আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত বলিলাম–’সর্দার, তুমি আমার পুত্র, তুমি আমার পিতা, তুমি দেবতা; এই কথা বলে আমি সর্দারের পদধূলি গ্রহণ করলাম।‘
সর্দার বাধা দিয়ে বললে, ‘মা তোমার সালামের দরকার নাই। আমি যে তোমাকে বাঁচাতে পেরেছি এ জন্য খোদার কাছে হাজার শোকর।’
আনন্দে ভক্তিতে আমার চোখে জল আসল। ইচ্ছা হল সর্দারকে দেবতা বলে পূজা করি। তার পা দুখানি বারে বারে চুম্বন করি।
প্রভাত হতে একটু দেরি ছিল। আমরা এক নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম! দেরি করবার সময় ছিল না। গন্তব্যপথ আর এক ক্রোশ দূরে। কাছে কোনো নৌকা ছিল না। নদীটি বিশেষ বড় নয়! সর্দার বললে, ‘যেমন করে তোক আমাদের নদী পার হতেই হবে। কোনো নৌকাও তো দেখতে পাচ্ছি না।’
আমি বললাম, ‘ছোট নদী যখন, আমি সাঁতার দিয়েই পার হতে পারবো।’ ভালো করে কাপড় এঁটে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সর্দার আমার কাছে কাছেই রইল। ভয় পাছে আমি ডুবে যাই।
দুমিনিটের ভিতর পার হয়ে আবার একটা মাঠ পার হতে আরম্ভ করলাম। মাঠ পার হতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো। গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বে একটা বাড়িতে আমরা উপস্থিত হলাম। চারখানি ঘর! সর্দার দেরি না করে বোনকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।
সর্দারের বোন দেখতে খুব কালো, সে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। সর্দার তার বোনের ভাব বুঝতে পেরে বললে, ‘বুবু তুমি বিস্মিত হয়ো না। ইনি হচ্ছেন আমার মা। দক্ষিণদোয়ারী ঘরখানি ছেড়ে দাও। উনি হিন্দু, উহার পাক আলাদা হবে। দেখো যেন। মার কোনো কষ্ট না হয়। আমার আর দেরি করবার যো নাই, আপাত এ দুটাকা নাও।‘
সর্দারের বোন টাকা নিলো না। সে বললে, ‘সে কি কথা? উনি তোমার মেয়ে তা হলে আমারও মেয়ে। আমাদের কোনোও অভাব নাই, আমরা একটা লোককে সারা বছর বসিয়ে খাওয়াতে পারি।’
সর্দার বললে, ‘আচ্ছা, আমার আর সময় নাই। আমি আবার কাল আসবো। দেখো যেন মায়ের কোনো কষ্ট না হয়।’
কথা বলে সর্দার আমার দিকে একবার আশ্বাস ও স্নেহভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল।
সর্দারের বোন আমাকে যত্ন করে বসতে দিল। ভিজে কাপড় দেখে তাদের বাড়ির কাঁচা জোলার তৈরি একখানা মোটা কাপড় এনে দিলে, আমি তাই দিয়ে কাপড় ছাড়লাম।
.
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
‘এক মাস কেটে গেল। সর্দার প্রায়ই আমাকে দেখে যেতো, আমার কোনো কষ্ট ছিলো। একদিন বিকাল বেলা সর্দার মুখখানা ভার করে বলে, ‘মা’ বড় বিপদ উপস্থিত!’ আমি বলিলাম—’কী বিপদ সর্দার?’
