শাশুড়ীর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যে আমি সকলেরই শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিলাম, শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন না কেবল তারা। আমার দিকে চাইতেই তিনি কেঁদে ফেলতেন। পাছে কেউ দেখে তাকে দুর্বল বলে নিন্দা করে; এই ভয়ে তিনে তাড়াতাড়ি আমার সম্মুখ হতে সরে যেতেন।
বলতে ভুলেছি, বাড়ি আসাবার দুদিন পর থেকে শাশুড়ী আমার শোবার জন্য স্বতন্ত্র ঘর করে দিলেন। সকলে বললে, আমি পাপী না হলে এমন বজ্রাঘাত আমার মাথার উপর পড়ে? শাশুড়ী বল্লেন, প্রায়শ্চিত্ত না করে তার বিছানার ত্রিসীমানায় আমি না যাই। আমার নিশ্বাসে অমঙ্গল আছে। আমি রাক্ষসী। আমি পূর্বজন্মে ডাইনী ছিলাম। নইলে দিনে-দুপুরে কোলের মেয়েকে হারিয়ে ফেলি? সেদিন আমি কাউকে গ্রাহ্য না করে খুব করে হেসেছিলাম।
নিশীথে একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে শুয়ে আছি। দুপুর-রাতে দেখতে পেলাম শিয়রে দাঁড়িয়ে স্বামী কাঁদছেন। একটা দ্বিতীয় রকমের যাতনায় মন আমার অস্থির হয়ে উঠেছিল–সংসারের একি অত্যাচার? অধর্ম, মূর্খতা আর অন্যায়-মুরুব্বী এবং ধর্মের সাজে এত মানুষকে পশু করে তুলেছে। মানুষের জন্য এত দুঃখ রচনা করছে।
মনে হল এই পাপে ভরা সংসারে আর থেকে কাজ নাই। কয়েকদিনের ভেতর দেখতে পেলাম, স্বামীও যেন কেমন হয়ে গেছে। যে আসে সেই বলে এই ডাইনীকে ঘরে রেখে ভালো হবে না। একে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে একেও গঙ্গার ঘাটে রেখে আসতে পার না। যদি ভালো চাও তবে বৌয়ের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ ত্যাগ কর।
মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! স্ত্রীলোকের মনের উপর এত অত্যাচার! সমস্ত সংসারটা যেন একটা অগ্নিময় নরক বলে আমার বোধ হল। বেশ বুঝলাম সংসারে ধর্মের নাম গন্ধ নাই। সব মানুষই শয়তানের উপাসনা করে।
মাথা ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠলো। মানসিক অবস্থা ক্রমে অতি ভয়ানক হল। একটি মানুষও সহানুভূতি জানাতে থাকলো না। স্বামী মানুষের কথায় অত্মশক্তি বজায় রাখতে পারলেন না। সেই ধর্মহীন পশুগুলোর কথায় আমার আত্মা নূতন চিন্তা ও বিদ্রোহে অতি ভীষণ হয়ে উঠলো।
আমি পাগল হয়ে একদিন বেরিয়ে পড়লাম। আমি ঠিক পাগল হয়েছিলাম না। সকলে আমাকে নূতন রকমের দেখে পাগল বলতে আরম্ভ করলে। পাগল মানি কী? যার চিন্তা ও ভাবের সহিত সংসারের দশজলে সহিত মিল খায় না, সেই তো সমাজে পাগল বলে পরিচিত হয়।
একটা নূতন রকমের ভাবে ও উত্তেজনায় আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠলাম।
পাপ সংসার হতে একটা অসীম বেদনায়, একটা প্রচণ্ড আশাতে, একটা নূতন শক্তির উত্তেজনায় যাকে পাই তাকেই গালি দিয়ে–চোখে একটা ভীষণ ও রুদ্রভাব মেলে বেরিয়ে পড়লাম।
.
