জানি না, কি কারণে ঘুমে চোখ ভেঙ্গে এল। আমি সেই স্থানে অবিলম্বে ঘুমিয়ে পড়লাম। তার পর প্রগাঢ় গভীর নিদ্রা। দেখতে পেলাম একটা বিরাট মাঠ, সেই মাঠের মাঝে তুমি দাঁড়ায়ে আছ। আমার মেয়ে তোমার বুকের উপর মাথা রেখে হাসছে।
আবু চমকিত হইয়া লাফাইয়া উঠিল বিস্মিত বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি!
রমণী কহিলো–হ্যাঁ তুমি! যখন ঘুম ভেঙ্গে গেল তখন স্বর্ণকিরণ পাহাড়ের উপর একটা অপূর্ব মহিমা ছড়িয়ে দিয়েছিলো।
প্রভাতে ফকির হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মেয়ের সন্ধান পেয়েছে?”
আমি কহিলাম, হ্যাঁ, পেয়েছি ঠাকুর। ফকির বললেন, “তবে আর দেরি করো না। যাও, ঐ যুবকই তোমার মেয়ের জীবন-স্বামী।”
আমি আর দেরি করলাম না। ফকিরকে নমস্কার করে যাত্রা করলাম।
আজ পাঁচ বছর ভারতের সব নগর ঘুরেছি–কোথাও তোমার সন্ধান পাই নাই। আজ বৈকাল বেলা হাওড়ার স্টেশনে আমি ঘুরছিলাম। তোমাকে দেখতে পেয়ে আমার সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে উঠেছিল। সমস্ত পৃথিবীটা আমার চোখের সামনে ঘুরে উঠলো।চলন্ত গাড়িতে আমি অনায়াসে লাফিয়ে উঠতে পেরেছি। এখন বল, আমার মেয়ে কোথায়?
আবু অত্যন্ত বিনীত হয়ে বললেন, “আমি যে সে যুবক তা কী করে জানলেন”
রমণী কহিলেন, “আমি নিজের চোখে তোমাকে দেখেছি। বল আমার মেয়ে কোথায়? একটি বার তাকে দেখতে চাই। সেই সোনার প্রতিমাকে একবার শুধু দেখতে চাই।”
আবু কহিলেন–“আপনার স্বপ্নের সহিত সত্যের কোনো সম্বন্ধ নাই। যদি আপনার মেয়ের কোনো সন্ধান জানতাম ত্ম হলে আমি স্বেচ্ছায় আপনার খোঁজ নিয়ে নিজকে কৃতার্থ করতাম আপনার দুঃখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে”।
রমণী উত্তেজিত হইয়া করিলেন, “তুমি আমার কন্যার জীবন-স্বামী। তুমি স্বামী হয়ে স্ত্রীর খবর জান না! বল–আমার মেয়ে কোথায়?
আবু আবার বলিলেন–“আমার এখনও বিবাহ হয় নাই। তা ছাড়া আপনি হিন্দু। আপনার কন্যার সহিত আমার বিবাহ অসম্ভব কথা!”
রমণী বলিলেন–“তুমি বলতে চাও–তুমি মুসলমান, হিন্দুর মেয়েকে বিবাহ করলে তোমার জাতি যায়?”
আবু বলিলেন, “তাহা বলিতেছি না। শুধু প্রথা নাই।”
“কীসের প্রথা? যেখানে মনুষ্যত্ব আছে সেখানেই আত্মাকে বিক্রয় করা যায়। হিন্দু এক ছাড়া দুই ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে না। বাঙালি হিন্দু গ্রিকের মতো অন্ধ পৌত্তলিক নহে, ইহারা খাঁটি মুসলমান। ইহারা মোহাম্মদের মহা-মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করে না। বল আমার মেয়ে কোথায়?”
আবু আবার বিনীতভাবে কহিলেন, “সত্য করিয়া বলিতেছি, আপনার মেয়ের সংবাদ আমি। বিন্দুবিসর্গ জানি না। আমি এমন নরপিশাচ নহি। আপনার মাতৃহৃদয়ের দুঃখ আমি পুরাপুরি অনুভব করছি, সত্যি করে বলছি আমি কিছু জানি না।”
রমণী হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল–“মিথ্যা! সংসারকে বিশ্বাস নাই–এখানে কেবল অধর্ম ও পাপ।”
মুহূর্তের মধ্যে বাধা দিবার অনেক পূর্বে রমণী চলন্ত ট্রেন হইতে অন্ধাকরে মাঠের মধ্যে লাফাইয়া পড়িল।
.
