.
ত্রিংশ পরিচ্ছেদ
যথাসময়ে আবু সাইদ ও আবদুর রহমান বাড়ি আসিয়াছেন। তার পর রহমান বন্ধুকে বাড়ি লইয়া গিয়াছেন।
আবু বলিলেন–“ভাই, যেদিন থেকে আমেনাকে দেখেছি সেই দিন হতেই মনটা যেন আমার কেমন হয়ে গিয়েছে। যেমন দেখতে, তেমনি তার গুণ। আমেনাকে স্ত্রীরূপে পেলে আমি খুশি হবো।”
রহমান বলিল–“আর বেশি দেরি হবে না, শীঘ্রই তাকে তুমি পাবে।” ঠিক এই সময় আর এক জায়গায় আমেনা আর তার মায়ের কথা হইতেছিল।
আমেনা বলিল–“মা, শুনতে পেলাম আমাকে নাকি আবুর সহিত বিয়ে দেবার জন্য খুব চেষ্টা করছো?”
মা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“তোর কপাল কি তত বড় হবে আমেনা?”
“কেন আমি কি একটা পশু?”
মা বিস্মিত হইয়া বলিলেন–“কি বলিস মা? তোর কথা, তো বুঝতে পারছি না?”
আমেনা কহিল–“বলছি ছাই। বলি আমরা গরিব মানুষ, গরিবের মতো থাকাই ভালো।
“আবু সাঈদ বড় ঘরের ছেলে। তার উপর সে শীঘ্রই পুলিশ সাহেব হবে। আমরা কি বিনা কারণে এত পরিশ্রম করছি। মা-বাপের মন বুঝি না তো! যদি খোদা তোকে কোনো দিন ‘মা’ করে, তাহলে বুঝতে পারবি মেয়ের জন্য মার প্রাণ কেমন করে।”
আমেনা আমি কী কথা বলছি আর আপনি কী কথা বলছেন! আমি বলছি–আমরা গরিব মানুষ। আমি খুব বড় দরের লোকের সঙ্গে ওঠা-বসা করি নাই। তার মতো শিক্ষিত যুবকের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে আমি পারবো না।
“সে খুব ভালো লোক।”
“ভালো লোক মানে সে আমাকে ঘৃণা করে। ভালবাসার বর্ষা দু’দিনেই কেটে গিয়ে যখন সরল ও সহজ জীবনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হবে তখন সে আমাকে ঘৃণা করবে।”
“তোর কথা কিছুই বুঝি না!”
“এত সহজ করে বলছি তাও আপনি বুঝেন না যে যেমন তার তেমনি থাকা চাই, নইলে মিল হয় না।”
‘আমরা মিল চাই না। তোরা সুখে থাকলেই আমরা সুখী হবো।”
“স্ত্রীর মা-বাপকে ও আত্মীয়-স্বজনকে বাদ দিয়ে কোনো যুবক কোনো স্ত্রীলোককে ভালবাসতে পারে না।”
“ছেলে খুব ভালো। এরূপ ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া ভাগ্যের কথা।”
আমেনা যাহা বলিতে চায় তাহা তাহার মা আদৌ বুঝিতেছিলেন না। আমেনা কয়েক দিন ধরিয়া যতই ভাবিতেছিল, ততই তার মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল। কেন তাহাকে এতটা হীন করিয়া বিবাহ দেওয়া হইতেছে? মিস্টার আবুর কাছে কেন সে এত কৃপার পাত্রী হইতে যাইবে? সে ছোট–সে দরিদ্র। দরিদ্র ও ছোটর ঘরে যাওয়াই তার পক্ষে শ্রেয়। বড়লোকের সহিত দরিদ্রেরা উঠা-বসা, আর মূখের পক্ষে জ্ঞানী সঙ্গস্পৃহা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেন পিতা-মাতা এই সত্য কথা বুঝিতেছেন না। সারাটা জীবন একটা অপমান ও বেদনার ভার লইয়া তাহাকে শ্বশুরের ঘর করিতে হইবে। একটু অপেক্ষাকৃত বেশি সুখের জন্য দুইখানা বেশি গয়নার খাতিরে কেন সে এত আত্মমর্যাদা–জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেকে দীর্ঘ অপমানের পথে দাঁড় করে দেবে। সুখ কি গয়নায়? সুখ সম্মানে; সুখ প্রেমে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! পেটের ছেলেগুলিও তো তাকে বাপের কৃপার পাত্র বলে মনে করবে। ছোট ঘরের মেয়ে বলে বাইরে ঘৃণা না করলেও অন্তর তাদের বেশ করে অনুভব করবে, তাদের মা খুব ছোট।
