দুই বন্ধু হাসিয়া কথা কহিতেছিলেন। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথার উপর দুইজন বা তিনজন করিয়া বালক বসিয়া আছেন। ছাত্রেরা নিত্যই এখানে বসিয়া থাকেন। কেহ কেহ বা দুই। প্রাচীরের মধ্যস্থিত ভূমিতে খেলা করেন। যুবক-হৃদয়ে সে কী উল্লাস ও আনন্দ! কেহবা সুপারিন্টেণ্ডেটের ভয়ে চাপা গলায় গান করেন–
“আজ এ নিশিথে
কারে মজাইতে”–ইত্যাদি।
বন্ধু দুইটির বাড়ি নদীয়ায়। যে হুগলীর বোর্ডিং-গৃহের কথা আমরা বলিতেছি এখানে প্রথমে কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুলের ছাত্র একসঙ্গে থাকিত।
একজনের নাম আবু মহম্মদ আবদার রাহমান। তিনি মাদ্রাসার পাঠ শেষ করিয়া ইংরেজি পড়িতেছিলেন। যথাসময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া আই-এ ক্লাশে ভর্তি হইয়াছেন। অন্য যুবকের নাম আহমদ হাছান। ইনি বি-এ ক্লাশে পড়েন। দুইজনের একস্থানে বাড়ি বলিয়া অত্যন্ত বন্ধুত্ব।
সম্প্রতি আহমদ হাছানের পিতা পুত্রের নিকট পত্র লিখিয়াছেন। বন্ধুকে সেই পত্রখানি পড়াইয়া শুনান হইবে। তাহার বিবাহের কথা লেখা, তাই বন্ধুদ্বয়ের মধ্যে এত হাসাহাসি চলিতেছিল। পত্রে লেখা ছিল–
বাবা!
আমরা এখন বুড়ো হয়েছি, এ বয়সে পুত্রবধূর মুখ দেখা সকল বাপ-মায়ের সাধ। বিশেষত, তোমার মা এ বিষয়ে জেদ করিতেছেন, আর তিনি আজমপুরের মৌলবী এমদাদ। আলী সাহেবের কনিষ্ঠা কন্যা পছন্দ করিয়া কথা দিয়াছেন। তোমার আত্মীয়-স্বজন সকলেই মেয়ে দেখিয়া এক বাক্যে বলিতেছেন–মেয়ে রূপেগুণে খুব ভালো, এ কাজ করিতেই হইবে। আশা করি, তোমার অমত হইবে না।
তোমার চিরশুভাকাক্ষী
–পিতা।
আবু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“কেমন, বিবাহের নামে প্রাণটা নাচিয়া উঠিতেছে তো? আশা করি, অতীতে কথা ভুলিয়া যাইবে।”
শেষ কথাটিতে যে গুপ্ত উপহাস ছিল তাহা হাছান বুঝিতে পারিয়া কহিল–“বন্ধু কী করি, বুঝিতে পারি ইহা অত্যন্ত অন্যায়। কিন্তু ইহাতে কি আমার দোষ আছে? যখনই জানালা খুলি তখনই দেখি সেই মেয়েটি আমার দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে।”
আবু বলিলেন–“তুমি সে দিকে না চাহিলেই পার। পাপের পথে যে টানিয়া লইতে চায় তাহাকে মিত্র না ভাবিয়া শত্রু মনে করা উচিত।”
হাছান কহিল–“পাপ তাহা কেমন করিয়া বুঝি? একটি মেয়ে তাহার আত্মার স্বভাবে বৃত্তিবশে একটি যুবকের প্রতি আসক্ত হইতেছে, তাহাতে কি অপরাধ?”
“অপরাধ নাই! সে হিন্দু মেয়ে, সংসারের জটিলতা ও বিপদ সম্বন্ধে সে কিছুমাত্র জানে না। তাহাকে উৎসাহিত করা তোমার কিছু মাত্র কর্তব্য নহে।”
“তোমার আত্মার প্রেমের পার্শ্বটা একেবারে মরিয়া গিয়াছে। আমি তো একজন যুবক। আমারই কামরার পার্শ্বে একটি যুবতী বালিকা নিত্য নির্জনে তাহার কোমল ও দারুণ আকাক্ষাপূর্ণ আঁখি দুইটি আমার দিকে নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে, আর আমি নিশ্চল হইয়া পড়িয়া থাকিব। তোমাকে যদি এই অবস্থায় পড়িতে হইত তাহা হইলে বুঝিতাম কতখানি বীরত্ব। আমার মনে হয় মেয়েটির পিতা জজকোর্টের উকিল। এমন রূপ আমি কখনো দেখি নাই। কী করি ভাই, পড়াশুনা সব মাটি হইল।
“তুমি ঐ কামনা পরিত্যাগ কর।”
“ইচ্ছা করিলেও উহা অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। জানি না, কী প্রকারে তাহার দৃষ্টি আমাকে একেবারে পাগল করিয়াছে। সে অত্যন্ত সরলা, নচেৎ ধীরে ধীরে সে নিজেকে এই কণ্টকময় পথে তুলিয়া ধরিত না। মনে কর যদি, তাহার বাড়ির কেহ জানিতে পারে–তাহাদের মেয়ে বোর্ডিংগৃহের এক যুবকের প্রতি আসক্ত হইয়াছে, তাহা হইলে হয়তো তাহারা তাহাকে জীবন্ত পুড়াইয়া মারিবে।
“তুমি ভালো করিয়া খুলিয়া বল! কেমন করিয়া এই হিন্দু বালিকার সহিত তোমার প্রেম হইল?”
