ধীবর বধূ বলিল–আহা তোমার এত দুঃখ! তোমাই এই রূপ, এই বয়স–তোমার মাথায় এমন বিপদ! কী করা যায় বোন? ভগবান আমাদিগকে যেভাবে রাখেন তাই ভালো। তুমি ধীবরের মেয়ে, আমিও ধীবরের মেয়ে। আমার মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নাই। স্বামী আমার বহুদিন মারা গেছে, এই সংসারে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন আমি অতিবাহিত করি। আজ হতে তুমি আমার বোন হও। দুটি দুঃখিনী স্ত্রীলোক একসঙ্গে থাকবো। দু’জনের দুঃখ এক করে সমানভাবে ভাগ করে নেবো, দু’জনের মনই হালকা হয়ে যাবে। চল আজ হতে তুমি আমার বোন। লোকে জিজ্ঞাসা করলে বলবো তুমি আমার কোনো দুরসম্পর্কীয়া বোন।
আমি কহিলাম–’বেশ, আর ঐ সোনার মেয়েটির মা দুজনেই হবো! দুজনেই ওকে মাতৃস্নেহে ভরে ফেলবো।
ধীবর বধু বলিল–আজ হতে ও মেয়ে তোমারই। ভগবানের নাম করে বলছি, আজ হতে ওর মা তুমি।
আমি কহিলাম–“তুমি তো আমাকে বসিয়ে খাওয়াতে পারবে না। কেমন করে জীবিকা নির্বাহ হবে?
‘কেন ধীবরের মেয়ের আবার ভাবনা কী? আমরা তো আর বামন কায়েত বা মুসলমানের মেয়ে নই, যে পেটের দায়ে মরবো। মিথ্যা মানের ভড়ং করে পরদা টানিয়ে পাপ করতে বাধ্য হবো! আমরা ধীবরের মেয়ে, পেটের ভাবনা ভাবতে হবে না। জাল বুনে মাছ ধরে আমরা দশটা লোককে পোষাতে পারি। ভদ্রলোকের বৌ-কি ঘরের কোণে ভাতের জ্বালায় কুকুরের মতো ঝাটা লাথি খেয়ে কেঁদে মরুক। আমরা দুই বোনে জাল বুনবো–মাছ ধরবো, সুখে কাল কাটিয়ে দেবো। তা ছাড়া তুমি দুই দশ দিনকাজ না করলেও কিছু বয়ে যাবে না। আমি এত দুঃখিনী নই। মাথা যেন আমার কেমন হয়ে এসেছিল। পরক্ষণেই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবটা দূর হয়ে গেল। আমি বললাম–যখন খুব ছোট ছিলাম তখনই ঠাকুর দিদির কাছে বসে জাল বুনোনা শিখেছিলাম। বিয়ে হবার পর থেকেই আর কোনো কালে জালে হাত দিই নি। সব বোধহয় ভুলে গেছি। আমাকে জাল বুনোনো শিখিয়ে দিতে হবে। মাছ ধরার কৌশলগুলি আমাকে বলে দিতে হবে।
ধীবর বধূ বিস্মিত হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি একটু ভীত হলাম।
কে কহিল–“আচ্ছা সব ঠিকঠাক হবে। তুমি তোমার মেয়েকে কোলে নাও। আমি আমার জালখানা আর মাছের ঝাঁকা কাঁখে নেই।”
সেই মাঠ পার হয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা লোকালয়ে আসিলাম। একখানা ঘর আর একখানা রান্নাঘর। আমাদেরকে দেখে পাড়ার কয়েকটা মেয়ে এসে ধীবর-বধূকে জিজ্ঞাসা করেলে, ‘এ মেয়েটি কে?’ সে বললে ‘আমার দিদি। আমাকে দেখতে এসেছে। আর যাবে না, এখানেই থাকবে।’
.
