আমরা ক্রমে ক্রমে জনতা ঠেলে সরে এলাম। জনতা পার হয়ে একটু দূরে এলে আলতার মা আমার হাত ধরে বললে—’দিদি, তুই সব বিপদের মূল। তুই যদি আমাদের গ্রামে না আসতিস, তোকে যদি বড়িতে স্থান না দিতাম তাহলে আজ আমাদের গ্রাম উজার হতো না।’
কি জানি কেন–মন দুঃখে ভরে গেল। মাথাটা যেন কেমন হয়ে উঠলো।
.
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
”বাড়িতে ক্রমেই ভয়ানক জ্বর আরম্ভ হল। আলতার মা ক্রমশ আমার উপর কী কারণে জানি না বিরক্ত হয়ে উঠলো! আমাকে দেখলেই সে যেন শিউরে উঠতো! আলতা যদি মা মা বলে আমার কাছে আসতো তার আপন মা জোর করে আমার কাছ থেকে টেনে নিয়ে যেত।
সংসারের বিচিত্রতা দেখে মন ও মাথা দুই-ই আবার খারপ হয়ে উঠলো। ভাবলাম, জ্বরটা একটু কম পড়লেই এস্থান থেকে পালাবো। কিন্তু আলতার কথা ভেবে মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। কতকালের সেই হারান স্মৃতি আগুনের মতো মনের মধ্যে জ্বলে উঠলো। ভাবলাম কোথায়, আমার মেয়ে কোথা? সে কার ঘরে এখন? সে কি জানে তার মা কে? হায়রে কপাল? আমার বুকের ধন যে চুরি রে নিলে? কে আমাকে এমন করে ভিখারিনী করলে? ভগবান, তুমি কি আছ। তোমার কাজ নাকি মঙ্গলময়। আমার বুকের আগুন জ্বেলে তুমি তোমার কি মহান উদ্দেশ্য করছ। সে কার মাকে মা বলে মনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছে।
এর পর দুদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। তৃতীয় দিনে জ্বরটা ছেড়ে গেল। রাত্রি যখন দ্বিপ্রহর তখন আকাশে মেঘ উঠেছিলা। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল একটু একটু বৃষ্টি আরম্ভ হল! সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বাতাস দেখা দিল। আমি ভগবানকে স্মরণ করে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লাম। সেই বৃষ্টি ঝড়ের ভিতর অতি-ভীত মনে আমি অগ্রসর হচ্ছিলাম। সমস্ত রাত্রি হেঁটে হেঁটে কাটিয়ে দিলাম। সকাল বেলা এক রেলস্টেশনে এসে উপস্থিত হলাম। ১০ টা টাকা সঙ্গে ছিল, কলকাতার টিকিট করলাম। রাত্রি বারটার সময় কলকাতয় এলাম। পর দিন সকাল বেলা হাওড়ার রেল পথ ধরে অগ্রসর হতে আরম্ভ করলাম। প্রায় তিন মাস হেঁটে আমি নাগপুরে যাই। শুনেছিলাম বিন্ধ্যপর্বতে অনেক সিদ্ধ সাধু-সন্নাসী থাকেন। এবারে আমি তাদের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। শুনেছিলাম, সিদ্ধ পুরুষেরা সব বলতে পারেন। নাগপুর হতে আর তিন মাস হেঁটে আমি বিন্ধ্যপর্বতে উপস্থিত হই। আর্যাবর্তের দক্ষিণ সীমায় বিন্ধ্যাচল। কী বিরাট পাহাড় বিন্ধ্যাচল! সমস্ত বিশ্ব ছেড়ে জনমানবশূন্য হিংস্র জন্তু সমাকীর্ণ পাহাড়ের মধ্যে একেবারে চলোম। যখন দূর হতে বিন্ধ্যপাদদেশ অবলোকন করলাম তখন সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। প্রাণ এক অনির্বচনীয়ভাবে ভরে উঠলো। প্রাণে ভয় ছিল