প্রচণ্ড আঘাত ব্যর্থ হল না। রমেন্দ্রের মাথা দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
‘বাপরে মলুম’ বলে অন্য যুবকটি কুকুরের মতো বেগে কাটা পথ দিয়ে পালাল; সঙ্গে সঙ্গে অন্য যুবকটি ভীত হয়ে কে কোথায় কোনো পথ দিয়ে পালিয়ে গেল।
আলতার মা ভয়ে চাপা গলা কেঁদে উঠলো।আমি বললাম–“তুমি ভীত হয়ো না। যত বিপদ সব আমার ঘাড়ে।”
তাড়াতাড়ি আলো জ্বলে দেখলাম রমেন্দ্রনাথ বিচ্ছিন্ন মাথা বেড়ার পাশে পড়ে আছে। কী বিকট চাহনী! সমস্ত ঘর রক্তময়! গায়ে রক্ত লেগে গিয়েছিল। দুইজনে বাহির হয়ে গা ধুয়ে এলাম। আলতার মা কাঁদছিলো।
.
বিংশ পরিচ্ছেদ
সকাল বেলা বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। আমি কিছুমাত্র ভীত না হয়ে বল্লাম–সতীর সর্বনাশ করতে এলে এমনি করে শাস্তি ভোগ করতে হয়। রমেন্দ্রকে আমি খুন করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে চৌকিদার, জমাদার, দারোগা ও রমেন্দ্রের বৃদ্ধ বাপ এসে শান্তভাবে হাজির হল।
আমি সকলের কাছে স্বীকার করলাম আমি খুন করেছি। সকলে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
আলতার মা তখনও কাঁদতেছিল। রমেন্দ্রের বৃদ্ধ পিতা চোখে একটুও জল দেখলাম। ঘৃণায়, লজ্জায় তার মুখ কালি হয়ে গিয়েছিল।
বৃদ্ধ আমার দিকে চেয়ে বললো–’বেশ করেছ মা। আমাদের দেশে এখনও যে এমন বীর রমণী আছে তাতে আমি সুখী হচ্ছি। পুত্র-শোকের দারুণ আঘাতের মধ্যে তোমাকে আমি আশীর্বাদ করছি।’
দারোগা কিন্তু তার শান্তভাব বেশিক্ষণ বজায় রাখল না। সে এবং তার বন্ধু চৌকিদার ও সিপাই আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে আরম্ভ করলে। ক্রোধে আমার সর্বশরীর জ্বলে গেল, মাথা আমার কেমন হয়ে উঠলো। আমি দারোগাকে লক্ষ্য করে বল্লাম-দেখ দারোগা! দুঃখিত ও উৎপীড়িতের সেবার জন্যই তুমি নিযুক্ত হয়েছ। অসৎ উপায়ে অর্থ উপায়ের জন্য তোমার গালি দিবার কোনো ক্ষমতা নাই! দারোগা আমার মুখের উপর লাথি নিয়ে এলো। তার দেশওয়ালী কুকুরগুলো আমাকে পৈশাচিক ভাষায় সম্বোধন করতে আরম্ভ করলো। দারোগাকে কহিলাম–’দারোগা! তোমার মতো নরপিশাচকে সরকার কেন নিযুক্ত করেছেন? সকল কর্মচারী অপেক্ষা তোমাদের অধিক মনুষ্যত্ব আবশ্যক! আর এই কুকুর সিপইগুলিকেই বা সত্য ও ন্যায়ের রক্ষকরূপে কেন নিযুক্ত করা হয়েছে। আমার প্রতি এই দুর্ব্যবহার উপস্থিত নিরীহ ধীবরেরা দেখছিলো। তারা আমার কথায় অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লো।