চুতুর্দশ পরিচ্ছেদ
”তখন দুপুর বেলা–মাঠ ধু-ধু করছিল। প্রখর সূর্যতাপে মাঠের ভিতর মরুর অভিনয় হচ্ছিল। আমি হন হন করে সেই পথ দিয়ে চলতে লাগলাম।
ধীরে ধীরে স্বামীর বাড়িখানি দূরে মিশে গেল। কোনো মায়া হচ্ছিল না। আমার অকৃত্রিম স্বামী প্রেম দারুণ ঘৃণায় পরিণত হয়েছিলো। হায়, মানুষের মন কী বিচিত্র! এত প্রেম দুদিনেই ছাই হয়ে গেল।
তারা মনে করেছিলো–আমি ফিরে যাব। কিন্তু ফিরলাম না। মানুষের সোজা পথ ফেলে বন অতিক্রম করতে করতে ঘুরে ঘুরে দ্রুতপদে চলতে আরম্ভ করালাম কোনো ভয় হল না।
দিন চলে গেল! ক্রমে বনে বনে অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠতে লাগল। ক্ষুধা ছিল না। মনে হচ্ছিল, ক্ষুধা হতে আমি মুক্ত হয়েছি। আর কোনোকালে ক্ষুধা হবে না। জঙ্গলের মধ্যে পাতা বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত কোন পথে কেটে গেল।
সকাল বেলায় উঠে দেখি গাছের আগায় পাখিরা সব গান গাচ্ছে। মনে আনন্দ হল–একটা বিচিত্র ধরনের পাখি দেখে তাকে পেতে ইচ্ছা হল। অমনি পাখি ধরবার জন্য গাছের আগায় উঠে পড়লাম। আমি পূর্বে কখনো গাছে উঠি নি–তাতে কোনো অসুবিধা বোধ করলাম না।
নিষ্ঠুর পাখি আমার দেহকে অবহেলা করে, অথবা মানুষের মূল্যহীন পরিবর্তনশীল প্রেমকে ভয় করে উড়ে গেল। গাছের শীর্ষে দাঁড়িয়ে দেখলাম সীমাহীন উদার আকাশ, কতদূর আকাশ ও পৃথিবী একসঙ্গে মিশেছে! শ্যামল মাঠ। উত্তর-পশ্চিম দিকে একটা ছোট নদী বয়ে যাচ্ছিল। একটা ছোট গ্রাম তার পার্শ্বে অর একটা দেবতার মন্দির।
গাছ থেকে নেমে সেই দিকে চল্লাম। একটা বড় মাঠ হতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে বেলা অনেক হয়ে গেল। গত দিন সন্ধ্যাকালে একটু ক্লান্তি অনুভব করেছিলাম, আজ সে ক্লান্তি নাই। আবার দ্বিগুণ উৎসাহ ফিরে আসিয়াছে।
গ্রামে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিল–সেইটাই মন্দির। মন্দিরের সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই পূজারী বামন আমার দিকে একটা তীব্র কটাক্ষ নিক্ষেপ করলেন। যাঁরা দেবতার সামনে বসেছিলেন তারা দেবতার চিন্তা ছেড়ে, আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার চিন্তা আরম্ভ করলেন। আমি সব বুঝতে পাচ্ছিলাম।
পূজা হতে আরও দু’ঘণ্টা লাগল। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পাঠ করতে অনেকবার এদিক ওদিক চাইবার ভানে আমার রূপ দেখছিলেন। আমি তা বুঝে মনে মনে হাসছিলাম।
পূজা শেষ হল, ধর্ম-জনতা ভেঙ্গে আমার চারিপাশে নূতন জনতার সৃষ্টি হল–আমি অবাক হয়ে তাদের বিচিত্র ধর্মভক্তির কথা ভাবতে লাগলাম।
একজন জিজ্ঞাসা করলে, সুন্দরী! তোমার নাম?
আমি কহিলাম—”আমি কী তোমার ঘরের বৌ? সুন্দরী বলে আমাকে সম্বোধন করবার তোমার কী অধিকার আছে?”