আর একজন একটু বিরক্ত হইয়া একটু দয়ার সহিত জিজ্ঞাসা করলে, বাছা তোমার বাড়ি?
আমি কহিলাম-বাড়ি আমার বাংলাদেশে। সে আবার জিজ্ঞাসা করিল–“জাতি? আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম কী জাতি? তা দিয়ে তোমার কী? আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে?”
সকলেই হেসে উঠলো–একজন বললে ”তোমার বাবা কী জাতি ছিল?”
আমি কহিলাম “মানুষের জাতি কী? ঈশ্বর আছেন, মানুষ আছে। অমনুষের পিতা ঈশ্বর। আমি কোনো জাতির ধার ধারি না।“ ব্রাহ্মণ আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন, ‘মেয়েটিকে এত বিরক্ত করেছো কেন? পাগল মানুষ নিয়ে পূজার বাড়িতে রহস্য করা পাপ! যাও সকলে বাড়ি যাও।’
জনতা ভেঙ্গে গেল। তার পর ব্রাহ্মণ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন–’বাছা, এই পূজার ঘরের সামনে বসে থাক। কারুর সঙ্গে কথা বলো না। মায়ের প্রসাদ এলে খেতে পাবে।
ব্রাহ্মণের অনুগ্রহে মুগ্ধ হলাম। মুহূর্তের মধ্যে যেন সংসারকে আপনার বলে মনে হল। আমি পূজা দালানের রকে বসে পড়লাম।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
”কয়েক দিন সেখানে কেটে গেল। ব্রাহ্মণের স্নেহে মাথার গোলামাল অনেকটা কমে গেল।
একদিন নিশীথকালে শুয়ে আছি, দেখলাম–ধীরে দরজা খুলে যাচ্ছে। বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলাম। সম্মুখে পূজারী ব্রাহ্মণ। কিছু কথা না বলে চুপ করে পরে থাকলাম। ভাবলাম ব্রাহ্মণের কোনো কাজ আছে।
কী আশ্চর্য! ব্রাহ্মণ ধীরে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, তার পর যা দেখলাম তাতে মাথাটা আবার কেমন হয়ে যেতে লাগল, সহসা সংসারের উপর দারুণ ঘৃণা জমে এলো, বাঘিনীর মতো লাফিয়ে উঠে বললাম, ব্রাহ্মণ এ কি?”
সে যেন সহসা কেমন হয়ে উঠলেন। মাথা তার নুয়ে পড়লো! সে কাঁপতে কাঁপতে বল্লে–‘আমি ব্রাহ্মণ, দেবতার অংশ! আমাকে সন্তুষ্টি করলে পুণ্যি হবে। আমার বিরুদ্ধে কাজ করবার তোমার অধিকার নাই।’
সিংহিনীর মতো বললাম—’তুমি চণ্ডাল, ব্রাহ্মণ বলে যে তোমাকে স্বীকার করে সেও চণ্ডাল।’
ব্রাহ্মণ মৃদুভাবে উত্তর দিলো–’ব্রাহ্মণের কাজে সমালোচনা করতে যাবার তোমার কি ক্ষমতা আছে? আমি ব্রাহ্মণ! তুমি আমাকে ভক্তি করবে। আমার পাপ আমার কাছে। তোমাকে শুধু মানতে হবে আমাকে। শুধু আমাকে সেবা করবে।’
আমি কহিলাম—’কোন গর্দভ তোমাকে এ জ্ঞান শিখিয়েছে? এরি নাম ব্রাহ্মণত্ব! ব্রাহ্মণ কাকে বলে তা তুমি জান? পৈতা দিলেই ব্রাহ্মণ হয় না! যারা তোমাকে ব্রাহ্মণ বলে মানে, তারা ধর্ম না করে অধর্ম করে।’
ব্রাহ্মণ দৃঢ়স্বরে বলিল-‘বটে! আমি ব্রাহ্মণ নই! দেবতাকে অসন্তুষ্ট করে তুমি বেঁচে যাবে? এখনও বলছি আমাকে সন্তুষ্ট করো।’ এই কথা বলেই সে দুই হাত তুলিয়া আমার দিকে অগ্রসর হল? আমি প্রচণ্ড পদাঘাতে তাকে দূরে ফেলে দিলাম। তার মাথা ভেঙ্গে গেল।
ব্রাহ্মণ ক্রোধে কাঁপিতেছিল। সে হাত তুলে বললে—’দেখ মাগি, তুই কে তা আমি জানি, আমার সঙ্গে চালাকি! প্রতিজ্ঞা করলাম কাল রাতে মুসলমানের দ্বারা তোর জাতি নষ্ট করে ছাড়বো।’
আমি বলিলাম, তুমি ব্রাহ্মণ। তোমার অভিশাপে ফুলের বাগান শ্মশান হয়। আমাকে অভিশাপে ভস্ম করে দাও। মুসলমানকে ডাকা কেন?
