বেনা কহিল–আমার প্রিয় লেমান, আচ্ছা আমি আর একবার মিস্ ফিনির কাছে যাই। যদি অগ্রিম আরও কিছু পাওয়া যায়।
লেমান তাহার কম্পিত রক্তহীন হাতখানি বেনার চিবুকে রাখিয়া কহিল–না না, আমার প্রিয় বেনা! দরিদ্র বলিয়া কি ক্রমে ক্রমে নীচাশয় হইতে হইবে? মিস্ ফিনিরে তোমার উপর বিরক্ত হইবেন। আমাদিগকে কত ঘৃণার চক্ষে দেখিবেন।
বেণা কহিল–প্রিয় লেমান, আমি তোমার জন্য হাজার অপমান হাজার লজ্জা মাথায় তুলিয়া লইতে পারি; কুমারী ফিনির হৃদয় উন্নত। তিনি আমাদের দুঃখ কাহিনী শুনিলে নিশ্চয় ব্যথিত হইবেন। ধনীর একটু কৃপায় বহু দারিদ্রের প্রাণ রক্ষা হয়।
লেমান বলিল–এখন থাক প্রিয়তমে, এই দারুণ লজ্জা ও অপমান আমি সহিতে। পারিতেছি না। . বেনা–প্রিয় লেমান তোমার রোগজীর্ণ শরীরে মানসিক কষ্ট খারাপ ফল প্রসব করিতে পারে। আচ্ছা, আমি বাহির হইতে আসি। অনেক কথা বলিয়াছি। একটু বিশ্রাম কর।
লেমান শত তালি দেওয়া অথচ পরিষ্কার উপাধানের উপর মাথা রাখিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিল।
বিবাহের দিন বেনা তাহার বাল্যবন্ধুর নিকট একখানি ফুল উপহার পাইয়াছিল সেইখানি বাঁধা দেবার জন্য সে গোপনে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল।
ঘর হইতে বাহির হইবার সময় সে নীরবে চোখের জল মুছিয়া কহিল–দেবতা আমার প্রিয় লেমানকে ভালো করো।
২৬-৩০. জবনহাটী গ্রামের এক বুড়ি
ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ
যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার অধীন জবনহাটী গ্রামের এক বুড়ি আর তার সেয়ানা মেয়ে তাদের স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে মেজের উপর বসেছিল।
মা তার মেয়েকে বলিল–মা ফেলী! তিন জায়গায় তোর নিকে দিলাম। তিন জনই তোকে তাড়িয়ে দিল। নাড়ী কাটায় দুই আনা চারি আনার বেশি কেউ তো দিতে চায় না। কেমন করে চলে?
ফেলী। সেই কালেই তো বলেছিলাম, পরের ছেলেকে বিশ্বাস নাই। তুই কেন নিকে দিলি?
“নিকে না দিয়ে কি করি মা, কি খাব? নিজে না হয় মরে গেলাম, তুই কি করে বাঁচবি? আর তোর তো রক্তমাংসের শরীর, এই বয়স। কী করে তোকে ঘরে পুষে রাখি বল দেখি।“
“আচ্ছা, মা, নিকে যখন করতে আসে, তখন তারা কত ভালবাসা জানায়। এক মাস যেতে যেতেই রাতদিন মারতে থাকে। মেয়েমানুষের এত দুর্গতি কেন? যদি পুরুষমানুষ হতাম তাহলে তো এই অপমান, এত লজ্জা সহ্য করতে হতো না। কি করে ধর্ম রক্ষা করা যায়?”
