শ্যামল দুর্বার উপর দাঁড়াইয়া আলো ও গানে ভরা প্রকৃতির মধ্যে সৌদামিনী শ্যামাচরণের বুকের উপর মাথা রাখিয়া বলিলেন–এ সংসারে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন
থাকিত, তবে মানুষ বাচিত না। তুমি আমাকে কত ভালবাস, আমি তোমাকে কত ভালবাসি। সকল দুঃখ, সকল বেদনা তোমার মুখের দিকে তাকাইলে ভুলিয়া যাই। .
শ্যামাচরণ স্ত্রীর মুখে চুম্বন করিয়া তাহাকে বুকে আরও একটু চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন–প্রিয়ে, স্ত্রী-পুরুষের মিলন না থাকিলে এই দুঃখ কষ্টভরা সংসারে কেহ বাঁচিতে পারিত না, ইহা সত্য। যেদিন প্রথম তোমকে বিবাহ কর সেই দিন হইতেই কী মধুর স্বপ্ন রচনা করিয়াছি। তোমার সৌন্দর্য, তোমার মাধুরী তোমার রক্ত ওষ্ঠের মৃদু কম্পন, প্রতি প্রভাতে নূতন মোহ সৃষ্টি করে! সকল বেদনা, সকল দুঃখ ভূলিয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া বলি ‘প্রভু! মানুষকে তুমি কী মহাদান দিয়াছ। সমস্ত সংসার ভুলিতে পারি, কিন্তু সৌদামিনীকে ভুলিতে পারি না। তুমি আমার জীবনের শক্তি, ধর্মে তুমি আমার ভক্তি, বিচারকার্যে তুমি আমার বৃদ্ধি, আমি তোমার কাছে শত রকমে ঋণী, তুমি আমার মহারানী।
সোদামিনী কহিলেন–প্রিয়তম, আমি তোমার দাসী। আমাকে অত প্রশংসা করিয়া লজ্জিত করছ কেন?
নিকটস্থ পাথরের বেদীর উপর বসিয়া শ্যামাচরণ সৌদামিনীর হাত ধরিয়া কহিলেন–বেশ, তুমি দাসী, আর আমি দাসীর দাস।
সৌদামিনী কহিলেন–তোমার সহিত কথায় পিরবার যো নাই। এই বলিয়া তিনি শ্যামাচাণের মুখে এক চুম্বন দান করিলেন।
স্বামী-স্ত্রী অতঃপর অনেক কথা হইল।
অবশেষে শ্যামাচরণ কহিলেন–ছুটি ফুরাইয়া গিয়াছে। সোমবারেই রওনা হওয়া আবশ্যক। আমি ময়মনসিংহে বদলি হইয়াছি। সুতরাং গোয়ালন্দ দিয়া যাইতে হইবে।
.
পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ
পাঠককে এইবার জাপানে যাইতে হইবে।
বেনা তাহার স্বামীর জীর্ণ দেহখানির উপর হাত রাখিয়া কহিল–প্রিয় লেমান, তোমার চিকিৎসায় তো সর্বস্বান্ত হইয়া গিয়াছি, হাতে তো আর কিছুই নাই। ছেলেগুলি তো রাত্রিতে কিছু খায় নাই। যদি প্রাণ দিয়ে তোমাকে রক্ষা করিতে পারিতাম তাহাতেও আমার আপত্তি ছিল না। তোমার রক্তশূন্য মুখ আর আমি দেখিতে পারি না। ছেলেগুলিকে কেমন করিয়া বাচাই। এ মাসের বেতন দশ ফ্রাঙ্ক আগেই নেওয়া হয়ে গিয়েছে। মিস্ ফিনিকে আবার কী বলা যায়।
লেমান কী হল সাবিত্রী প্রতিম বধূর স্বাস্থ্যের রক্ত-ভরা চিবুকে হাত দিয়ে কহিল প্রিয়তমে, ভগবান যদি আমার মরণ দিতেন তাহা হইলে অধিক সুখী হইতাম। আর তোমাকে কষ্ট দিতে পারি না। তোমার এই বয়স এই সৌন্দর্য আমার স্পর্শে থাকিয়া অকালে শুকাইয়া যাইবে। আমি নরাধাম, তোমার জীবনকে বিষময় করিয়া তুলিয়াছি। ভগবান। আমাকে ক্ষমা কর।