১৬-২০. সে সমস্ত দিন
ষোড়শ পরিচ্ছেদ
সে সমস্ত দিন আমাকে তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল। একটু জলও আমায় খেতে দেয়
নাই। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। সন্ধ্যাকালে অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
অনেক রাতে দরজার সামনে কীসের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম দরজা খুলে যাচ্ছে! এক অতি বলিষ্ঠ ভীষণকায় মানুষ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল।
লোকটা মোটা গলায় বললে-‘ঠাকুর, দরজা একেবারে বন্ধ করবেন না! চাবি ফেলে যান। যা করাবার আমি করবো। আপনি এখান থকে চলে যান। নইলে কিছু হবে না।’
বাহির হইতে গম্ভীর আওয়াজে কে বললে, “আচ্ছা।’
লোকটি তাহার দৈত্যির মতো চেহারা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এ কি? সেই ভীষণকায় দৈত্য দেবতার মতো বললে, ‘মা উঠে পড়, উঠে পড়। তোমাকে বাঁচাতে এসেছি। ব্রাহ্মণ অতি ভীষণ লোক, ফাঁকি দিয়ে বাঁচাতে এসেছি। খবরদার! পাগলামি করিস না। চুপে চুপে বেরিয়ে পড়।’
আমি কথা না বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম।
সেই লোকটি আর দেরি করল না। বহিরে এসে সে আমাকে বললে, ‘আমার সঙ্গে আয়।’ এই কথা বলেই সে মাঠের দিকে রওনা হল, আমি তার পেছনে পেছনে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম।
গভীর নিশা, চারিদিক অন্ধকার। লোকটা বললে, তুই আমাকে তো চিনিস না। কোনো ভয় নাই। আমার বাড়ি এক ক্রোশ দূরে। এই রাত কালেই আমার বাড়ি ছেড়ে আরও তিন ক্রোশ পথ যেতে হবে; নইলে উপায় নেই। আমার বোনের বাড়ি লাহিড়ীপাড়া। সেখানে তোকে রেখে তোর সোয়ামীকে খবর দেবো।
আমি কহিলাম, ‘সোয়ামীর ঘর যে কোনো কারণেই হোক ছাড়লে আর সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। ঘরে যদি আগুন লাগলে বাড়ির ভিতর পুড়ে মরা ভালো, তবুও বাড়ি ছেড়ে বেরোনা ঠিক নয়। তাতে স্বামী সতীত্ব সম্বন্ধে অবিশ্বাস করতে পারেন। আমার মাথা একটু খারাপ হয়েছে, পাগল হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি, স্বামীর ঘরে আর আমার যাওয়া। হবে না।’
লোকটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা, খোদা যা করেন, তাই হবে। আমি একজন লেঠেল, শয়তান ব্রাহ্মণ মনে করেছিলো আমি লেঠেল এবং মুসলমান, যে কোনো পাপ আমি করতে পারি। তোর সর্বনাশ করাবার জন্য আমাকে টাকা দিয়েছে। দশটা টাকার কথা বলেই ঘৃণার সঙ্গে মাঠের মধ্যে টাকাগুলি সে ফেলে দিয়ে বললে—’হারামি টাকা মুসলমান শূকরের গোস্ত মনে করে। চাইনে অমন শয়তানি টাকা! ব্রাহ্মণ মনে করেছিলো সামান্য দশটা টাকার লোভে আমি যে কোনো পাপ করতে পারবো। আমার ধর্ম কী? তা সে জানে না! আমাদের মহারাজ মোহাম্মদের মহিমা কে বুঝে? মুসলমান কি? তা। সেই কাফের কি করে জানবে?’