুমি নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলে? বিহারী ও নবা তোমাকে জল থেকে তুলে এনেছে। কী জাত তুমি?”
সৌদামিনী অতিকষ্টে কহিল–“আমি এখানে কেন? মুনসেফ বাবু কই?” বলিতেই তাহার মনে হইল সেত গোয়ালন্দ স্টীমারঘাটে তার স্বামীর কাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলো।
সৌদামিণীয় চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল।
বিহারীর বোন আবার জিজ্ঞাসা করিল–“তোমরা কী জাত? আমাদের জাতি যায় নাই তো?”
সৌদামিনী কহিল, “না, তোমার জাতি যাইবার সম্ভাবনা নাই আমি ভালো জাত।”
বিহারীর বোন একখানা ঘেঁড়া কাপড় আনিয়া কহিল–“এই খানা পরো।”
সৌদামিনী অতি কষ্টে বিছানা হইতে উঠিয়া কাপড় বদলাইল। সে ভাবিতেছিল–ভগবান এ কি করলে?
স্বামীর প্রেম সম্বন্ধে তাহার দৃঢ় আস্থা ছিল। কিছুক্ষণ পরই সে সকলকে কহিল–সে এক বড় লোকের ঘরণী। স্টীমার থেকে জলের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। স্বামী এতক্ষণে তার সন্ধানে বেরিয়েছেন এবং নিশ্চয়ই তিনি অতিশীঘ্র এখানে উপস্থিত হবেন।