এয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
কানাই নগরের নিমু শেখ কতকাল হতে যে জিরা, গোলমরিচ, কেরোসিন তেল, লাল সুতা পুতুল, মেয়েদের মাথার কাঁটা বেচে বেড়ায় তার ঠিকানা নাই। সরলা, আমলা, যুঁই নিহার, লতা, নাসিফা, জামিলা খাতুন বাল্যকালে আধা-বয়সী-নিমু অর্থাৎ নৈমুদ্দীনকে গ্রামকে গ্রামে মাথায় পসরা নিয়ে ঘুরতে দেখেছে। তাদের প্রত্যেকের কত দূরে দূরে বিয়ে হয়েছে, কারো। বা দুই চারিটি ছেলে আজুও তারা দেখে সেই আধা-বয়সী নিমু তাদের শ্বশুরবাড়ির কাছ দিয়েও চিৎকার করে বলে–“চাই জিরে, গোলমরিচ? চাই মাথার কাঁটা?”
কেউ তাকে দেখে লজ্জা করে না। যারা তার সামনে নেংটা শিশু হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তারা আজ পাঁচ ছেলের মা হলেও নৈমুদ্দীনকে দেখে লজ্জা করে না। মেয়েদের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি-সবখানেই নিমুর জন্য অন্দরমহল অবারিত দ্বার। শিবু দাসের বউ তার বিধবা কন্যা রমার খবর দুই ক্রোশ দূর হতে নিমুর দ্বারা সংগ্রহ করে। সেদিন রমার ভাসুর তাকে লাঠি দিয়ে মেরেছিল। রমা নিমুর কাছে গোপনে সব কথা বলেছে। নৈমুদ্দীন যথা সময়ে সে কথা শিবুর বৌকে বলে তার আঁখিজল ফেলবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
নিহার রামরতন দত্তের মেয়ে ছোট কালে না নিমু শেখকে ঠাকুর দাদা বলে ডাকতে। আজও তেমনি করে নিমুকে সে দেখা পেলেই দাদা বলে আলাপ করে। পাঁচ বছর আগে যখন ঢাকঢোল পিটে ফজরপুরে বাবুদের বড় ছেলে নিহারকে বিয়ে করতে আসে, সেদিন নৈমুদ্দীন নিহারকে নাতনীর প্রাপ্য কত ঠাট্টাই না করেছিল। নিহার তার কথা শুনে হেসে খুন হয়েছিল।
আর আজকাল যখন আগুনের ডালি বিধবা নিহার নিমু শেখের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, তখন নিমু শেখের মুখে কথা সরে না। রহস্য সে ভুলে যায়। অতি কষ্টে সে আঁখিজল সংবরণ করে। বিবাহের এক মাস পরেই নিহার বিধবা হয়ে ভায়েদের ও ভ্রাতৃবধূরে কৃপার পাত্র হয়ে বাড়ি ফিরে ছিলো।
রমার মা বার্তাবাহক নিমুকে দিয়ে শুক্রবার মেয়ের কাছে খবর পাঠিয়েছিলো, শ্বশুরবাড়িতে আর তাকে অত লাথি খেয়ে থাকতে হবে না। শনিবারেই তার মা তাকে নিয়ে আসবে।
নৈমুদ্দীন যেখানেই যাক, যেখানেই থাক, সে এই দুটি মেয়ের কথা ভুলতে পারত না যত রাতেই সে শুতে যাক, শোবার আগে সে একবার ভাবতো–আহা, এই দুটি মেয়ের কেউ নেই! নৈমুদ্দীনের চোখ জলে ভরে উঠতো। সে ভেবে উঠতে পারতো না কেমন করে সে এদের দুঃখ কষ্ট দূর করতে পারে? সে যে বড় দরিদ্র, তা ছাড়া উপার তো কিছু ছিল