হিন্দুদের এ জঘন্য বাধ্যতামূলবক বৈধব্য ব্রত সে সামান্য অজ্ঞান লোক হইয়াও ঘৃণা না করিয়া থাকিতে পারিত না।
.
চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
কাটিহারের মুনসেফ শ্যামাচরণ মিত্রের নাম সকলেই জানেন। তখন পূজার সময় তিনি বাড়ি আসিয়াছিলেন। বিজয়ার পরদিন তার বড় ছেলে হরিচরণ বসন্ত রোগে প্রাণ ত্যাগ করিল। হরিচরণ ওকালতী পাস করিয়া বাড়িতে ছিলেন। দুই এক মাসের মধ্যেই তিনি বহরমপুরে কাজে যোগ দিবেন, এইরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছিল। কিন্তু হায়, বিধাতার ইচ্ছা অন্যরূপ! কে বুঝিয়াছিল বিজয়ার দিন যেদিন বঙ্গের সর্বত্র হিন্দুর ঘরে আনন্দ-কোলাহল শ্যামাচরণের ঘরে এমন বজ্রাঘাত হইবে।
মুনসেফ বাবুর স্ত্রী সৌদামিনী শ্রেষ্ঠা সুন্দরী, বয়স পঁয়ত্রিশ হইলেও অতীব সৌন্দর্য তাঁহার মধ্যে যথেষ্ট ছিল।
বিবাহের অনেক দিন পরে হরিচরণের জন্ম হয়। সৌদামিনী প্রাণ অপেক্ষা তাঁহার একমাত্র পুত্রকে স্নেহ করিতেন।
গ্রামের মধ্যে সাধ্বী ধার্মিকা রমণী বলিয়া তাহার নাম ছিল। নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু মুসলমান তাঁহাকে মা বলিয়া ডাকিত। সৌদামিনীর নিন্দা কোনো মুসলমান কৃষক শুনিতে পারিত না। গ্রামে যদি কাহারো কোনো অসুখ হইত সৌদামিনী তাহার ঔষধ-পত্রের ব্যবস্থা নিজেই করিতেন। নিজ ব্যয় তিনি পাল্কিতে চড়িয়া রোগীকে দেখিয়া আসিতেন!
হারান শেখের ছেলে পড়িতে পারে না। হারনি শেখ আলির বাবুদের বাড়িতে সৌদামিনীকে ধরিল, অমনি তাহার পুত্রের পড়ার ব্যবস্থা হইয়া গেল।
নিতাই ঠাকুর তাঁর মেয়েকে নিয়ে ভারি বিপদে পড়িয়াছেন। বিবাহের ভার নিলেন সৌদামিনী যত খরচ সব তার!
এ হেন ধার্মিক রমণী সৌদামিনীর মাথায় এই সময় এমন বজ্রাঘাত হইল! মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক।
কেঁদে কেঁদে তিনি কয়দিন একেবারে অনাহারে ছিলেন। তার পর বহু চেষ্টার পর বহু অনুরোধের পর জল স্পর্শ করেন। এই সাংঘাতিক বিপদ শুধু তাহাকেই কাঁদায় নাই, যে শুনিয়াছিল সেই কাঁদিয়াছিল। আহা, সতীর কপালে এই ছিল।
মুনসেফ হরিচরণ ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া হিন্দু। পাশ্চাত্য শিক্ষাকে তিনি নিতান্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। মুসলমানদের প্রতি স্ত্রীর অন্যায় টান দেখিয়া তিনি হাড়ে হাড়ে চটিতেন। কতবার তিনি স্ত্রীকে নিষেধ করিয়াছিলেন, কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। ভিতরে তার কি ছিল তা কেউ জানে না। বাহিরে তিনি মুসলমানের ছায়া মাড়িয়ে স্নান করিতে দ্বিধা বোধ করিতেন না। একটা গ্রামের ছেলে একদিন তাহাকে মুরগির মাংস খাইতে দেখিয়াছিল–এই কথা সে বন্ধু মহলে একদিন প্রচার করে। তাঁর পিতা এই কথা শুনিয়া একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলিয়া উঠেন। এত বড় একটা ধার্মিক লোকের বিরুদ্ধে এই পৈশাচিক অপবাদ শুনিয়া, পিতা পুত্রের মাথায় পায়ের খরম দিয়া এরূপ ভীষণ আঘাত করেন যে তার মাথা কাটিয়া যায়। ফলে বেচারাকে ছয় মাস হাসপাতালে থাকিতে হইয়াছিল।