না, সুতরাং একটা বিরাট শান্তি যে আমার মধ্যে দেখা দিবে তদ্বিষয়ে সন্দেহ কি! পশ্চিম গগনের হৈমকর এসে পাহাড়ের মাথায় প্রভাত হচ্ছিল। যখন পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হলাম, তখন দেখতে পেলাম একটা স্রোতম্বিনী পাহাড়ের বুক ভেঙ্গে বের হচ্ছে। দুই পার্শ্বে কী ভীষণ জঙ্গল? বড় বড় গাছ আকাশকে চুম্বন করবার জন্য মুখ বাড়িয়ে আছে। দেখতে পেলাম হাজার হাজর বানর। হঠাৎ পিছন থেকে কি যেন একটা অদ্ভুত জীব ভীষণ চীৎকার করে উঠলো একটা বিকট ভয়ানক আনন্দে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। নিস্তব্ধ বনভূমি কাপিয়ে আমার হাসি হো হো করে হেসে উঠলো। ইচ্ছা হল সমস্ত পাহাড়ের উপর উড়ে উড়ে বেড়াই! বিরাট গভীর নিস্তব্ধ দেশের মহারানী হই। শৈলের উপর শৈল সমুদ্রের তীরের মতো তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল এই বিশাল মাটির তরঙ্গের শীর্ষ হতে এক লম্ফে শূন্যকে উপহাস করে গভীর নিম্নভূমিতে লাফিয়ে পড়ি। কী বিরাট দৃশ্য! কী ভয়ানক!
সন্ধ্যার অন্ধকারের সঙ্গে পাহাড় আরও গম্ভীর ভাবময় হয়ে উঠলো। মনে হল সংসারে আমি একা। এ সংসারে আর কেউ নাই। ভগবানের বিশাল ভীমরূপ আমার সম্মুখ। আমার অস্তিত্ব বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল। মনে হল বুকখানি কেটে ফেলি। আত্মা আমার মুক্ত হোক। আকাশে-বাতাসে ব্যোম-সমুদ্রে, উর্ধ্ব হইতে নিম্নে, নিম্ন হইতে উর্ধ্বে জোছনার অর্ধ আলোতে খেলে বেড়াই। ভেঙ্গে ফেলি দেহের কারাগার। মনে হল মৃগের সঙ্গে খেলে বেড়াই। নীল লতা-পাতা দিয়ে শয্যা রচনা করি। হিংস্র শার্দূল ভল্লুকের মুখে ননী তুলে দি।তারা আমার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ুক। মনে হল জরা মৃত্যু দূর হোক। মানুষ কামনা বাসনা হতে মুক্ত হোক। সমস্ত বিশ্বসংসারটা পাহাড় হয়ে উঠুক। মানুষ স্বভাবের শিশু হয়ে লতাপাতার সঙ্গে মিশে থাকে। বিশ্বের সমস্ত গ্রন্থ সাগরে ডুবে যাক; শুধু তিনটি কথা বেঁচে থাক–ঈশ্বর; ন্যায় ও সত্য। সকল উপাসনা, সকল ধর্ম উঠে যাক, শুধু থাকুক ঈশ্বর ন্যায় ও সত্য।
সেই স্রোতস্বিনী-উপকূলে সমস্ত রাত্রি পঁড়িয়ে কেটে গেলো। তার পর অনবরত সাতদিন আমি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরি। বনের ফল খেতাম ও ঝরনার জল পান করতাম। সাতদিন পর আমার মনস্কামনা সিদ্ধ হল। একস্থানে দেখলাম একজন ফকির চোখ বুজে পশ্চিম দিকে মাথা নিচু করে পড়ে আছেন। হরি হরি! সে কী অপূর্ব মূর্তি! সমস্ত বনভূমি যেন আলোকিত হয়ে উঠেছিলো।
তিনদিন আমার এই ফকিরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে কেটে গেল। চতুর্থ দিনে ফকির আমার দিকে ফিরে চাইলেন। আমি দুই হাত দিয়ে তাকে নমস্কার করলাম। ফকির কোনো কথা জিজ্ঞাসা না করেই বললেন–“কি বেটী! মেয়ে খুঁজতে এসেছি। ওখানে শুয়ে থাক মেয়ের সন্ধান পাবি।”