রহমান হাসিয়া বলিলেন–“বলি, অকস্মাৎ এত আগ্রহ বেড়ে উঠলো! এর মানে কি ভাই?” মি, আবু বলিলেন–“জানি না কেন। একদিন বৈকালবেলা মধুপুরে দরজার ফাঁক দিয়ে তার মুখখানা দেখেছিলাম। কেন যেন এক অপূর্ব মাধুরী তখন তার মুখে জড়িয়ে উঠেছিল। মনে হল, এমন মধুর মুখ জীবনেও কখনও দেখি নাই। সেই দিন হতে মনের ভিতর একটা তীব্র বেদনা জাগ্রত শুরু হয়েছে। সব সময়েই কি যেন ভাবি! খাবার সময় কি দিয়ে ভাত খাই ঠিক থাকে না।”
রহমান কহিলেন–“আমেনার কপাল আর তোমার অনুগ্রহ! এই বিবাহে এমদাদ মিয়া আর তার স্ত্রী তোমার কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে। আমিও অল্প কৃতজ্ঞ হবো না।”
“বটে! তোমার স্বার্থ আছে নাকি?”“এই বিবাহের কর্তা আমি। তোমার সঙ্গে তাকে বিবাহ দিবার প্রধান পাণ্ডা আমি।”
“আমার ভালবাসা না থাকলেও, তোমার খাতিরে তাকে বিবাহ করতাম। বন্ধুর কাছে বন্ধুর মর্যাদা খুব বেশি।”
রহমান বলিলেন–“আমার কপাল!” এমন সময় পিয়ন কাগজ দিয়ে গেল। কাগজ খুলিয়াই একস্থানে রহমানের নজর পড়িল। বিস্ময়াবিষ্ট ও ভীত হইয়া রহমান বলিয়া উঠিল–“সর্বনাশ! এ কি দারুণ সংবাদ!”
রহমানের হাত হইতে আবু কাগজ লইয়া পড়িয়া দেখিলেন :
গতকাল্য মুনসেফ শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামচরণ মিত্র তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া কর্মস্থানে যাইতেছিলেন! ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হইতেছিল। বাতাসও অল্প বহিতেছিল না। বর্ষার জল নদীর কোণায় কোণায় ভরা, শ্যামচরণ বাবু তাহার স্ত্রী লইয়া স্টীমারে উঠিতেছিলেন, এমন সময় দুইজন মুটে সেই পথ দিয়ে নামিতে থাকে। তাড়াতাড়িতে মুনসেফ বাবুর গায়ে ধাক্কা লাগে। তিনি জলের মধ্যে পড়িয়া যাইতেছিলেন। তাঁহার স্ত্রী তাঁহাকে রক্ষা করিতে যাইয়া নিজেই জলের মধ্যে পড়িয়া যান। অন্য সংবাদ–স্টীমারের খালাসীগুলি নাকি সিঁড়ি টান দিয়াছিল। সংবাদ যাই হোক, ব্যাপারটা যেন অত্যন্ত সাংঘাতিক তদ্বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। পরন্তু গোয়ল ও চাঁদপুরের স্টীমার ঘাটের মজুরিগুলি ও কর্মচারীরা যে বিদেশী ভদ্রলোকের উপর অত্যন্ত অত্যাচার করে তদ্বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। উপরিবন কর্মচারীরা ইহার প্রতিবিধানও করেন না। শুনা যায়, মজুর-মুটেরা কর্মচারীদিগকে রীতিমত ঘুষ প্রদান করে এবং কর্মচারীরাও মোটবাহকদিগকে স্নেহের চোখে দেখেন। এই শোচনীয় ঘটনার জন্য কে দায়ী? স্টীমারের খালাসীরাও যাত্রীদের উপর কম অত্যাচার করে না। কাহাকেও কিছু বলিবার যো নাই। প্রত্যেকেই নিজেকে এক একজন রাজা মনে করে। প্রয়োজন হইলে তাহারা যে কোনো বিদেশী লোককে হত্যা পর্যন্ত করিতে পারে।