সর্দার। সেই কাফের ব্রাহ্মণ জমিদারের কাঁচারীতে নালিশ করেছে। নায়েব তার শিষ্য।
আমি নাকি একটা হিন্দুর মেয়েকে বের করে কোথায় সরিয়ে রেখেছি। দেখেছো ব্রাহ্মণের ধর্ম? বেটা মনে করেছে কাঁচারীতে আমাকে অপমান করবে। তা হবে না। যদি তাই হয় তবে ব্রাহ্মণের জান নেবো। নায়েবের ঘাড়েও মাথা থাকবে না। এতে যদি আমার। ফাঁসি হয় তাতেও আমি রাজি আছি। তবুও এই হারামজাদা জাল দেবতাকে আমি দেখবো।
আমার মাথা যেন কেমন হয়ে এলো। আমি কহিলাম, ‘সংসারে ধর্ম নাই। অধার্মিক বেঁচে থাকে। তাদেরই প্রতিপত্তি বেশি। অধর্মের বিরুদ্ধে কেই দাঁড়ায় না। শয়তাকে সবাই সম্মান করে। ধর্ম নাই! হৃদয় পবিত্র না করেই অন্যায়ের মধ্যে ডুবে থেকে মানুষ উপাসনা করে, আর স্বর্গে যেতে চায়। কী আশ্চর্য!
সর্দার বল্লে, কোনো শালাকে ভয় করি নে। যদি বামুনের কথা নায়েব বিশ্বাস করে। তা হলে তার ভালো হবে না। এই বলে সর্দার সেদিন কার মতো চলে গেল। এর। কয়েকদিন পরে সংবাদ পেলাম সর্দারকে নায়েব মশাই বেঁধে রেখেছে। মনটা বড় খারাপ। হয়ে উঠলো। ক্ষমতার এই ঘৃণিত অপব্যবহার দেখে হাড়ে হাড়ে জ্বলে গেলাম। মাথার ভিতর বন বন করতে লাগল।
আমি পাগল হয়ে জমিদারের কাঁচারির দিকে ছুটে চলোম। যে আমাকে এমন করে উপকার করেছে, তাকে আমারই জন্য এত লজ্জা ও অপমান ভোগ করতে হবে এ আমার। সহ্য হল না।
যেয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মন কেঁপে উঠল। নায়েব একটা লম্বা ফুরশি হুঁকোর নল মুখে দিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসেছিল সামনে সর্দার! হাত বাঁধা। মাথা নত করে সে দাঁড়িয়েছিল।
আমাকে দেখেই ব্ৰহ্মণ! লাফিয়ে উঠে বললে, এই সে মেয়ে, একেই ও বের করে এনেছে। হিন্দু পরিবারের জাতি নাশ! এর একটা বিহিত–ব্যবস্থা হওয়া আবশ্যক।
আমি কহিলাম–ব্রাহ্মণ! নিজের পাপ ও বদমায়েশী ঢাকবার জন্য এই নীচ ষড়যন্ত্র কেন?’
নায়েব বিরক্ত হইয়া কহিল–“সাবধানে কথা বল। উনি আমাদের দেশের গুরু। তুমিও কম বদমায়েশ নও।”
আমি কহিলাম–নায়েব! তুমি আমাকে কি মনে করো? প্রজার টাকা চুরি করে সুখলিপসু বোকা জমিদার বাবুদিগকে ফাঁকি দিয়ে খুঁড়ি মোটা করে আমাকে বদমায়েশ বলছো।
নায়েব বলল–“দেখতে পাচ্ছি মেয়েটা সর্দারের পিরিতে পাগল হয়ে গিয়েছে। জাত তো আর ফিরে পাবে না।”
আমি হো-হো করে হেসে উঠে বললাম,–“ঠিক! ঠিক! কি ধর্ম! কি ব্রাহ্মণত্ব। আর কি তোমার শাস্ত্রজ্ঞান! তোমাদের অধার্মিক লম্পটের আর চোরের জাতি যাবে না আর আমার জাতি যাবে! এমন সমাজের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নাই।
নায়েব কি জানি কি কারণে একটু অনুগ্রহপ্রবণ হয়ে পড়লো।
বরকান্দাজ কুকুরগুলো লাঠি হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নায়েবের হুকুমের আশায় দাঁড়িয়েছিলো। নায়েব হেঁকে বললে–“রামা,সর্দারকে ছেড়ে দাও।