.
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
ইচ্ছা করে যুবকটির সহিত যাইয়া গল্প করি। তার মূর্তিখানি যেন কার্তিকের মতো। যত দেখি ততই আমার দেখিতে ইচ্ছা করে। এতে দোষ কী? আমার মনে তো কোনো পাপ নাই। আমি এক বিধবা, তাতে সে ভিন্ন জাতি। হৃদয়ের মধ্যেই পাপ। আমার হৃদয়ে তো কোনো পাপ নাই। যাই, দূর হইতে একবার দেখিয়া আসি। সন্ধ্যাকালে নিতুই দেখি সে যেন আমার প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকে। সেখানে কেউ নাই এখন।
এমন সময় দাসী কমলা আসিয়া সংবাদ দিল, মা তাহাকে ডাকিতেছেন। মায়ের নামে বালিকা শিহরিয়া উঠিল। সে বুঝিল, মা যেমন রোজই তাহাকে সামান্য সামান্য কারণে বকেন, আজও তাহাই করিবেন!
বালিকা কিছু জিজ্ঞাসা না করিয়া ভাড়ার ঘরের কাছে যাইয়া দেখিল তাহারই বয়সের আর একটি মেয়ে দাঁড়াইয়া আছে। সর্বাঙ্গ অলঙ্কারে মোড়া। ক্রোধ ও ঘৃণায় তাহার চক্ষু। দুটি জ্বলিতেছিল।
যদুনাথ বাবুর প্রতিপত্তি হুগলীর সকলেই জানিত। একমাত্র কন্যা ললিতাকে রাখিয়া যখন তাহার ছেলে বয়সের স্ত্রী কলেরায় প্রাণ ত্যাগ করেন, তখন উকিল বাবুর প্রাণ ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল।
বহুবার বহুলোক তাঁহাকে পুনর্বার বিবাহ করিতে বলিয়াছিলেন। তিনি বহু বৎসর ধরিয়া অস্বীকার করেন। জীবনের এই শেষ বেলা যখন ললিতা বিধবা হইয়া বাপের বাড়ি আসিল, তখন উকিলবাবু একটি মেয়ের বয়স কাঁচা বালিকাকে সধবা করিয়া গৃহে আনিলেন।
উঠিতে বসিতে বিবাহের দুমাস পরেই ললিতা ও তাহার নূতন মায়ে দ্বন্দ্ব আরম্ভ হইল।
ললিতা যেন এই নবীনার কাছে একটা বাজে লোক বলিয়া পরিগণিতা হইল। সারা জীবনের অনুগ্রহপ্রার্থিনী ললিতা উঠিতে বসিতে নিগৃহতা হইতে লাগিল।
সে কী করিয়াছে? ঈশ্বর কেন তাহাকে অকালে বিধবা করিয়া তাহার জীবনটাকে এমন আবর্জনা বিশেষ করিয়া তুলিলেন! সবই তাহার বাপের অথচ সে এই দু’দিনেই একবারে পর হইয়া গিয়াছে। কোথা হইতে সে যেন উড়িয়া আসিয়া পরের অনুগ্রহের ভিখারি হইয়াছে! সে আর এখন জোর করিয়া বলিতে পারে না, “এ জায়গাটুকু আমার।”
সেদিন উকিল বাবু অফিসে কাজ সারিয়া বাসায় আসিলেন, তখন গৃহিণী ও বিধবা মেয়ে কলহে ব্যস্ত। গৃহিণী তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। উকিল বাবুর ইচ্ছা ছিল সারাদিনের অবসাদ ও পরিশ্রমের পর গৃহিণীর কাঁচা মুখ দেখিয়া মনটাকে আবার সরস করিয়া লইবেন।
কিন্তু আনন্দের আহ্বানের পরিবর্তে শুনিলেন গৃহিণী কাঁদিয়া কাঁদিয়া কহিতেছেন, “ওগো আর এত জ্বালা সয় না! হয় আমাকে নিয়ে থাক, না হয় তোমার মেয়েকে নিয়ে থাক।”
ক্রোধে উকিল বাবুর শরীর জ্বলিয়া গেল। তিনি ললিতাকে অজস্র গালি দিতে দিতে কহিলেন, “স্বামীকে খেয়ে বাপকে খেতে এসেছে; পরের মেয়েকে এনেছি, তার সঙ্গে রাতদিন এ কি প্রকার ব্যবহার!”