হাছান কহিল–“শোন বলিতেছি। রোজার মাসে একদিন কামরায় আর কেহ ছিল না। আমি জানালা খুলিয়া পাশের বাড়ির দিকে চাহিয়া আছি, এমন সময় সহসা একখানি ঘুড়ি আসিয়া আমাদের জানালায় বাঁধিয়া গেল। দেখিলাম এক কিশোরী ঐ বাড়ির ছাদ হইতে অপর পার্শ্বে জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; সে হাঁপাইতেছিল। বুঝিলাম; সে ছাদের উপর ঘুড়ি উড়াইতেছিল। হঠাৎ সূতা কাটিয়া ঘুড়িখান নিচে পড়িয়া আমারই জানালায় বাঁধিয়া গেল। সে মনে করিয়াছিল তাহাদেরই বাড়ির জানালায় ঘুড়ি পড়িয়াছে। তুমি তো দেখিয়ায় দুই জানালা খুব নিকটে। অপরিচিতা যুবতাঁকে দেখিয়া একটু সঙ্কোচের সহিত জানালা ঠেলিয়া দিলাম। সে অত্যন্ত আশা করিয়াছিল; অনুভবে বুঝিলাম সে উহা ধরিবার জন্য হাত বাড়াইয়া দিল। সে পুনঃপুনঃ হাত বাড়াইয়া দিতেছিল। তাহার নিষ্ফল ব্যর্থ চেষ্টা দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে সে একখানা লাঠি লইয়া আসিল; কিন্তু লাঠিতে কোনো সুবিধা হইল না। আমি একটু দুঃখিত হইতেছিলাম। আমারি হাতের কাছে একটা জিনিস পড়িয়া আছে, যাহার জন্য একটা বালিকা এক ঘণ্টা ধরিয়া বিষম কষ্ট করিয়াও কিছু করিতে পারিতেছে না। মনে ভাবিলাম, এরূপ সঙ্কোচের মূল্য কী? হাত বাড়াইয়া ঘুড়িখানি তুলিয়া দিলে তো আমার জাতি যাইবে না। জানালা খুলিয়া কহিলাম, ‘যদি আপত্তি না থাকে, আমিই ঘুড়িখানি আপনার হাতে দিতেছি।’ বালিকা কৃতজ্ঞতার সহিত মাথা নাড়িল। মৌনতা অবলম্বন করিল।
ঘুড়িখানি লইয়া যখন সে ফিরিয়া গেল, তখন তাহার আঁখির দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলাম। দেখিলাম, তাহাতে যেন কত কৃতজ্ঞতা, কত দুঃখ! শিরায় শিরায় একটা অনির্বচনীয় স্পন্দন অনুভব করিলাম। পরমুহূর্তেই অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত ভাবিলাম, একি! রোজার মাসে রোজা করিয়া মুসলমানের হৃদয়ে পরস্ত্রীর রূপ দেখিয়া চাঞ্চল্য! কী ঘৃণা! কী লজ্জা! তাড়াতাড়ি ওজু করিয়া কোরান পাঠ করিতে বসিলাম। কিন্তু কী বলিব, হৃদয়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বালিকার কৃতজ্ঞতাভরা করুণ দৃষ্টি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল। বিরক্ত হইয়া গঙ্গার ঘাটে আসিলাম। গঙ্গার অনির্বচনীয় শোভা দেখিলাম। সীমাহীন বিস্তারে মন গম্ভীর ও ভাবময় হইয়া উঠিল। তরঙ্গের প্রতি আস্ফালনে দেখিতে পাইলাম বালিকার কৃতজ্ঞতাভরা সে করুণ আঁখির দৃষ্টি। পুনরায় ঈশ্বরকে ডাকিবার জন্য মসজিদে আসিলাম। তোমরা নামাজ পড়িলে, আমি নামাজ না পড়িয়াই এক মনে এক প্রান্তে বসিয়া আল্লাহকে ডাকিতেছিলাম। পরস্ত্রীর রূপ লইয়া আত্মার একি ঢালাঢলি। কী ঘৃণা! কী লজ্জা! ধীরে ধীরে হৃদয়ে শান্তি আসিল। অতঃপর কামরার ফিরিয়া আসিলাম।”