তারপর বিচার হল। দারোগা বাবু বললেন, ‘আলতার মার বাড়িতে উপস্থিত হতেই ধীবরেরা এসে আমাকে আক্রমণ করলে। আমরা আসামিদিগকে নিরস্ত করতে যেয়ে অনুনয় করে বললাম–আমরা কারও ক্ষতি করতে আসি নি। তারা কিন্তু বিশ্বাস করলে না। বললে, যে গ্রামে দারোগা আসে সে গ্রামের সবার ভাগ্যেই জেল থাকে, বিশেষ করে এটা যখন খুনি ব্যাপারে তখন সবাইকে কালাপানিতে যেতে হবে। আমরা অনুচরেরা। আমার সঙ্গে সঙ্গে প্রহৃত হল। গভর্ণমেন্টের কাজে বাধা পেয়ে আমরা পুলিশ সাহেবকে সব কথা জানালাম, ফলে বহুসংখ্যক অস্ত্রধারী সিপাই নিয়ে পরের দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত। হই। ভীষণ দাঙ্গা হল। সরকারকে গ্রাহ্য করা দূরে থাক, তারা সরকারকে মানি না বলে নিশান উড়িয়ে দিলো। পুলিশ সাহেব তাদেরকে ধরতে গিয়েছিলেন! তিনি সাংঘাতিকরূপে। আহত হয়ে ফিরে আসেন, একথা কোর্ট জানেন। বহু কষ্টে এই ষোল জনকে ধরা হয়েছে। মাদারিপুরের ঘাটে, সুন্দরবনে, কাশীর মালোপাড়ায়, কলিকাতায় ক্ষুদিরামের হোটেলে যে কয়েকজন ধরা গিয়াছে তারাই আসল আসামি। চারিজনের আইনমতে ফাঁসি হওয়া উচিত, বাকি ১২ জনের নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হউক। পরিশেষে ইহাও আমার বক্তব্য যে, এই আসামি স্ত্রীলোক দুটি রাজকর্মচারীকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। আসামি হলেও তারা সরকারের নিকটে যথেষ্ট পুরস্কার দাবি করতে পারে।
দারোগার উক্তি শুনিয়া আলতার মা এতক্ষণে চোখ মুছিয়া ফেলিল। আমার মনে কোনো প্রকার ভাব উপস্থিত হয়েছিল না, শুধু বিচিত্র ব্যাপার দেখছিলাম সরকারি উকিল দাঁড়িয়ে একই কথা বললেন। দারোগার কথা সমর্থন করতে গিয়ে তিনি বললেন, এই স্ত্রীলোক দুটির শুধু মুক্তি দেওয়া উচিত নহে, ইহারা যেমন বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, তাতে এদের সরকার হতে যথেষ্ট পুরস্কার দেওয়া আবশ্যক। সতী রমণীর মর্যাদা আইনেরও উপরে। তাহাদের সম্মান রাজদরবারে অধিক রক্ষিত হওয়া আবশ্যক। আমাদের কোনো উকিল ছিল না। যা বলতে হবে তা নিজেই আমি বলবো স্থির করেছিলাম। অন্য আসামিদের বড় বড় উকিল উঠে বললেন;
দারোগা যা বললেন তা সবই মিথ্যা। সাক্ষাতে সে সব প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। দারোগা প্রথমেই হারাণ মাঝির বাড়িতে যেয়ে তার সধবা মেয়েকে বিনা কারণে ললেন, ‘তুমি এই মোকদ্দমা কিছু জান?’ নিমু নারায়ণ ও রামচরণ তার প্রমাণ দিয়েছে। হারাণের মেয়ে যখন কেঁদে বললে যে, সে কিছু জানে না, দারোগা বাবু তখন ক্রোধান্ধ হয়ে তার সিপাইদের হুকুম দিলেন এই মাগীকে ধর। সিপাইরা মুক্তস্থানে তাকে অর্ধ-উলঙ্গ করে অপদস্থ করে। বৃদ্ধ বাপ এই শোচনীয় দৃশ্য দেখে দারোগার কাছে করুণা ভিক্ষা করে। দারোগা তাকে এমন প্রচণ্ড আঘাত করেছিলো যে, সেই আক্রমণ করতে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়; অথচ দারোগা বাবু সাক্ষী বলে গেল–এই বৃদ্ধই পুলিশ সাহেবকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল। পুলিশ সাহেবকে রক্ষা করতে যেয়ে এক সিপাই এর মাথায় আঘাত করে এবং তার ফলেই সে মারা গেছে। ধীবরদের রক্ত-মাংসের শরীর। তাদের উপর এত অত্যাচার করলে এমন অঘটন যে সংঘটিত হবে তা দারোগা বাবুর মতো বিচক্ষণ রাজকর্মচারীর জানা উচিত ছিলো। আসীম আলতার মা আর তার বোনের বাড়িতে না এসো, দারোগাবাবু প্রথমেই হারাণ,মাঝির বাড়িতে গিয়েছিলেন, এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। এই দারোগাবাবু কার্য হতে জানা যায়, তিনি সরকারি কার্য করতে একেবারে অপারগ। তিনি প্রজার মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু কার্যত এই অনাসৃষ্টির কারণ একমাত্র তিনি। গভর্ণমেন্টের কর্তব্য এখন এই ব্যক্তিকে কার্য হতে অবসর দেওয়া।
দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অভিযুক্ত হওয়া স্ত্রীলোক দুইটির এবং দারোগার। শাস্তি হওয়া আবশ্যক। স্ত্রী আসামিদ্বয়ের যে চরিত্র ভালো একথা আমরা বিশ্বাস করিতে পারি না। সাক্ষীরা বলেছে দারোগার সহিত আলতার মার অবৈধ প্রণয় ছিল। সকল দাঙ্গার কারণ রমেন্দ্রের হত্যা। রমেন্দ্রের সহিত আলতার মায়ের বোনের প্রণয় ছিল। আলতার মা বোনের উপর ঈর্ষাপরবশ হইয়া জমিদার-পুত্র রমেন্দ্রকে হত্যা করেছে।
হাকিম অতঃপর আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন–“তুমি কী জান?’
আমি কহিলাম–দারোগা বাবুর সহিত আমাদের কোনো কালে পরিচয় নাই। তদারকের পূর্বে তিনি অন্য কোনো বাড়িতে গিয়েছিলেন কি না আমি জানি না। রামেরে হত্যা আমার দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য বাধা দিতে গিয়েই এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়! আমার প্রতি দুর্ব্যবহার করায়, আমার বাড়িতেই ধীবরেরা দারোগা বাবুকে আক্রমণ করে।
আর কোনো জেরা মন্তব্যের প্রয়োজন হল না। জজ সাহেব রায় দিলেন। দাঙ্গা অভিযুক্ত ৪ জন মূল আসামির শুক্র বার বেলা ১২-৪ মিনিটের সময় ফাঁসি হইবে। বাকি ১২ জন আসমির ৫০০ টাকা জরিমানা। পরিশেষে জজ সাহেব আমাদের কথা উল্লেখ করে বললেন–এই স্ত্রীলোক দুটির বীরত্বে, সতীত্বে কোট খুব আনন্দ প্রকাশ করিতেছে। তাহারা সত্য কথা বলিয়াছে, উহাদিগকে মুক্তি দেওয়া হউক।
পরে বিচারে দারোগার দুই মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল। রায় প্রকাশ হইবার পরকোর্টের ভিতরে ভিতরে ও বাহিরে হই হই শব্দ আরম্ভ হল। আমরা কাঠগড়া থেকে মুক্ত হয়ে বাহির হয়ে এসে দাঁড়াতেই হাজার হাজার লোক আমাদের চুতুর্দিকে এসে দাঁড়াল।