ললিতার বুকে শেলের মতো কথাগুলি বাজিল। ইচ্ছা করিতেছিল সে কোথাও চলিয়া যায়। সে আর তাহার বাপের সুখের কাটা হইয়া থাকিবে না। কিন্তু কোথায় সে যাইবে! ভগবানের এই বিশাল রাজ্যে তার এতটুকুও মাথা রাখিবার স্থান নাই। তার পর একদিন তাহার জ্বর হইয়াছিল। সমস্ত রাত্রি সে জ্বরের ঘোরে তাহার মৃত মায়ের কথা বলিয়াছিল। প্রত্যুষে ঝঙ্কার দিয়া তাহার নূতন মাতা বলিলেন–“পুরোনো মা যদি এত মিষ্টি হয় তবে শ্মশানে গিয়ে বসে থাক না কেন? মা কি কাহারো মরে না! আমরা কি এতই পর? এত পর যদি হই তবে উকিল বাবু আমাকে বিয়ে কল্লেন কেন?”
বিবাহের সময় ললিতার অনেক গহনা ছিল। একদিন ললিতা দেখিল সেগুলি তাহার মায়ের ভগ্নির গায়ে উঠিয়াছে। ললিতা বলিল, “গহনা গায়ে দিবার শক্তি নাই বলে কি ওগুলির উপর আমার কোনো স্বত্ব নাই?” নূতন মা বলিলেন–“এখনো তোমার এত গহনার সাধ! যদি গহনার সাধ এত হয় তবে আর বিধবার ব্রত পালন কেন? শাড়ি পর, গহনা গায়ে দাও, চুলে তেল মাখ, আর একটি মানুষ খুঁজে নিও, মন ঠাণ্ডা হবে!”
কতকাল আগে ললিতার স্বামী মরিয়া গিয়াছেন। মাঝে মাঝে তার এই মৃত স্বামীর বিরুদ্ধে মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিত। সে মরিয়া গিয়াছে, কিন্তু আর একটি লোককে জীবন্ত করিয়া রাখিবার তার কি অধিকার ছিল! মানুষ কি স্নেহ ভালবাসা ব্যতীত বাঁচিতে পারে! স্নেহের এক রত্তিও তাহার প্রাণকে কখনও শীতল করে নাই। মনে পড়িত তাহার মৃত মায়ের মুখোনি। আহা! এ জীবনে আর ললিতাকে কেহ ডাকিয়াও একটা কথা কহিবে না। এ সংসারে আর তাহার কাজ কী? এত অবহেলা ও বেদনার মধ্যে সে কেমন করিয়া বাঁচে?
সেদিন অকস্মাৎ একটি যুবকের অযাচিত ভদ্রতায় কি যেন স্বর্গীয় এক স্নেহের স্পর্শ। সে হৃদয়ে তাহার অন্তরে অনুভব করিল। এমন মধুর করিয়া আর তো তাহাকে কেহ কখনো। সম্বোধন করে নাই। ললিতার ইচ্ছা করে হৃদয় যখন একটি অজানিত বেদনায় ভরিয়া উঠে, রৌদ্রতাপদগ্ধ পৃথিবী যখন বেদনাভরা মধ্যাহ্নে আর্তনাদ করে, তখন একটিবার এই যুবকের পানে তাকাইয়া আসে। সেই মুখে যেন কত স্নেহ তাহাতে কত সহানুভূতি! ইহার অধিক সে ভাবিত না।
শুধু কল্পনা নয়–সত্য সত্য যখন তীব্র যাতনায় প্রাণ তাহার বাহির হইতে চাহিত, সে ধীরে অতি ধীরে জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইত।
তখন সন্ধ্যাকাল, বোর্ডিং-ঘরে কেহ ছিল না। হাছান চেয়ারে বসিয়া ললিতার জানালার দিকে চাহিয়াছিল। সে প্রায়ই দেখিত এ মেয়েটির মুখে একটা বেদনার ছায়া টানা। অন্তরে সহানুভূতি অনুভব করিলেও কখনও কথা কহিত না। একটি অবিবাহিত যুবকের পক্ষে এই প্রকার আলাপ করা অন্যায় হইতে পারে। সমাজের কাছে অন্তত ইহা জঘন্য বলিয়া সহজেই অনুমিত হইবে। তা ছাড়া স্বাভাবিক সঙ্কোচে তাহার জিহ্বা আড়ষ্ট হইয়া উঠিত।