মুনসেফ বসিয়া তামাক খাইতেছেন, এমন সময় গ্রামেরএকজন মুসলমান ভদ্রলোক তাহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়া ফরাসে বসিয়া পড়িলেন। অমনি সুসেফ বাবু ‘রাম রামবলিয়া হুঁকো ফেলিয়া দিলেন। ভদ্রলোক লজ্জিত ও মর্মাহত হইয়া বলিলেন, বাবু তা হলে আসি,আপনার খাবার বেলা হয়েছে, দেরি করলে অসুখ হতে পারে।
মুনসেফ বাবু বুড়ো ভদ্রলোকের অসঙ্কোচে নাম ধরিয়া বলিলেন–“আচ্ছা, তা হলে এসো।”
রাতদিন তিনি সৌদিমিনীর কাছে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা করিতেন। ইদানীং তিনি স্ত্রীর হাতে খাওয়া পর্যন্ত ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। অফিস হতে আসিয়াই একবার তিনি স্নান করিয়া শুচি হইতেন।
স্ত্রীর হাতে না খেলেও তিনি সৌদামিনীর জন্য পাগল ছিলেন। সৌদামিনীর নিজের পক্ষে নানা বিরক্তির কারণ থাকিলেও স্বামীর ভালবাসায় তিনি সব কথা ভুলে যেতেন। প্রতিদিন মুনসেফ বাবু পূজার পর টিকিতে ফুল বাঁধিয়া তাড়াতাড়ি স্ত্রীর ঘরে আসিয়া কৃষ্ণ ঠাকুরের মতো সৌদামিনীর পায়ের কাছে গড়াইয়া পড়িতেন! সৌদিমিনী লাফাইয়া উঠিয়া বলিতেন, একি?–এ কি? আমার যে নরকেও স্থান হবে না।
ধার্মিক শ্যামাচরণ বলিতেন–তুমি দুর্গা! আমি তোমার মধ্যে জগদ্ধাত্রীর রূপ দেখতে পাচ্ছি। তোমাকে আমি মা বলে পূজা করবো!
এমনভাবে তাঁহাদের জীবন কাটিতেছিল, হঠাৎ একদিন তাঁহাদের একমাত্র পুত্র। হরিচরণ মৃত্যুমুখে পতিত হইল।
শোকে শ্যামাচরণ ও সৌদামিনী একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িলেন। শ্যামাচরণ ছয় মাসের ছুটি লইলেন।
শোক প্রশমিত করিবার জন্য শ্যামাচরণের স্ত্রী তীর্থভ্রমণে গমন করিলেন। উভয়েরই ইচ্ছা কিছুকাল কাশীতে বাস করিয়া শ্রীক্ষেত্র হইয়ো বাড়ি ফিরেন।
ছয়মাস অতীত হইয়া গিয়াছে। পুত্রশোক অনেকটা প্রশমিত হইয়াছে। বিশেষ করিয়া ভগবান আবার তাদের প্রতি কৃপা প্রকাশ করিয়াছেন। সৌদামিনী বহু বৎসর পরে আবার অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন।
সংসার আবার শত সুষমা লইয়া তাঁহাদের সম্মুখে প্রতিভাত হইতেছিল। ফুলের গন্ধ আবার ফরিয়া আসিয়াছিল জোছনার আলো আবার তাঁহাদের কাছে মধুর হইয়া উঠিয়াছিল।
একদিন জোছনার আলোয় জগৎ অভিনব সাজে সজ্জিত হইয়াছে। বাড়ির সম্মুখে নানাবিধ কুসুম ফুটিয়াছিল। নীল লতা আর ছোট ছোট ফুলের গাছ সেদিন শ্যামাচরণের বহিবাটীখানিকে একখানি নন্দপুরী করিয়া তুলিয়াছিল। এমন সময় শ্যামাচরণ তাহার স্ত্রীকে লইয়া সেখানে উপনীত হইলেন।