“মা কি বলবো। পৃথিবীতে ধর্ম নাই। যার গায়ে জোর সেই সম্পদশালী, সেই ধার্মিক। আমরা দরিদ্র লোক, পরনে কাপড় নাই, ভাত নাই, ধর্মও নাই। আয় আমরা বিষ খেয়ে মরি। ধীরে ধীরে একটু একটু করে মরার চেয়ে আয় একবারে মরে যাই।”
“মা, মরা কথাটা বলতে যত সোজা কাজে তত সোজা নয়। আর তা ছাড়া বিষ খেলে মরলে পরকালে তার আর জায়গা হয় না।”
আজ তিন দিন খাওয়া হয় না। মিঞাদের বাড়িতে মিঞার যায়ের মৃত্যু উপলক্ষে ফাতেহা হইতেছিল। ফেলীর মা যুবতী কন্যা ফেলীকে লইয়া খানাবাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইল। ক্ষুধায় তারা পথ চলিতে পারিতেছিল না। বড় দুঃখে, বড় বেদনায় চরণ তাহাদের ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল।
খানাবাড়িতে অসংখ্য মানুষ। কত মূল্যবান, কত বিচিত্র পোশাকে তাদের দেহ সজ্জিত। আলবোলার গন্ধে ধূমে মজলিসে ধূমায়িত। থাকে থাকে, পানের খিলি। যুবকের উচ্চ হাসি, আর বুদ্ধদেব চিন্তাপূর্ণ সংসারজ্ঞানে সভাগৃহ কম্পিত।
মৌলবীরা তর্ক করতেছিল–দাড়ি রাখা সুন্নত। অতএব যাহারা দাড়ী রাখে না তাহারা কাফের, কি না?
এমন সময় শততালিযুক্ত কাপড়-পরা ফেলীকে লইয়া ফেলীর মা সেখানে উপস্থিত হইল। আত্মার মঙ্গলই যখন উৎসবের মূল কারণ, দরিদ্র ও দুঃখীর আশীর্বাদেই যখন পূণ্য, তখন আজি এই সহস্র মুদ্রা আয়ের মধ্যে ফেলীর মায়ের জন্যে কি একটি টাকাও জুটিবে না! একটি টাকাতে যে তাদের দশ দিন চলে। আহা! একটি টাকা তাহাদের কাছে কত মূল্যবান! ফেলীর মা ভাবিতেছে–এমন বিজ্ঞ বিজ্ঞ মৌলবী বসিয়া আছেন ইহারা কি এই সামান্য কথা বুঝিতেছেন না? নিশ্চয় তাঁহারা এই কথার আলোচনা করিতেছেন।
সে আরও ভাবতেছিল–এই সব সম্পদশালী মানুষকে খাওয়াইলে কি লাভ হয়? আমাদের মতো দারিদ্র মানুষকে যদি এই অর্থে ও বস্ত্র দেওয়া হয় তবে আমরা মৃত্যু হইতে বাঁচিতে পারি। আহা! এই সামান্য কথা কি কেউ বুঝবে না? অন্নের জন্য আমরা একটু একটু করিয়া মরিতেছি, আর এইসব মানুষ যাহাদের এখানে আহার করিয়া কোনো লাভ হইবে না, কাহাদের দাবি অধিক? কে খাইলে অধিক পূণ্য লাভ হইবে?
বলিয়াছি ফেলী যুবতী। বক্ষে তাহার ছেঁড়া কাপড়, অনেক টানাটানি করিয়া পরিয়াছে। ফেলী ভালোরূপে তাহার লজ্জা রক্ষা করিতে পারিতেছিল না। তার মলিন বসনের সব জায়গাই যে জীর্ণ। টানিলেই যে ছিঁড়িয়া যায়। মা ও মেয়ে মজলিসের সম্মুখে যাইয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল।
মজলিসের দৃষ্টি সেদিকে পড়িতে না পড়িতেই একজন বলিয়া উঠিলেন–ছিঃ ছিঃ, বেহায়া স্ত্রীলোক! একেবারে উলঙ্গ!
আর একজন বলিলেন–আরে তাড়াও, তাড়াও, বেহায়া পর্দাহীন ছোট লোক। একেবারে উলঙ্গ হয়ে সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এ শয়তান দৃশ্যে ধর্ম রক্ষা হয় না।
তৃতীয় ব্যক্তি বলিলেন–এইসব লোকই সমাজে ব্যভিচার স্রোত বহাইয়া দেয়। এদের তাড়িয়ে দাও।
এক চাকর আসিয়া ফেলীর মাকে রুক্ষস্বরে বলিল,–বেহায়া বেটী! সম্মুখ থেকে দূর হ’। ছোটলোক কোথাকার!