বেনা স্বামীর পা ধরিয়া কহিল–আমার প্রাণাধিক! অমন কথা মুখে আনিও না। আমি কি কুলটা রমনী! জাপানী রমণী অনায়াসে স্বামীর জন্য প্রাণ দিতে পারে, তথাচ সে প্রলোভনে মুগ্ধ হইবার পাত্রী নহে। প্রিয়-লেমান, তুমি সারা জীব এই অবস্থায় বাঁচিয়া থাকে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার সেবা করিব।
লেমান কহিল–দেবতার কাছে প্রার্থনা করি, পরজন্মে তুমি মহারানী হয়ে জন্ম গ্রহণ করো।
বেনা কহিল-প্রিয় লেমান, পরজন্মে আমি যদি মহারানী হই, তবে দেবতা যেন তোমাকে রাজা করেন। পরজন্মে ইহা অপেক্ষাও যদি কষ্টের জীবন হয়, তবে যেন তোমাকেই স্বামীরূপে পাই। আমি অর্থ চাহি না; সম্পদ চাহি না, সম্মান চাহি না, চাই তোমাকে।
মিস্ ফিনির পিতা টকিও শহরের একজন সম্রান্ত ব্যক্তি। তাহারই বাড়ির অদূরে এক দরিদ্র দম্পতির মধ্যে উল্লিখিত রকমের কথা হইতেছিল।
লেমান অতি দরিদ্রের সন্তান। যুবক বয়সে কুমারী বেনার ভালবাসা লাভ করিয়াছিল। শহরের এক গলিতে এই দরিদ্র দম্পতি বিবাহের পর মর্তেস্বর্গ রচনা করিয়াছিল। সে আজ দশ বছরের কথা।
আজ দুই বৎসর হইল লেমান কাল যক্ষ্মা-ব্যাধির কবলে পড়িয়া তলে তিলে ধ্বংসের পথে চলিয়াছে।
লেমান সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া যাহা পাইত তাহাতে তাহাদের বেশ চলিত মাসে। শেষে হাতে দুই দশ ফ্রাঙ্ক জমিতেও ছিল। তাদের কোনো কষ্ট ছিল না।
কয়েক বছরের মধ্যে তিনটি ছেলে-মেয়ে হয়েছিল, তথাচ অনটন হয় নাই। বড় ছেলেটি তার বাপের ইট টানায় সাহায্য করিয়া সামান্য দুই এক পয়সা উপায় করিতে পারিত। দুই বছর হইতে লেমান ব্যাধির যন্ত্রণায় কোনো কাজ করিতে পারে না। ঘরে যা কিছু ছিল সব শেষ হইয়া গিয়াছে।
দারুণ সাংসারিক কষ্টে বেনা মিস্ ফিনির সহচরী হইয়াছিল। কাজ,–স্নানের সময় ফিনির গা পরিস্কার করিয়া দেওয়া, চুল বাঁধিয়া দেওয়া, কাপড় পরায় সাহায্য করা, মুখে পমেটাম লাগান, জুতা পরিস্কার করা, স্নানের সময় কাপড় ধরিয়া রাখা ইত্যাদি। বেনার মাসিক বেতন ১০ ফ্রাঙ্ক।
জুলাই মাসেরবেতন ১০ ফ্রাঙ্ক জুন মাসেই সে লইয়া ডাক্তারকে দিয়াছে। কিন্তু ব্যাধির উপশম হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। ছেলেরা কি খাইবে, কিছু নাই।
লেমান বেনার হাত ধরিয়া কহিল–প্রিয়তমে, তুমি আর কি করিবে? ছেলেপিলের ক্ষুধার যন্ত্রণা তো আর দেখা যায় না। বড় ছেলে একখানা রিক গাড়ি টানিবার উপযোগী হয় নাই, তা হলে সে তো কিছু কিছু উপায় করিতে পারিত!