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
কয়েক মাসের ভিতর আমি জাল বোনা আর মাছ ধরতে বেশ পটু হলাম। তুমি হয়তো বিস্মিত হতে পার, আমি কেমন করে ধর্ম বিসর্জন করে জেলেনী হয়ে পড়লাম। ধর্ম আমার ‘মনের ভিতর ছিল। আমার ধর্ম আমার কাছেই ছিল। কেউ তো কেড়ে নিতে পারে নি। আমার বিশ্বাস ধর্ম অপবিত্রতা আর পাপে নষ্ট হয়; কারোর জল খেলে ধর্ম নষ্ট হয় না। যে আমাকে ভালবাসে, যার কাছে আমার উপকার পাই তাকে ঘৃণা করলেই আমার জাতি যায়।
মাঠ থেকে আর ডোবা থেকে আমরা মাছ ধরাতাম আর বাজারে বিক্রয় করতাম! কোনো দিন আমার এই নূতন বোনটির সহিত ঝগড়া হয় নাই। যে পয়সা উপায় করতাম সব জেলে-বধূকে দিতাম। তার মেয়েটির নাম রেখেছিলাম ‘আলতা’।
আলতা তার আপন মাকে ভুলে আমাকেই বেশি ভালবাসতে আরম্ভ করলে। আমার তাকে কোলে করতে কোনো ঘৃণা হতো না। নিজেকে আমি বেশ করে ভুলে তাকে আঁকড়ে বরতে শিখেছিলাম।
সব ভেদ নষ্ট হয়ে গেল। দুই জনের খাটুনীর ফলে আমাদের প্রচুর আয় হতে লাগলো। কোনো কষ্ট ছিল না।
সাত বছর আমার এখানে কাটে। তার পর একটা ঘটনা ঘটেছিলো যাতে আমার মাথা আবার খারাপ হয়ে উঠলো।
গ্রামে কয়েকটা ছোঁকড়া যুবক আমাদের উপর বিশেষ অনুগ্রহ দেখাতে আরম্ভ করলে। হাটের ভিতর মাছ নিয়ে এলে তারা আমার মুখপানে চেয়ে চেয়ে থাকত।
এর পর দিনে-দুপুরে কত পুরুষ আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে আরম্ভ করলে। বিধাতার সংসারে যেন একটুকু নিরাপদ স্থান নাই।
একটা যুবক–তার নাম রমেন্দ্র বোস। অনর্থক একদিন সে আমাকে মামি বলে ডাকলে। বিরক্ত হলেও আমি তার উপর একটু স্নেহপ্রাণ হয়ে উঠলাম। আলতার মা একদিন আমায় বললে, দিদি, এই যুবকটি বোসেদের বাড়ির ছেলে। কিছু বলবার যো নাই। তুমি সাবধানে থেকো, ওর মামি বলাকে বিশ্বাস করো না। মামি বলতে সে একদিন তোমার বুকে ছুরি বসাতে পারে।
আমি আলতার মাকে তার সতর্কতার জন্য খুব আশীর্বাদ করে বললাম ”দিদি, সে সম্বন্ধে তুই কিছু ভয় করিস না। মেয়ে মানুষ যদি তার সতীত্বের জন্য একবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তা হলে কেউ তাকে কুপথে নিতে পারে না।”
মাথার কাছে একখানা বঁটি রেখে আমরা শুয়ে থাকতাম। একদিন দুপুর রাতে শুয়ে আছি সহসা শুনতে পেলাম কে যেন বেড়া কাটছে। ব্যাপারখানা ভালো করে বুঝবার জন্য ধীরে ধীরে আলতার মাকে তুলে বেড়ায় ছিদ্র দিয়ে দেখতে পেলাম সাতজন যুবক, তাদের পাণ্ডা আমার ভাগিনা রমেন্দ্র বোস।
রমেন্দ্র বোস ধনীর সন্তান। সে এই রাত্রে তার এয়ার-বন্ধুকে নিয়ে কেন এসেছে তা আমার বুঝতে বাকি রইল না।
আলতার মা ভয়ে কাঁপছিল আমি তাকে সাহস দিয়ে বলল–“কোনো ভয় নাই।” ধীরে বেড়ায় পাশ খুলে গেল। স্বচ্ছ আঁধারে দেখতে পেলাম রমেন্দ্র আমার দিকে এলো। আর একটি যুবক তার পরেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আলতার মায়ের দিকে গেল। তার পর যা দেখলেম তাতে আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে রমেন্দ্রের ঘাড়ে বঁটি দিয়ে এক প্রচণ্ড আঘাত করিলাম।