দারোগা আর সিপাইগুলি তাদেরকে ধমক দিলে। ফলে একজন মোটা সোটা পালোয়ান ধীবর দারোগার মাথার উপর লাফাইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে সিপাইগুলিও আক্রান্ত হল। বাড়িখানা শন্তি ও বিচারের স্থান না হয়ে, মারামরি ও সোরগোলের আড্ডায় পরিণত হলো। দারোগার নাক ভেঙ্গে রক্ত বেরোতে লাগলো। তাড়াতাড়ি একখানা মাদুর পেতে দারোগার মাথায় জল ঢালতে লাগলাম। প্রায় এক ঘণ্টা অতীত হবার পর দারোগা চৌকিদারকে ডেকে ঘোড়া আনতে বললে। ইতোমধ্যে অন্যান্য ধীবরেরা আপন আপন বাড়িতে চলে গিয়েছিল। দারোগা যাবার সময় বললেন, তোমাদের কোনো ভয় নাই, আমি শালাগুলোকে একবার দেখাবো!’ চারজন লোক রমেন্দ্রর শবদেহকে ঘাড়ে করে দারোগার পিছনে পিছনে চললে।
দুদিন পরেই শুনতে পেলাম এক শত সিপাই বন্দুক আর তলোয়ার নিয়ে গ্রাম ঘেরাও করেছে। আলতার মা আবার কাঁদতে আরম্ভ করলো। আমি হাসিয়া কহিলাম–“খুন করলাম আমি। সিপাই এসেছে সেদিন যারা তাদের কাজে বাধা দিয়েছিলো তাহাদের ধরতে। তুমি কাঁদ কেন?”
ধীবরেরা দমিবার পাত্র নয়। তারা বন্দুকের গুলিকে রোধ করবার জন্য কাপড়-কাচা পাট আর কুঠার দা চবক্, কেহ-বা সড়কি নিয়ে সিপাইদের সম্মুখীন হল। তার পর ভীষণ লড়াই বেঁধে গেল। সে ভীষণ লড়াইয়ের কথা কী বলবো! কী ভয়ানক রক্তারক্তি!
ভয়ানক চিৎকার! কী ভীষণ আর্তনাদ! সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই হল। সন্ধ্যার নিবিড় আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে লড়াই থেমে গেল।
সিপাইরা রাত্রির জন্য কোথায় গেল জানি না, পরদিন সকাল বেলা দেখতে পেলাম সমস্ত গ্রামখানি শূন্য। একটা প্রাণী সেখানে নাই। গ্রামের সমস্ত লোক ঘরবাড়ি খালি করে। কোথায় চলে গেছে।
২১-২৫. হাকিমের সম্মুখে হাজির
একবিংশ পরিচ্ছেদ
যথা সময়ে আমাদেরকে হাকিমের সম্মুখে হাজির হতে হল। ষোলজন ধীবর ধরা পড়েছিল। আমি আর আলতার মা খুনের আসামি, আর ধীবরেরা দাঙ্গা-হাঙ্গামার আসামি। যারা ধরা পড়েছিল তাদের অনেককে দু’তিন মাস ধরে সরকারি হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো। গুলিতে কারো মুখ ছিঁড়ে গিয়েছিলো। তলোয়ারের আঘাতে কাহারো হাত ছিল না। মুর্খের দল ডাক্তারকে এক হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়েছিলো। ডাক্তার মুখে বলেছিলো তার রিপোর্টের উপরেই মোকদ্দমা চলবে। মূর্খ ধীবরেরা তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে এক নয়, দুই নয়–হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিলো।
সেদিন জজের কাছারীতে শত শত মানুষ জমেছিলো। আমি আর আলতার মা একটা উকিলও নিযুক্ত করেছিলাম না। কত উকিল এসে বললে, মোকদ্দমা আমার হাতে দাও, খালাস পাবে।
উকিলকে বিশ্বাস করবার কোনো দরকার ছিল না। ভাবলাম খাঁটি সত্য কথা জজের কাছে বলবো–তাতে যা হয় তাই হবে। আলতার মা আর সেই ৬ জন আসামি জোড়হাত হয়ে হাকিমের দিকে চেয়ে কেবলই কাঁদছিলো। ধীবর আসামিদের জন্য কলকাতা থেকে দুইজন উকিল গিয়েছিলো। তাদের ফি দৈনিক ৫০০ টাকা করে। দারোগা, উকিল, সিপাই, চৌকিদার এসে উপস্থিত হলো।