রামা বলল–“হুজুর ওর বিচার হল না? বাহির হইতে একজন চাপ–স্বরে বললে–শিকার তো মিলেছে! আর বিচারের দরকার কী?’
নায়েব আমার দিকে তাকিয়ে রুক্ষস্বরে বললে–“মুসলমানের বাড়িতে যেয়ে আর জাতি নষ্ট করো না। আমার বাসায় যাও।”
অতঃপর ব্রাহ্মণ নায়েবের দিকে তাকিয়ে বলল–“তোমার ওখানে থাকার জায়গা আছে তো? না হয় মেয়েটি আমার ওখানে গেলেও পারে।
একটা স্ত্রী লোককে নিয়ে ব্রাহ্মণ শিষ্যের ভিতর এই দ্বন্দ্ব দেখে আমি হাস্য সংবরণ করতে পারলাম না। কী বদান্যতা! কী অভিনয়!
মাথা আমার কেমন হয়ে উঠলো! হেসে হেসে খুন হয়ে আমি মাঠের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করালাম। দুই-একজন বরকান্দাজ ধরবার জন্য আমার পিছনে পিছনে এসেছিলো কিন্তু খানিক এলেই আমার উম্মাদনাপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে তারা ফিরে গেল।”
.
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
চারিদিন হেঁটে সাজাহানপুর স্টীমার স্টেশন ঘাটে এসেছি। একটা যুবক সেখানকার বাবু। স্টেশনে এসেই একটা আশ্চর্য কাণ্ড দেখলাম। ঢাকার এক বাঙাল অসময়ে টিকিট চেয়েছিল। বাবু ঘরের মধ্যেই মুখ ধুচ্ছিলেন। সমস্ত রাত ঘুমিয়ে ঘুমিয় বাবুর মাথা বোধ হয় খুব গরম হয়ে উঠেছিল। নিষ্ঠীবন ভরা মুখে জল বেচারার মাথায় ফেলে দিয়ে বললেন–“টিকস চাইছো, বাপ্পা?’।
মাথা যেন কেমন হয়ে উঠলো। ইচ্ছা হল ছোটলোকটাকে কান ধরে ঠিক করে দেই। পথ-ঘাটে মানুষের নির্মমতা দেখে দেখে ক্রমেই আমি বেশি করে পাগল হচ্ছিলাম। সমস্ত জাতিটার ভিতর, পল্লীতে, শহরে রাস্তায়, গলিতে, স্টীমারে, গাড়িতে মানুষের একি নীচতা ও মানুষ্যত্বের অবমাননা। প্রাণ ভেঙ্গে বের হল–ভাবলাম, কাজ নাই এ সংসারে।
ভাবলাম পাগল হয়ে সারা জীবন ঘুরে বেড়াব। ঘৃণিত ভণ্ড পিশাচদের সঙ্গে আর আমার কোনো সম্বন্ধ নাই। একটা যুক্তির আস্বাদ পেয়ে হো-হো করে হেসে উঠলাম।
আমার হাসি শুনে কতকগুলি লোক এসে আমার চতুর্দিকে দাঁড়াল, আমি আরও হাসতে আরম্ভ করলাম। তার সকলেই বললে, আমি পাগল।
ক্রমে যাত্রী এসে জমা হল। আমার পয়সা ছিল না। মনে করলাম কত জায়গা পড়ে থাকে, একজন ভিখারির ভারে জাহাজ ডোবো-ডোবো হবে না। জাহাজে উঠতে যাচ্ছিলাম, কেরানি টিকিট দেখতে চাইলো। আমি বললাম, ‘টিকিট নাই পয়সা নাই।’ কেরানি হেসে বললে, আচ্ছা বিনা টিকিটে যদি যেতে চাও তা হলে সবার পরে যাবে, অপেক্ষা করো।’ সকলেই স্টীমারে উঠে গেল। চট্টগ্রামের খালাসীগুলি সিঁড়ি টানতে আরম্ভ করলো। কেরানিকে বললাম–“বাবু যেতে দাও আমাকে। জাহাজে অনেক জায়গা পড়ে আছে। আমার কাছ থেকে কোম্পানি পয়সা আদায় না করলে তো তার কিছু ক্ষতি হবে না।’
কেরানি তাড়াতাড়ি আমাকে তার কামরার ভিতর যেতে বললে। আমি টিকিটের আশায় টিকিট-ঘরে প্রবেশ করিলাম।
জাহাজ ছাড়-ছাড় হল বাবুকে মিনতি করে বললাম, বাবু, আমি পাগল মানুষ যেতে দাও আমাকে। জাহাজে অনেক মানুষ যাচ্ছে। একজন বিনা টিকিটে গেলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না।
বাবুব হেসে বললে, “আজ আমার কছেই থাকো। রূপ তোমার ঢের আছে। কাল টিকিট ও নূতন কাপড় দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। হ্যাঁ তুমি কোথায় যাবে?’
আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, মাথা আমার কেমন খারাপ হয়ে উঠলো। আমি বললাম–’সাগরে যাবো।‘
এইকথা বলেই আমি ক্ষিপ্রগতিতে তার কামরা থেকে বেরিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সকলে তীর থেকে ‘ধরো ধরো একটি মেয়ে মারা পড়লো। মেয়েটি পাগল বুঝি’ এই সব কথা বলে চিৎকার করতে লাগলো। আমি নদীর বুকে লাফিয়ে পড়লাম।
.
ভাসতে ভাসতে এক মাঠের কূলে এসে উপস্থিত হলাম। প্রকাণ্ড মাঠ, ইচ্ছা হল সমুদ্রের মতো এই নদীকে সামনে করে মরুর মতো বালির মাঠে সীমাহীনতায় ছবি দেখে,এই নিবিড় নির্জনতার ভিতর পড়ে থাকি।
কিন্তু এ কি! এখানেও মানুষ! একটা ধীবর-কন্যা মাছ ধরছিল। একটা মেয়ে তার। পাশে বসে খেলা করছিল।
এগিয়ে যেতে দেখতে পেলাম মেয়েটির হাত বাড়িয়ে আমার কোলে আসবার জন্য মা! মা! করছে। জানি না কেন? মায়ের স্নেহে প্রাণ ভরে উঠলো। ইচ্ছা হল মানুষের ভিতর একটা কুঁড়েঘর বেঁধে আমার হরিঠাকুর আর এই মেয়েটিকে নিয়ে আবার সোনার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু হায়! অনেক দিন আগেই সে স্বপ্নে আমার আগুন ধরে গিয়েছিল।
ধীবর বধূ মাছ ধরা ফেলে ছুটে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে–“তুমি কে বোন।‘
আমি বললাম—’আমি তোমারই জাতি আমার একটি মেয়ে ছিল। কোথায় হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। মাঝগাঙ্গে নৌকা ডুবে আমার আর আর সঙ্গীরা কোথায় ভেসে গিয়েছে, তা জানি না। ভাসতে ভাসতে এখানে উঠে পড়েছি।‘
ধীবর-বধূ কাদ কাঁদ হয়ে বললে–“আহা! এমন বজ্রঘাত তোমার মাথার উপর পড়েছে। কবে তোমার মেয়েটি হারিয়েছিল? আমি বললাম–সে অনেক তথা প্রজাপতি নিয়ে সে খেলা করছিল, আমি অমনোযোগী হয়ে আপন মনে কাজ করছিলাম–মেয়ে আমার প্রজাপতি ধরাবার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় চলে গেছে তার ঠিকানা নেই।‘
ধীবর-বধূ জাল ফেলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। বলিল–একে এই শোক তার উপরে নৌকা ডুবে সকলকেই হারালে। কোথায় তোমার বাড়ি তাও তুমি জান না। মেয়েমানুষ যখন তুমি কেমন করেই বা জানবে!
মনে মনে একটু হাসিয়া গম্ভীরভাবে বলিলাম-হ্যাঁ সতী যারা তাদের পক্ষে স্বামীর নাম, বাপের নাম, জেলার নাম এসব জানা বেহায়ামি, তা আমি জানি; নইলে আমি জেনে রাখতাম।